

এহসান সিরাজ
বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মিছবাহুর রহমান চৌধুরী’র কাছে গিয়েছিলাম ‘জীবন্তিকা’ আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা. বা. সংখ্যা’র লেখা আনতে । যদিও তিনি পড়া-লেখা করেছেন জেনারেল লাইনে কিন্তু সবসময় সম্পর্ক রেখে চলেছেন আলেম উলামাদের সঙ্গে। হাটহাজারি হজরত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় চলে এসেছে অনেক আলেম উলামার কথা। সেখানে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারমের সাবেক খতিব, মাওলানা উবায়দুল হক রহ. সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য তুলে ধরলেন। জনাব মিসবাহ বললেন, একদিন খতিব সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব! আপনার গাড়িটা নিয়া আসেন ডাক্তারের কাছে যাইতাম!’ আমার ড্রাইভার চলে গিয়েছিল ছুটিতে।পাশের ফ্ল্যাটের জিয়া নামে এক ভদ্রলোকসহ হুজুরকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। হুজুর পায়ে থেরাপি দেবেন।
হাসপাতালে পৌঁছার পর হুজুর আমাকে বললেন আপনি বসে থাকবেন, যাবেন না। তখন ছিলো রমজান মাস। আমি হুজুরকে নিয়ে বাসায় এলাম। হুজুর আমিত্তি খুব পছন্দ করতেন! হাসপাতোলে যাওয়ার আগে বাসায় বলে গেলেন, ‘চৌধুরী সাহেব আমৃত্যু খাইবেন!’ [হুজুর দুষ্টুমি করে আমিত্তিকে আমৃত্যু বলতেন!] আমার জীবনে এটাই ছিল হুজুরের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের শেষ কথাবার্তা । সেদিন পুরো রাত গল্প হয়েছিল হুজুরের সঙ্গে। গল্প শেষ হয়েছিল সেহরির সময়! ফজর নামাজ পড়ে বাসায় এসেছিলাম আমি।
গাল-গল্পের ফাঁকে হুজুরকে নানান বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, হুজুর আপনার প্রিয় শিক্ষক কে ছিলেন? হুজুর বলেছিলেন, ‘শাইখুল ইসলাম হজরত হোসাইন আহমদ মাদানী রহমাতুল্লাহ আলাইহি।’ হুজুর নিজেই বললেন ‘কেন জানেন? কারণ হলো, মাদানী রহ. ছিলেন খুবই আশ্চার্য মনের মানুষ! এতো ব্রডমাইন্ডের মানুষ আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি!’ হুজুর বলতে লাগলেন, ‘আমি যখন দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াশোনা করি তখন পাকিস্তান আন্দোলন তুঙ্গে। স্বাভাবিকভাবে ছাত্ররা ছিলো পাকিস্তানের পক্ষে! আমরা লিফলেট ছেপে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম করি, স্লোগান দেই।
একদিন হজরত মাদানী রহ. আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উবায়দুল হক তুমি নাকি পাকিস্তানের সমর্থন করো?’ আমি তো ভয়ে অস্থির! যার সঙ্গে কথাই বলা যায় না, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আর যাই হোক তাকে তো আর মিথ্যা বলা যায় না! বললাম, জি হজরত। তিনি নিজের কথার উচ্চতা নিচু করে বললেন, ‘তুমি এই আন্দোলন করার আগে হজরত থানভী রহ.-এর কাছে বায়াত হও!’ আমি গেলাম না। সপ্তাহ না যেতেই হজরত আবার আমাকে ডেকে পাঠালেন।
আমি তো ভয়ে অস্থির! না জানি কি হয়? যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি থানাভন গিয়েছিলে?’ বললাম, না হুজুর! হজরত বললেন, ‘তুমি শিগগির যাবে।’ দু’তিন দিন পর আমি যখন থানাভনের পথে রওনা হলাম রেলস্টেশনে দেখি, কয়েকজন আলেম গড়াগড়ি করে কান্না করছেন! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হলো? তাদের একজন বললেন, হজরত থানবী ইন্তেকাল করেছেন! জানাজার পর ফিরে এলে মাদানী রহ. কে বললাম, হজরত আমিতো বায়াত হতে পারিনি। এখন কী করবো? হজরত বললেন, পড়াশোনায় মন দাও! অবাক করার বিষয় হলো, হজরত মাদানী রহ. কোন দিন আমাকে পাকিস্তান আন্দেলন বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেননি! আমি চেষ্টা করেছিলাম হজরত মাদানীর কাছে বায়াত হতে। কিন্তু হজরত চিঠি লিখে দিলেন আমাদের সিলেটের হযরত হাবিবুর রহমান শায়খে রায়পুরী’র রহ. কাছে!’
ওই রাতে আমি খতিব সাহেবকে জামায়াত প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম, আপনাকে অনেকেই জামাতের লোক হিসেবে জানে এবং জামায়াতের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে সমালোচনা করেন! হুজুর বললেন, ‘আমি আসলে শিবিরের ছেলেদেরকে কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করি কারণ হলো, তাদের আকিদায় সমস্যা আছে! তারা যদি আমাদের হক্কানি আলেমদের কাছাকাছি থাকে; তাহলে হয়তো আকিদাগত ভুল সম্পর্কে তাদের বোঝানো যাবে। এই একটা কারণেই আমি তাদেরকে কাছে রাখি বা তারা আমাকে ডাকলে আমি যাই।’
খতিব সাহেব অধ্যাপক গোলাম আযম সম্পর্কে বললেন, ‘একদিন গোলাম আযম সাহেব আমাকে একটি বই দিয়ে বললেন, হুজুর এটা পড়ে জানাবেন। আমি বললাম, ঠিক আছে। এক সপ্তাহ পর তিনি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর বইটা পড়েছেন? আমি বললাম, না পড়িনি। তিনি অনুরোধ করে বললেন, বইটা পড়ে অবশ্যই জানাবেন। আমি বললাম, আচ্ছা। কিছুদিন পর আবার ফোন দিলেন, পড়েছেন? আমি বললাম না! ক’দিন পর আবার ফোন দিলেন। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বইটি হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলাম এবং বললাম, পড়ে শেষ করবো! গোলাম আযম সাহেব আবারও বললেন, পড়ে আমাকে জানাবেন। বললাম, ঠিক আছে। বইটি শেষ করার দুই দিনের মাথায় আযম সাহেব নিজেই ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, পড়েছেন? বললাম হ্যাঁ পড়িয়াছি, কিন্তু বইয়ের নামকরণ ঠিক হয়নি! গোলাম আযম সাহেব বললেন কেন? বললাম, আপনি বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘ইকামতে দ্বীন’ বইয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল ‘লেকিন'(কিন্তু)!’
খতিব সাহেবকে বললাম, এটা বললেন কেন? হুজুর বললেন, ‘এই প্রশ্নটা গোলাম আযম সাহেবও আমাকে করেছিলেন! আমি তাকে বলেছি, আপনি বইটি খুব সুন্দর লিখেছেন। এ বইয়ে আপনি হজরত মাদানী রহ. সম্পর্কে ভালো আলোচনা করেছেন, পরে বলেছেন ‘কিন্তু’। তাবলীগ জামাত সম্পর্কে ভালো আলোচনা করেছেন, পরে বলেছেন কিন্তু! আমাদের অন্যান্য ইসলামী দলগুলো নিয়ে ভালো বলেছেন, পড়ে বলেছেন কিন্তু! এ জন্য আমি বইয়ের নাম দিয়েছি ‘লেকিন’ (কিন্তু)। এই লেকিন দিয়ে আপনি সব কিছুকে ছোট করে দিয়েছেন অধ্যাপক সাহেব!’
আমি হুজুরকে প্রশ্ন করেছিলাম, মাওলানা মওদুদীর সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছিলো আপনার? বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়েছে। আমি দেওবন্দ থেকে (১৯৪৯ সালে) এসে কিছুদিন ঢাকা বড় কাটারা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করি। গোলাম আযম সাহেবের নানার বাড়ি ছিল নারিন্দায়। এ সুবাদে তিনি বড় কাটারায় আসা-যাওয়া করতেন। তরুণ বয়স থেকেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি মাওলানা মওদুদী সাহেবের কয়েকটি বই দিয়েছিলেন পড়ার জন্য। তিনিই আমাকে জনাব মওদুদী’র সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মওদুদী সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মাওলানা আমার কোন বই আপনি পড়েছেন? আমি বলেছি, হ্যাঁ পড়েছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কেমন পড়লেন? আমি বললাম, ভালোই পেড়েছি। কিন্তু আপনার এসব বই পড়ে যুবসমাজ বেয়াদব হয়ে যাবে! তখন মিস্টার মওদুদী সাহেব আমাকে বললেন, আপনার দৃষ্টিতে যে যে সমস্যা চোখে পড়েছে সেগুলো আমাকে লিখে জানাবেন। আমার আর সেই সুযোগ হয়নি।’
খতিব সাহেব হুজুর রহ.-এর এ গুণটা সবচেয়ে বড় ছিল, তিনি মুখে মুখে কথা বলতে পারতেন। যেটা হক, হক বলতেন। যদি মিথ্যা হতো, মিথ্যাই বলে দিতেন। কাউকেই পরোয়া করতেন না!
এরপর খতিব সাহেব বললেন, ‘এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি সাঈদী সাহেবের সঙ্গেও কয়েকবার বসেছি। তিনি একমত হয়েছেন যে, এগুলো ভ্রান্ত!’ আমি মিসবাহুর রহমান চৌধুরী নিজের চোখে দেখেছি! ছাত্র শিবিরের ছেলেরা যখন মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাইফি সাহেবকে আক্রমণ করে রক্তাক্ত করেছিল; তখন একটা মীমাংসা বৈঠক হয়েছিল তার বাসায়। সেখানে মাওলানা সাঈদী সাহেব ছাত্র শিবিরের পক্ষ নিয়ে একটি রেফারেন্স দিয়েছিলো। হজরত খতিব সাহেব হুজুর সে দিন এমন রাগান্বিত হয়ে ছিলেন। এমন রাগ আমি কখনও তাকে করতে দেখিনি! তিনি বলেছিলেন, মাওলানা আপনি আমাকে তাফসির শিখাইতে আসবেন না! আপনি যেখান থেকে চামচ দিয়ে পানি খেয়েছেন; আমি সেখানে ডুব দিয়ে পানি খেয়েছি! কথা বলতে হুশ নিয়ে বলবেন। আমরা যদি মুখ খুলি আপনাদের অস্তিত্ব থাকবে না এ দেশে। সেদিন সাঈদী সাহেব চুপসে গিয়েছিলেন!