

আমরা এমন একটা লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছি যে লড়াইয়ে কেও কোনদিন জয়ী হতে পারবো না। না আমি, না সে, না তিনি। লড়াই যখন শেষ হবে তখন আমরা সকলেই পরাজিতদের দলে থাকবো।
আমরা আইয়ামে জাহেলিয়াতের গল্প শুনতাম । বংশপরম্পরায় গোত্র-গোত্র, পরিবার-পরিবার, গ্রামে-গ্রামে লড়াই চলতেই থাকতো । দাদাদের আমল শেষ হলে বাবারা তাঁদের লড়াই চালিয়ে যেতো! বাবাদের আমল শেষ হলে সন্তানরা এই লড়াই চালিয়ে যেত আর নিজেদের সন্তানদের ওসিয়ত করে যেত এই লড়াই চালিয়ে নেয়ার জন্য। আল্লাহর রাসুল এলেন। আল্লাহর রাসুলের ছোঁয়ায় আরব বদলে গেলো ! ধনী গরীব ভেদাভেদ, গোত্রীয় আভিজাত্য, সাদা কালো ও জাতপাতের মূলে কুঠারাঘাত করলেন প্রিয় নবী। প্রথমেই গুঁড়িয়ে দিলেন, মিটিয়ে দিলেন কৌলিন্য গর্ব, অহংকার, দর্প, দম্ভ, ঔদ্ধত্য, অহমিকা, বড়াই, আত্মগর্ব, আত্মগৌরব, আত্মাভিমান, অহংকার সব সব সব। এতটাই বদলে গেলো যে কদিন আগেও হত্যা করার সংকল্প নিয়ে বেঁচে থাকা তরুণ প্রতিশোধ ভুলে পরস্পর হাতে হাত ধরে চলতে আরম্ভ করলো। যে শত্রুতা ছিল জীবন নেয়ার তা পরিবর্তিত হয়ে গেলো জীবন দেয়ার ইতিহাসে ! যাকে হত্যা করতে জীবন যৌবন সব শেষ করেছে বৃদ্ধ বয়সে এসে সেই ভাইয়ের জন্য ভায়ের পক্ষে অস্ত্র ধারণ করছে নির্দ্বিধায় ! সেটা ছিল সোনালী যুগ আর তাঁরা ছিলেন সোনার মানুষ। তাঁদের ছিল ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
আমরা ছিলাম বদলে যাওয়া সৌভাগ্যবানদের দলে অথচ আজ হয়ে গেলাম আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই রক্তচোষা ড্রাকুলাদের মতো ! গোত্রে-গোত্রে, দলেদলে, পরিবারে-পরিবারে, জাতিতে-জাতিতে মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, টানাটানি আমাদের নিত্য কর্ম ।
আমরা ভায়ের রক্ত পান করছি! ভায়ের অসম্মানি করছি! লজ্জিত, অপমানিত, অপদস্থ করছি! অবহেলা তাচ্ছিল্য কটুক্তি গীবত আমাদের নিত্য কর্ম ! আমার সাথে যার শত্রুতা তার পরিবারও আজ আমাদের হাতে নিরাপদ নয়। আমাদের হাতে নিরাপদ নয় তাঁদের একান্ত নিজস্ব কথাবার্তা ছবি লেখাজোকা, আলাপচারিতা । ভাইকে সম্ভোধন করছি নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতম অভিধায়! বড় ছোট, আলেম জালেম, শিক্ষিত অশিক্ষিত, চেনা অচেনা, নারী পুরুষ কেউই আজ আমাদের হাতে নিরাপদ নয়।
ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, শালীনতা, ভদ্রতা, নম্রতা, সহনশীলতা, শিক্ষা সবই আজ লুটোপুটি খাচ্ছে আমাদের পায়ের নিচে। মানবতা, দায়িত্ব, কর্তব্য, আমানত, পরহেজগারিতা সব পিষ্ঠ হচ্ছে আমাদের নোংরা পদতলে।
আমরা যখন এক ছিলাম আমরা ততদিন নেক ছিলাম। পবিত্রতা ছিল আমাদের জবানে। আমাদের হাত ছিল নিষ্কলুষ। আমাদের কাছে নিরাপদ ছিল আমার আপনজন, প্রতিবেশি, দেশ। আর তখন নিরাপত্তা নিতে আমাদের কাছে আশ্রয় নিতে আসতো অমুসলিমরা__ ইতিহাস এর সাক্ষী। শিক্ষা, বিজ্ঞান শিল্পে ছিল আমাদের একক আধিপত্য।
আমাদের একতার সামনে মাথানত করেছিল তাবৎ বিশ্ব। আমরা জয়ী ছিলাম। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছিল আমাদের রাজত্ব ! আমরা ক্ষমতাসীন ছিলাম কিন্তু যেদিন থেকে আমাদের হাতে আমাদের ভাই অনিরাপদ হয়েছে সেদিন থেকেই আমরা পরাজিত হয়েছি। লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েছি। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর স্বার্থের পেছনে ছুটছি আমরা__ অথচ আমাদের সামনে রয়েছে বিশাল এক জগত! আমাদের জন্য রয়েছে মহান এক উদ্দেশ্য, নির্ভুল কর্মপন্থা ও আখেরী নবী সা. এর উত্তম আদর্শ।
যদি ধরে নেই, আমরা সেই সময়ের সোনার মানুষদের মত নই আর যুগটাও সোনালী নয় তাতে কি ? তাঁরা সকলেই ছিলেন খাঁটি হীরের টুকরো আর আমরা না হয় স্বচ্ছ কাঁচই হলাম ! আমরা সোনার মানুষ হতে পারবো না__ অন্তত কাঁচের মতো স্বচ্ছতো হতেই পারি। কিছুটা সহনশীল, কিছুটা নমনীয়, কিছুটা মার্জিত আচরনে কথায় কাজে লিখায়__এটা কি খুব বেশি চাওয়া শেষ নবীর উম্মতদের কাছে !
আমাদের জাতপাতে, রঙে বর্ণে, চিন্তা চেতনায় শত বৈরিতা, শত দ্বিমত ও হাজারো ভিন্নতা পেরিয়ে দিন শেষে আমাদের সকলেরই পরিচয় আমরা মুসলমান। আমরা মানুষ। আমরা ইলমের নূর অন্বেষী__ ইলমে ওহীর পিয়াসী। আমরা একই বাইতুল্লাহর দিকে ফিরে সালাত আদায় করি। আমাদের মাঝে মিলও কি অনেক অনেক নয় তবে আমরা কেন পারবো না একসাথে কিছুটা পথ চলতে ! কয়েকটা বাক্য বলতে! কয়েকটা শব্দ শোনতে!
আমার হাত, আমার বলা, আমার লিখা ও আমার শোনা থেকে আমার ভাই যদি নিরাপদ না হয় তবে আমি কেমন মুসলমান হলাম ! অপর ভাইয়ের দোষ যদি গোপন নাই রাখতে পারলাম তবে কি স্বার্থকতা আমার ভাই বলে পরিচয় দেয়ার! ভাইয়ের দুঃখে দুঃখী আর ভাইয়ের সুখে সুখী হতে পারলেই না আমি পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারবো। ভাইয়ের অপরাধ যদি ক্ষমা করতে না পারি তবে কিভাবে রহমানের দরবারে ক্ষমা চাইবো ! নিজের জন্য যা ভালোবাসি অপর ভাইয়ের জন্য তাই ভালোবাসা কি একজন মুসলমানের গুন নয়? তবে আমি কেন কিভাবে অপর ভাইয়ের সমালোচনা করি, ক্ষত-বিক্ষত করি কারনে অকারণে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নোংরামিতে মেতে উঠি, অপদস্থ করি! আমাকে কি প্রতিটা কথা, প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্যের জন্য আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে না !!
আসুন ভয় করি সেই দিনকে যেদিন আমার প্রতিটা কাজের হিসাব নেয়া হবে।