চলমান ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব: আমার কিছু ভাবনা

প্রকাশিত: ২:০৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৯

—মুহাম্মাদ আরিফ রব্বানী

ভারত-পাকিস্তানের মাঝে সবসময় একটা টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। চাই সেটা খেলার মাঝে হোক বা দুদেশের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয় নিয়ে হোক। এই উত্তেজনাকর অবস্থা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের অধিবাসী তথা বাঙালিরা খুবই উপভোগ করে থাকে। ছোটকাল থেকেই খেলা দেখার প্রতি আমার খুব বেশি আগ্রহবোধ ছিল না। কখনও সখ করে বা বন্ধুদের মধুর বিড়ম্বনার শিকার হয়ে মাঝেমধ্যে খেলা দেখতাম। সেই সুবাদে দেখতে পেতাম ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার খেলা হলে এলাকার ছোটবড় সকলে একটু বেশিই উৎসুক থাকত। কারণ, এ দুটি দেশের মাঝে খেলার ব্যাপারটা শুধু হারজিতের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সাথে সাথে দুদেশের ভাবমূর্তির ম্লান-অম্লানের ব্যাপারও ছিল। যদিও এগুলো কমবেশি সব দেশের মাঝেই থাকে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ১৯৪৭ সনে ভারত থেকে পাকিস্তান আলাদা হওয়া, পাক-বাংলার যুদ্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের অবস্থান নেওয়া এবং কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে দুদেশের প্রশাসনের মাঝে সময়েসময়ে গুলিবিনিময়সহ নানাবিধ কারণে এ দুদেশের মাঝে অনেকটাই শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব কাজ করে থাকে।

ফলে দেখা যায় খেলার হারজিতটাও কেমন যেন প্রতিশোধগ্রহণের একটা ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও উভয়দলের খেলোয়াড়দের খেলার মান যথেষ্ট ভালো হওয়ায় তাদের প্রায় খেলা-ই শেষ ওভার অবধি গড়ায়। এজন্যই মূলত বাঙালিরা ওদের খেলা দেখার প্রতি আগ্রহান্বিত থাকতো। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে অধিকাংশ বাঙালিরাই পাকিস্তানের পক্ষে সাপোর্ট করত। অবশ্য এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে বটে। ভারত-বাংলাদেশ খেলা হলে দেখা যেত ভারতরা ম্যাচ জিতার জন্যে নানান কারচুপির পথ বেছে নিত। এমনকি একবার বাংলাদেশের বিশ্বকাপের জয়কেও তারা ক্ষমতাবলে কেড়ে নিয়েছে।

এসব কারণে খেলাপ্রিয় জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর তাদের প্রতি তিলে তিলে বাড়তে থাকা সুপ্ত ক্ষোভটা প্রকাশ করে ভারতের বিপক্ষ দলের প্রতি সাপোর্ট দিয়ে। অপর দিকে দেশের সচেতন নাগরিক যারা আছেন, তারাও এখন ভারতকে ’বন্ধুপ্রতিম’ রাষ্ট্র মনে করেন না। ‘৭১-এ ভারত আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বন্ধুত্বের পরিচয় দিলেও তা যে শুধুমাত্র স্বার্থ হাসিলের একটা কৌশল ছিল মাত্র সেটা বুঝতে এখন বাকি নেই। তবে স্বাধীনতার ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ান শুনলে জানা যায়, তখন ভারত আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্যই সাহায্য করেছে। যা ‘দরদি ভারত’ নামক বইয়ে দলিলসহ উল্লেখ আছে। তারপরও স্বাধীনতাযুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেহেতু একমাত্র ভারতই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সেহেতু তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত ভারত আমাদের থেকে যা হাসিল করেছে কিংবা চক্রান্ত করে হাতিয়ে নিয়েছে সেজন্য ভারতের প্রতি আমরা খুব বেশি মনঃক্ষুণ্ণ ও বিক্ষুব্ধ। দেশপ্রেমিক বাঙালিরা এই বিক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ভারতবিরোধিতার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান আমাদের শত্রুরাষ্ট্র হওয়া সত্বেও ভারত-পাকিস্তানের চলমান যুদ্ধযুদ্ধভাব মুহূর্তে বেশিরভাগ বাঙালিরাই পাকিস্তানের পক্ষে থাকার রায় প্রকাশ করছে। এর পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান।

এক.ধর্মীয়। দুই.রাষ্ট্রীয়। এক. একজন মুসলিম হিসেবে ওপর মুসলিমের পক্ষে থাকা এটাই ধর্মীয় দাবি। পাকিস্তান যেহেতু মুসলিম রাষ্ট্র সেহেতু বাঙালি মুসলিমরা পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে এটাই বাস্তব।

অপর দিকে চলমান যুদ্ধযুদ্ধভাবের সূত্রপাত যেহেতু নির্যাতিত কাশ্মীরি মুসলিমদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে তাই কোন মুসলিমের পক্ষে উচিত হবে না জালেম ভারতের পক্ষে নেওয়া। লাখো লাখো কাশ্মীরি মা-বোনদের যারা খুন-ধর্ষণ করেছে, মুসলিম যুবকদের ধরে ধরে হত্যা করেছে, নিষ্পাপ শিশুদের বুকগুলোকে যারা বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা করে দিয়েছে তাদের পক্ষে শুধু মুসলিম কেন কোন বিবেকবান মানুষই থাকতে পারে না। দুই. বন্ধুরাষ্ট্রের মিথ্যা দোহাই দিয়ে ভারত আমাদের শোষণ করে চলেছে। যখন যেটার প্রয়োজন পড়ছে তখন বাংলাদেশ থেকে সেটা নামমাত্র বা বিনামূল্যে লুফে নিচ্ছে। পোলিওর মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়েও তারা ধোঁকাবাজি করতে দ্বিধা করেনি; যেখানে লাখো শিশুর ভবিষ্যৎপ্রশ্ন ছিল অনিশ্চিত। ভারত এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কাছে যা যা চেয়েছে তার সবটাই পেয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ‘আশ্বাস’ ছাড়া ভারতের কাছ থেকে তেমন কিছু পায়নি। ফলে ভারতের এই দিমুখী আচরণে বাঙালিরা তাদের স্বার্থবাজ, লুটতরাজ ও চরম শত্রু মনে করে থাকে।

 

এজন্যই মূলত সচেতন বাঙালিরা বর্তমান ইস্যুতে স্বাধীনতাযুদ্ধের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ হওয়াসত্বেও ভারতের পক্ষাবলম্বন করে না। যা ভারতের জন্য খুবই পরিতাপের বিষয়। পরিশেষে বলছি, যুদ্ধ হোক তা আমি চাই না। কারণ যুদ্ধ-ই সমাধানের পথ নয়। অন্যভাবে সমাধানে আসা গেলে সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নাহলে ভারত-পাকিস্তানের সাথে সাথে বাংলাদেশ ও কাশ্মীরকেও ক্ষতিগ্রস্তদের দলে নাম লেখাতে হতে পারে। আবার হতে পারে এ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে; যা শুধু অকল্যাণই বয়ে আনবে।

ছাত্র, জামিয়া আরাবিয়া কাসেমুল উলুম, ঢাকা

মন্তব্য করুন