

মাওলানা আবুল কালাম জাকারিয়া। গতকাল থেকে তিনি “রাহিমাহুল্লাহ” হয়েছেন। সিলেটের সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং আলেমদের সর্বশেষ ভরসার জায়গা ছিলেন। ইলমী সমস্যার জন্য সকলেই ছুটে যেতো মুফতী সাহেব হুজুরের কাছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি কোথাও ইফতা না পড়েও তিনি ছিলেন মুফতীয়ে আযম। তাঁর ফতোয়া দেখে মুগ্ধ হয়ে শায়খুল ইসলাম তাকী উসমানী দা.বা. বলেছিলেন, “মাওলানা! আপনি ইফতা পড়েছেন কোথায়?” আরবি ভাষায় একটি শব্দ আছে “ফাসিহুল লিসান”। বাংলাতে আমরা বলি বাগ্নী, বিশুদ্ধভাষী বক্তা। আল্লামা সুনামগঞ্জী হুজুর পুরো জীবন কাটিয়েছেন সিলেটে। কিন্তু তাঁর ঝরঝরে শুদ্ধ ভাষার অনর্গল তাত্ত্বিক বয়ান শুনলে যে কেউ মুগ্ধ হতো।
এ একটি জায়গায় সুনামগঞ্জি হুজুর ছিলেন সবার চেয়ে ভিন্ন। তিনি শুধু ইলমের মহিরুহ ছিলেন না। তাঁর ইলম শুধু মাদরাসার চৌহদ্দির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো না। খুবই অল্পদিনে গতানুগতিক বয়ানের উর্ধ্বে উঠে বিভিন্ন জটিল বিষয় সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করার মাধ্যমে বয়ানের ময়দানে নতুন দিগন্তের সুচনা করেছিলেন। বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি ছাড়া যে কজন বক্তা ফিরাকে বাতিলা নিয়ে আলোচনা করতেন, সুনামঞ্জি হুজুর ছিলেন তাদের মাঝে অন্যতম। সুনামগঞ্জি হুজুরের ইলমের গভীরতা পরখ করা যায় “তাকরিরে কাসিমী” থেকে। দরসে নিযামির দূর্ভেদ্য কিতাবের মাঝে অন্যতম হলো, ‘বায়জাবি শরিফ’।
যারাই বায়জাবি শরিফ পড়ান, তাদের শিয়রে “তাকরিরে কাসিমী’ সব সময় শোভা পায়। গতবছর হুজুরের সাথে পরিচয় হয় আমার। যদিও হুজুর আব্বাজান রহ. এর খুব কাছের ছাত্র ছিলেন। আব্বাজানের স্মরণসভায় বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমদের সাথে হুজুরও তাঁর প্রিয় উস্তাদকে নিয়ে অশ্রুমাখা স্মৃতিচারণ করেছিলেন। ঠিক দুবছর পর হুজুর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন! কোনোভাবে হুজুরের অনুপস্তিতি মেনে নিতে পারছি না। মাত্র কয়েকবার হুজুরের সাথে বসার তাওফিক হয়েছিলো আমার। একবার দীর্ঘ সময় ফোনে কথা হয়েছিলো। আমি যেহেুত হুজুরের উস্তাদের ছেলে, অপরদিক থেকে নাতি শাগরিদ, এজন্য মাঝে মাঝে দুষ্টামি করতাম। হুজুর খুব উপভোগ করতেন আমার দুষ্টামি।
গত বৃহস্পতিবার একই মাহফিলে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম। এদিন হুজুর ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত। আমি হুজরের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। “কিতা খবর মাওলানা সাব! আফনার আম্মা ভালা আছোইন নি?” জিজ্ঞাসা করলেন। আমি হুজুরের হাল পুরসি করলাম। কয়েকদিন আগে হুজুর রোড এক্সিডেন্ট করেছিলেন। তারপর থেকে এখনো শরীরে ব্যথা। কিন্তু তারপরও অসুস্থ শরীর নিয়ে বৃহত্তর সিলেটের আনাচে-কানাচে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন। আহ! ভাবতে পারছি না! বৃহস্পতিবার তিনি আমাকে বলেছিলেন ফিরাকে বাতিলা নিয়ে কাজ করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো ইখলাসের। কূপ্রবৃত্তির অনুসরণ যেন কখনো না করি। রসিকতা করে বলেছিলাম “হুজুর! আপনি আগে বয়ান করবেন নাকি আমি?” হুজুর বললেন, “আমি অসুস্থ! আগে বয়ান করলে ভালো।
”হুজুর কুরআনের মাহাত্ম্য নিয়ে চমৎকার বয়ান করেছিলেন। হুজুরের পাশে বসেই পুরো বয়ান শুনেছিলাম। বয়ান শেষ করে বলেছিলেন, “মাওলানা! আমার বাড়িতে রাতে দাওয়াত থাকলো।” সুনামগঞ্জি হুজুর খুব দ্রুত চলে গেলেন। উম্মাহর দূর্দিনে উনার খুব প্রয়োজন ছিলো। তারপরও আল্লাহর ফায়সালা আমাদের মেনে নিতে হবে। আল্লাহ হুজুরকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন।