মোবাইল : ক্ষতি থেকে সাবধান!

প্রকাশিত: ৭:৩২ অপরাহ্ণ, মার্চ ৪, ২০১৯

শাইখ মাহমূদ হাসান-

(এক)

একটা সময় ছিলো যখন মোবাইল আবিস্কার হয়নি। আদি যুগে কারো হাতে মোবাইল ছিলো না। এমনকি আবিস্কার হওয়ার পরও অনেক বছর যাবত কমসংখ্যক লোকের হাতে মোবাইল ছিলো। তখনকার সময়ে এলাকার নামিদামি বিত্তবান কতিপয় লোকদের হাতে টেলিফোন পাওয়া যেতো। ফলে সাধারণ জনগণ মোবাইল ব্যবহার করা তো দূরের কথা মোবাইলের সাক্ষাত পাওয়াই তখন অসম্ভব ছিল।

আজ থেকে দুই যুগ আগের মানুষেরা কারো সাথে ফোনালাপ করতে চাইলে মোবাইল দোকানের দ্বারস্থ হতে হত। দূরবর্তী কারো সাথে মোবাইলে কথা বলতে চাইলে তখনকার সময়ে সিরিয়ালও দিতে হয়েছে। কিন্তু কালের ঘূর্ণিপাকে আজ মোবাইল সবার হাতে হাতে।

যুগের পরিবর্তনে মোবাইল আজ ছোট বড় সবার পকেটে পকেটে। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি মোবাইল আজ যেন একটি পৃথিবী এক একটি অ্যান্ড্রয়েড সেট আজ এক একটি দেশ। প্রতিটি মোবাইল ফোন আজ সবার জীবনসঙ্গী হিসাবে হাতে হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আহ! তখনকার যুগে অনেক পরিবার খুঁজলেও একটা ফোন পাওয়া না গেলেও ফিলহাল এক পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়।

(দুই)

বর্তমানে আমরা সবাই মোবাইল ব্যবহার করি। কেউ কম দামি আর কেউ বেশি দামী কেউ Android আর কেউ- বা বাটনওয়ালা। ফলে আমাদের চারপাশে এখন মোবাইলের ছড়াছড়ি। প্রতিটি শপিং মলে আছে মোবাইলের দোকান। যেদিকে নজর দেই সেদিকেই মোবাইল দেখতে পাই। মোবাইল এখন ছোট-বড় সবার হাতে হাতে। হাত বাড়ালেই সেলফোন কাছে পাই। একান্তই কোনো কারণে নিজের না থাকলে প্রিয়জনদের কাছে তা পাওয়া যায়। মন চাইলেই আমরা মোবাইল ব্যবহার করতে পারি। আমাদের মন যখন যা চায় তখন তা মোবাইল দ্বারা আমরা করতে পারি। অপ্রয়োজনে সারাদিন সেলফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কখনো প্রিয়দের সাথে মেসেজে কথা বলি। কখনো বা ফেইসবুকে অহেতুক চ্যাটিং- এ ব্যস্ত থাকি। আবার কখনো ছবি আপলোড আর গ্রুপভিত্তিক শিক্ষা ও তথ্যহীন টকশোতে সময় কাটায়। এমনকি বাসায় Wi- Fi আর মোবাইলে MB থাকলে শয়তানী চক্রান্তে মাঝেমধ্যে অনলাইনের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে চক্কর দিতে ভুলি না । নির্জন একলা ররুমে তখন মনের খুশিতে যা মন চায় তা করতে কেউ একটুও চিন্তা করে না। কে কি দেখলো বা বললো তা শুনার মতো তখন কারো হাতে সময় থাকে না। মোবাইলের স্বর্গ রাজ্যে একাকী বা গ্রুপে নোংরা কাজ করে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে না। আর ভদ্র লোকটির রাতের কুকীর্তি দিনের আলোতে কেউ দেখলেও তার জবাবদিহিতা নিচ্ছে না। কারণ অন্যসবাই তো তার প্রতি ভালো ধারণা করে নিরবতা পালন করছে। আর ভাবছে ওর দ্বারা কখনো খারাপ কিছু হবে না। তাঁরা মনে করে সে কখনো ওসব করতেই পারে না।

অথচ আমরা কি করি? আমরা কি মুরুব্বিদের সু-ধারণা রাখতে সক্ষম? তাঁদের আশার সীমানা ভেদ করে আমরা কি ওসব করিনা? পৃথিবীর বুকে ক’জন মোবাইল ব্যবহারকারী আছে নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করার? কতজন পাবো বহুবছর ধরে মোবাইল ব্যবহার করেও এখনো অনলাইনের নাপাকিতে অপবিত্র হয়নি? এমন আছে ক’জন যারা মোবাইলে ফোনের মাধ্যমে সিনেমা ও নগ্নভিডিও দেখেনি? তাদের সংখ্যা কতজন হবে যারা মোবাইলে নগ্ন প্রেম ও ভালবাসা করা থেকে বিরত থাকে?

মোবাইল ব্যবহারে ভাল মানুষের সংখ্যা কম থাকলেও অতি প্রয়োজনে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ মোবাইল ব্যবহার করতে পারে। একান্ত প্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার করা দোষের কিছু নয়। আপনদের সাথে যোগাযোগ করতে মোবাইল হাতে রাখে গোনাহের বিষয় নয়। নিজের বৈধ প্রয়োজন ও যুক্তিসংগত কারণে মোবাইল ব্যবহার সবার জন্য উপকারী। মানবসেবায় সেলফোন পকেটে রাখা জনদরদীর কাজ। কিন্তু আফসোস যে, বর্তমান সময়ে এমন মানুষ আমাদের সমাজে না-ই বললে চলে। আর থাকলেও হাতে গোনা দু চারজন। কারণ, মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই এমন যারা প্রতিনিয়ত ফেইসবুকে বিভিন্ন স্টাইলে নিজের ছবি তুলে আপলোড দেয়। কিন্তু কেন যে সে হরহামেশা নিজের ছবি ফেসবুকে আপলোড দেয় তা সে নিজেই অনুধাবন করতে পারে না। অথচ একটা মোবাইল একজন মানুষের জীবনে অনেক উপকারী। মোবাইলের একটা অনলাইন নিউজই একজন মানুষের চিন্তা চেতনা পরিবর্তন করে দিতে। ফেসবুকের একটা সত্য সংবাদই একজনের দিল ঘুরিয়ে দিতে পারে। আধুনিক যুগে অনলাইনে একজনের দীনি দাওয়াতই ইসলামকে সারা বিশ্বে পৌঁছে দিতে সক্ষম। কিন্তু মডার্ন যুবকরা আজ এসব চিন্তা থেকে অনেক দূরে। মানব সেবার পরিবর্তে স্মার্ট ইয়ংরা আজ খেলাধুলায় ব্যস্ত।

(তিন)

মোবাইল ব্যবহারে সচেতন বিবেকবানদের কাছে প্রশ্ন হল যে, মোবাইলের মাধ্যমে ফেইসবুকে ছবি আপলোড দেওয়া ছাড়া অন্যকোন কাজ কি তোমার নেই? তুমি কি নিজের আবেগ- অনুভূতি থেকে মানুষের কল্যাণার্থে ফেইসবুকে দু’কলাম লিখতে পারো না? তোমার কি মন চায় না যে, তুমি প্রতিদিন নিজ হাতের মোবাইল দিয়ে মানুষকে সত্যের পথে ডাকবে? দুনিয়া ও আখেরাতে নিজের ক্ষতি হয় এমন কাজ তুমি সেলফোনের মাধ্যমে করবে না? কখনো কি তোমার ভাবতে মন চায় না যে, কেন তোমার হাতে মোবাইল? কি কারণে তুমি মোবাইল ব্যবহার করছো? কি এমন প্রয়োজন যে, তোমায় এই জিনিসটা ব্যবহার করতে হবে? আর না করলেই-বা কি হবে? শুধু কথা বলার জন্যই কি তোমাকে এতো দামি ফোন কিনতে হবে? পড়া-লখা বাদ দিয়ে গেইমস খেলার জন্যই কি হাজার টাকা দিয়ে Android মোবাইল কেনা তোমার বেশী প্রয়োজন? বন্ধুদের সাথে Messenger -এ কথা বলার জন্য কি তোমার দামি একটা মোবাইলের অতি প্রয়োজন? পরিবার কষ্টে দিন কাটালেও তুমি একটা মোবাইল বায়না ধর কেন? মোবাইল নামের আধুনিক প্রযুক্তি যে কত মানুষকে বিপদগ্রস্ত করছে তার হিসাব কি তোমার কাছে আছে?

কত যুবক যে এই একটা বস্তু হাতে নেওয়ার কারণে নিজেকে ধ্বংস করেছে তা কি তোমার জানা নেই? কেন মোবাইলের লাভ ক্ষতি জেনেও রাস্তার দর্শকের মতো নিরব ভূমিকা পালন করো? কেন আজ তুমি এই বিষাক্ত জিনিসটা তোমার আদরের অপ্রাপ্ত ছেলে- মেয়ের হাতে তুলে দিচ্ছো? কেন প্রিয়জন বায়না ধরলেই মোবাইল গিফট করবে বলে ওয়াদা করো? কেন মোবাইল গিফট করে প্রিয়জনের সেলফোনে কোনদিন তুমি তথ্য তালাশ করনি? কেন পড়া-লখা ছেড়ে তোমার প্রিয়জন দিবানিশি আজ মোবাইলের গেমস নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকে? কেন তোমার মোবাইল অন্যের হাতে দিতে তুমি এতো ভয় পাও? কি থাকে তাতে, যে তা কারো কাছে দেওয়া যায় না? কবে ফিরবে তুমি এসব ছেড়ে ভালো পথে? কবে খারাপ সঙ্গ বাদ দিয়ে তুমি ভালোদের দলে মিশতে উৎসাহী হবে? কবে তোমার বিবেক তোমাকে নবচেতনার আহবানে সাড়া দিতে বলবে? কবে মোবাইল ব্যবহারে তুমি আরো বেশি সচেতন ও সংযমী হবে?

জানি না কবে তোমার বিবেকে আমার কথা আঘাত করবে। কবে তোমার কানে আমার আহাজারী প্রতিধ্বনিত হবে__সে সময় আমার জানা না থাকলেও তোমাকে বলছি যে, মোবাইল কেন হাতে নিয়েছো তার সঠিক ও বাস্তবসম্মত কারণ নিজে অনুধাবন করো। চলার পথে সতর্কতা অবলম্বন করে মোবাইল ব্যবহার করো। তোমার জন্য মোবাইল ব্যবহার করার যদি যুক্তিসংগত কারণ থাকে তবে তা ব্যবহার করো। নতুবা আজই তা ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকো। কারন, মোবাইলের সঠিক ব্যবহার যদি তুমি না করো তবে তোমায় একদিন এজন্য আফসোস করতে হবে। অহেতুক মোবাইল ব্যবহার করে সময়ের মূল্য না দেওয়ার কারণে অবশ্যই তোমাকে রোজ হাশরে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। তাই প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মোবাইল ব্যবহার হোক বিশেষ প্রয়োজনে। ইসলাম, দেশ, মানবতা ও জনতার কল্যাণার্থে যেন সবাই নিজ মোবাইল ব্যবহার করে এপ্রত্যায়।

লেখক: মুফতি ও নাযেমে দারুল ইকামা
জামিয়া আরাবিয়া শামসুল উলূম খিলগাঁও ঢাকা

মন্তব্য করুন