

মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম। একজন বজ্রকন্ঠের অধিকারী প্রতিবাদী নেতা । এদেশের প্রান্তে প্রান্তে দীনে ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তরুণ প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলছেন প্রখর ইসলামপ্রেমের দীক্ষায়। এই ভূখন্ডে যেখানে যখনই কোন অনৈসলামিক কার্যক্রমের আভাস মিলেছে শায়খে চরমোনাই মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম তখনই জোড়ালো কন্ঠে প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন__ রাজপথে নেমে এসেছেন। কাউকেই তিনি ছাড় দেননি। মুসলমানদের কাছে স্বীকৃত কাফেরগোষ্ঠি আহমদিয়া কাদিয়ানি জামাত নিয়েও তিনি দিয়েছেন কড়া হুঁশিয়ারি এবং বজ্রকন্ঠের হুংকার। এক কথায় বলে দিয়েছেন,
“গোলাম আহমদ কাদিয়ানি প্রতিষ্ঠিত অমুসলিম কাদিয়ানি সম্প্রদায় যখন যেখানে যে কোন সময় তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করবে… বাংলাদেশের নবীপ্রেমিরা, নবীর গোলামরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও তা প্রতিহত করবে। করবেই”।
এটি একটি সরল সহজ ঐতিহাসিক ঘোষণা__ যার কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। এক কথায়; তোমরা “এক পা আগাবে তো আমরা দু পা আগাবো” তোমরা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইজ্জত নিয়ে টান দেবে, মুসলমানদের ঈমান হরণে সিদ্ধহস্ত হবে আর আমরা বসে থাকবো_ বিষয়টি মোটেও তেমন না। আমরা তোমাদের প্রতিহত করতে প্রয়োজনে জান দেবো, জীবন দেবো।
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের তীব্র বিরোধিতা সত্বেও কাদিয়ানিরা থেমে নেই। সরলমনা মুসলমানদের ধোকা দিয়ে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা পঞ্চগড়ের আহমদনগরে কাদিয়ানিরা ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে কথিত ইজতেমা আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিল। তিন দিন সময়ও নিয়েছিল তারা ইজতেমা আয়োজনের। তাদের এ ঘোষণায় ফুঁসে উঠেছে তৌহিদী জনতা। তৌহিদী জনতাকে সঙ্গে নিয়ে হুংকার ছেড়েছেন শায়খে চরমোনাই মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম। ঈমান, আকিদা আর খতমে নবুওয়াতের মত একটি বিষয় নিয়ে কোন আপোষ হতে পারে না। কোন আপোষ করেননি তিনি। কাদিয়ানিদের এ কার্যক্রমের বিপক্ষে ঐতিহাসিক এক ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, “কাদিয়ানিদের কোন কার্যক্রম এ দেশে চলবে না, চলতে দেয়া হবে না”।
আরও পড়ুন : কাদিয়ানীদের ইজতেমা রুখতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে : মুফতি ফয়জুল করিম
গত ৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার কুড়িগ্রামে চরমোনাই মাহফিলের নমুনায় তিন দিন ব্যাপী মাহফিলের জুমার বয়ানে মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম এ ঘোষণা দেন। একই ঘোষণা আরো বৃহৎ পরিসরে তিনি চরমোনাই ফাল্গুনের মাহফিলেও দিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি তিনি। সোজা কথায় বলে দিয়েছেন, “কেউ নিজেকে মুসলমান দাবি করতে হলে কাদিয়ানিদের কোন কার্যক্রম সফল হতে দিতে পারে না” তিনি বলেছেন, কাদিয়ানিরা শর্তহীন ভাবে কাফেরগোষ্ঠি_ যারা তাদের কাফের মানবে না তারাও কাফের হবে। প্রতিটি মুসলমানের একান্ত ঈমানের দাবি হলো কাদিয়ানিদের প্রতিহত করতে হবে।
আরও : দীনের খন্ডিত ব্যাখা অনৈক্য সৃষ্টি করছে: মুফতী ফয়জুল করীম
কাদিয়ানিদের বিপক্ষে মুফতি ফয়জুল করীমের এই ঐতিহাসিক অবস্থান ইসলাম ও মুসলমানদের যোগ্য নেতা হিসেবে তো বটেই সাথে সাথে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত “লৌহ মানবীয়” ভূমিকাও বলা যায়। ইসলাম ও মুসলমান তো বুঝাই যায়_উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কিভাবে হলো তা জানতে একটু পেছনে যেতে হবে। যেতে হবে মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীমের পিতা এদেশের একজন আধ্যাত্মিক নেতা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এর জীবনের “কাদিয়ানি বিরোধী ভূমিকার” অধ্যয়ে।
সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. একজন মর্দে মুজাহিদ নেতা ছিলেন। তিনি তার জীবনের দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। যখনই যেখানে কাদিয়ানিদের কোন কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. সেখানেই কাদিয়ানিদের বিপক্ষে মাঠে-ময়দানে মুসলমানদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বন্ধ করে দিয়েছেন কাদিয়ানিদের অসংখ্য কার্যক্রম। একটু পেছন থেকে টেনে বললে দেখা যায়; ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে “আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজ খতমে নবুওয়াত”। এ সংগঠনে দল মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের আলেম ও পীর-মাশায়েখ ঐক্যবদ্ধ হন। হযরত পীর সাহেব চরমোনাই সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এ সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এ মর্দে মুজাহিদ আমরণ কাদিয়ানী ফিতনার বিরুদ্ধে জিহাদ, সংগ্রাম ও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। ১৯৯০, ১৯৯২, ১৯৯৪, ১৯৯৬ সালে কাদিয়ানীবিরোধী একাধিক মহাসমাবেশসহ খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের প্রতিটি সমাবেশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রসূল প্রেমিক এ মহান বুযুর্গ কাদিয়ানী ফিতনা নির্মূলে শাহাদাত বরণ করার জন্যও সদা প্রস্তুত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কাদিয়ানী ফিতনার মোকাবেলায় ছিলেন পাহাড়সম সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব। এসব কার্যক্রমে তিনি সফলও হয়েছেন দৃঢ়ভাবে। পীর সাহেব চরমোনাই (রহঃ) সহ এদেশের ওলামা-মাশায়েখের তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার ২০০৬ সালে কাদিয়ানীদের সকল প্রকার প্রকাশনা অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে লৌহমানবের ভূমিকায় থাকা এই মর্দে মুজাহিদের সন্তান মুফতী ফয়জুল করীম (শায়খে চরমোনাই) কাদিয়ানীদের বিপক্ষে বজ্রকন্ঠে প্রতিবাদী হুংকার দেয়া উত্তারাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বলাই যায়।
কাদিয়ানি জামাতের সারসংক্ষেপ :
‘কাদিয়ানিয়ত’ বা আহমদি কাদিয়ানি জামাতের ইতিহাস সেই আঠার শতকের শেষের দিকে তথা আজ থেকে প্রায় দেড় শত বছর আগের ইতিহাস। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার হাত থেকে ক্ষমতা যখন ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয় এটি তার পরের ইতিহাস। তখন সুচতুর ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে অখণ্ড ভারতের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। প্রায় ১৯০ বছর পর্যন্ত তারা ভারতীয়দের গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তারা স্বস্তিতে দেশ পরিচালনায় অপারগ ছিল। কারন স্বাধীনতাকামী মুসলিম বিপ্লবীরা আযাদী আন্দোলনে আপোষহীন ছিলেন। স্বাধীনচেতা রক্ত টগবগে বিপ্লবী মুজাহিদদের তখন কোনো মতেই দমন করা যাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় দখলদার ইংরেজ সরকারের পক্ষে নিজেদের ক্ষমতা টিকানো ছিল খুবই দুরূহ ব্যাপার। তাই তারা মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে ফাটল ধরানোর কৌশল খুঁজতে লাগল। ধূর্ত ইংরেজরা অবশেষে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলার ষড়যন্ত্রই পাকাপোক্ত করল। বেছে নিল শতাব্দীর নিকৃষ্টতম পন্থা। তাদেরই বংশবদ একজন পরীক্ষিত ও প্রশিক্ষিত অনুগত ব্যক্তিকে “নবী” হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার পন্থা।
এ ভয়ংকর পন্থায় নবীর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তাদেরই অনুগত পরিবার থেকে একজন গোলামকে বেছে নেয়া হল। যার নামও ছিল গোলাম। পুরো নাম গোলাম আহমদ। পিতা গোলাম মর্তুজা। তার বংশ ছিল মির্যা। ১৮৩৮ সালে জন্ম। তৎকালীন ভারতের (বর্তমান পাকিস্তানের) পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলার “কাদিয়ান” নামক গ্রামের বাসিন্দা। সেই দিকে নেসবত করে তাকে সংক্ষেপে “মির্যা কাদিয়ানী” বলে। বর্তমানে তার অনুসারিদেরকে “কাদিয়ানী বা আহমদি” বলে।
ইংরেজদের পালিত এই ভণ্ড গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কাদিয়ানী ফিতনা বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে এ ফিতনা গোটা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলে। এসময় সমগ্র আলমে ইসলামীতে এ ফিতনার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলনের ঝড় ওঠে। ফলে সৌদী আরব, কুয়েত, কাতার, ইয়ামেন, আরব আমিরাত, জর্দান, মালয়েশিয়া, ফিলিস্তিন, সুদানসহ বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে কাদিয়ানীদেরকে সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষণা করে “মুসলিম পরিচয়ে” তাদের যাবতীয় প্রকাশনা বন্ধ এবং সকল প্রকার প্রচারণা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সৌদী সরকার কাদিয়ানীদের জন্য পবিত্র হারামাইন শরীফাইনে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ধীরে ধীরে এ উপমহাদেশেও কাদিয়ানী ফিতনার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে ও তা তীব্রতর রূপ নেয়। ১৯৫৪ সালে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের আহ্বানে লক্ষ লক্ষ ইসলামী জনতা ও নবীপ্রেমিক কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে পাকিস্তানের রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এসময় জালিম শাহীর নির্দেশে পুলিশ ইসলামী জনতার মিছিলে উপর্যুপরি গুলী বর্ষণ করলে ১১ জন ধর্মপ্রাণ মুসল্লী শাহাদাত বরণ করেন। জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৭৪ সালে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
কাদিয়ানিরা সর্বসম্মতক্রমে একটি কাফের গোষ্ঠি। তারা মুসলমান পরিচয়ে সরল সহজ মুসলমানদের ধোকা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের নিয়ে ওলামায়ে কেরামসহ সবার এক কথা হলো_ তারা তাদের কার্যক্রম মুসলমান পরিচয়ে নয় বরং আলাদা ধর্মীয়গোষ্ঠি পরিচয়ে পালন করুক। তারা মুসলমান নয় এটাই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত তাই মুসলমানদের ধোকা দেয়ার কার্যক্রম তাদের পালন করতে দেয়া হবে না। করতে চাইলে মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাইর ঐতিহাসিক ঘোষণার বাস্তবায়ন হবে অক্ষরে অক্ষরে। এদেশের ইসলামপ্রেমী জনতা এমন শপথেই বলিয়ান হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র : সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. জীবনীগ্রন্থ (মুজাহিদ প্রকাশনী), উইকিপিডিয়া, markajomar.com.
পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীদের কথিত ইজতেমা বিষয়ে পাবলিক ভয়েসের রিপোর্টসমূহ
লেখা : হাছিব আর রহমান