
সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া
ইসলাম, দেশ ও জাতির স্বার্থে অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ভূমিকা রাখা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর জন্য নতুন কোন ঘটনা নয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে “ভারত ছাড়” আন্দোলন, ভাষা সংগ্রাম কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাসের সকল অধ্যায়ের সংকটে-সংগ্রামে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী রেখেছে গৌরব দীপ্ত ও দিক নির্দেশক ভূমিকা।
১৯৫৮ সালে সীমান্ত এলাকা পুনরুদ্ধারে মেজর তোফায়েল মোহাম্মদ ও জমাদার আযমের বীরত্বের ইতিহাস, গৌরবজনক শাহাদাতের সাক্ষী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রধান সড়ক টি. এ. রোড। শহরের পোস্ট অফিস মোড়ের তোফায়েল আযম মনুমেন্ট প্রতিদিন প্রতিক্ষণ সেই গৌরবজনক আত্মত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আইয়ূবের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে তৎকালীন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে “ফখরে বাঙ্গাল” মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ. এর জিহাদ ঘোষণা, স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মহান আত্মত্যাগ, সত্তর দশকের জুয়া – হাউজি – সার্কাস – যাত্রা – অশ্লীলতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে দেশব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীদের লাগাতার গঠনমূলক ভূমিকা, ৯৪ -এর নাস্তিক বিরোধী আন্দোলন, ৯৮ সনে এনজিও এর আঞ্চলিক সমাবেশে যুবতীদের উদোম নৃত্যের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সোচ্চার করতে এবং গণসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর অবদান তাৎপর্যপূর্ণ।
ব্রিটিশ আমল থেকেই কোনরূপ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এলাকার মানুষের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে গড়ে উঠেছে অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, উপকৃত হচ্ছে এলাকার জনগণ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে আলেম ওলামাদের রয়েছে সন্মানজনক ভূমিকা এবং অবদান। গ্রামে – গঞ্জে, পাড়ায় – পাড়ায় শহরের বিভিন্ন অলি গলিতে কোরআনের তাফসির মাহফিলের আয়োজন ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির নজীরবিহীন এক দৃষ্টান্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ইসলামের পুনর্জাগরণকে ঠেকিয়ে রাখার অর্থহীন প্রচেষ্টা, মুসলিম জাতীয়তাবোধকে দমনের জন্য শাসকগোষ্ঠীর উন্মত্ত ও বর্বর আচরণ জন্ম দিয়েছিল ৬ই ফেব্রুয়ারীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্র্যাজেডির।
লোমহর্ষক, অমানবিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্র্যাজেডির দিকে সত্যসন্ধ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালে যে কোন চক্ষুষ্মান ব্যক্তিই দেখতে পাবেন, এর মূলে রয়েছে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক ও অন্য দুজন আবেদনকারীর রিট আবেদন (নং৫৮৯৭-২০০০) এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হাইকোর্টের মাননীয় দুজন বিচারপতি একটি রায়।
বিজ্ঞ বিচারপতি মুহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানা ২০০১ সালের ১ জানুয়ারী উপর্যুক্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে ইসলামের সব ধরণের ফতোয়াকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে এই অনাকাঙ্ক্ষিত রায় শুধু বিস্ময়ই নয় নিদারুণ ক্ষোভেরও সৃষ্টি করে। ফলে রায় ঘোষণার সাথে সাথেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম দেশের ইসলাম প্রেমিক তৌহিদী জনতা উলামা – মাশায়েখের নেতৃত্বে নেমে আসে রাজপথে। শুরু হয় এই রায় বাতিলের দাবীতে প্রতিবাদ, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ও হরতালের কর্মসূচি।
এ কথা লেখাই বাহুল্য যে, মুসলমান মাত্রকেই কুরআন সুন্নাহ, নবী রসূলকে মানতে হবে। কোন মুসলমানই ফতোয়াকে বাদ দিয়ে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করতে পারে না। ফতোয়া শব্দটি ফাতা শব্দ থেকে উৎপত্তি, অর্থ সরলীকরণ বা ব্যাখ্যা। পার্থিব জীবনে উদ্ভূত যে কোন প্রশ্নের কোরআন সুন্নাহর আলোকে সমাধানই হচ্ছে ফতোয়া। যিনি ফতোয়া দেন তাকে মুফতি বলে আর মুফতিকে অবশ্যই ফকীহ হতে হবে।
একজন মুফতির দায়িত্ব হচ্ছে প্রশ্নকারীকে শরীয়তের হুকুম আহকাম ও আইন সম্পর্কে অবগত ও অবহিত করা।ফতোয়ার মাধ্যমেই ইসলামী আইনের বহিঃপ্রকাশ প্রচার ও প্রসার ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে বিশ্ব মানবতার মু্ক্তির দূত সমাজ সংস্কারক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নব্যুয়ত প্রাপ্তির পর থেকে এর সূচনা এবং এর ক্রমবিকাশের ধারা আজও বিস্তৃত এবং অব্যাহত। দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতে মুক্তির জন্য কোন পথে মানুষের কল্যাণ – অকল্যাণ, কোনটা হালাল কোনটা হারাম এসব দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্যই আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে পাঠিয়েছিলেন। মানুষ তাদের জীবন চলার উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মহানবী সাঃ এর কাছে হাজির হতেন। তিনি শুনতেন এবং ফতোয়া প্রদান করতেন। অতপর মুহাম্মদ (সাঃ) তার যোগ্য অনুসারী সাহাবীগণকে এই সুমহান দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।
খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পর ইসলামী সম্রাজ্যের বিস্তৃতির ফলে নিত্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং সংকলনের চাহিদাও প্রকট হয়। ইমাম আবু হানিফা রহঃ সর্ব প্রথম ফিকাহ্ শাস্রকে স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে গবেষণা, সংকলন ও শিক্ষার গোড়াপত্তন করেন।
তাঁর চেষ্টা, মেধা এবং শ্রম দিয়ে একদল যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করে গেছেন। তারাও যুগ যুগান্তরের ইতিহাসে স্বরনীয় এবং বরণীয়। সে পথ ধরে এদের যোগ্য উত্তরসূরীগণকে ফতোয়া প্রদানের মত মহান দায়িত্ব আপোষহীন ভাবে পালন করে যাচ্ছেন। মুসলমানদের প্রয়োজনের তাগিদেই ফতোয়া ছিল, আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
এই তো পাঁচ ছ’শ বছর আগে পাক-ভারতের মুগল কোর্টে কাজীগণ ফতোয়া দিতেন। এমনকি ব্রিটিশ ভারতের আদালত গুলোতেও মুসলিম আইন ব্যাখ্যা করার জন্য একজন মুফতি থাকতেন। এ সংক্রান্ত মামলায় বিচারক রায় দেবার পূর্বে মুফতির পরামর্শ বা ফতোয়া চাইতেন। আসলে ফতোয়া হচ্ছে এক ধরণের পরামর্শ যার ভিত্তি হচ্ছে কুরআন ও শরিয়া। প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য যে কেবল ইসলাম ধর্মেই নয় সব ধর্মেই ফতোয়ার বিধান রয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন বা রীতিনীতি সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা বা পরামর্শ চাইতে মুসলমান যান মুফতির কাছে, হিন্দুরা যান ব্রাহ্মণ শাস্রবিদ বা গুরুদেবের কাছে, খ্রিষ্টানরা যান পাদ্রী, পোপ বা পোপের প্রতিনিধির কাছে। ধর্মীয় অনুশাসন বা বিধি বিধানের ব্যাখ্যা কোর্ট দেবেন কি ভাবে?
কিন্তু সেদিন ধর্মীয় অনুশাসন বা বিধি বিধানের ব্যাখ্যা ফতোয়াকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল বিচারপতিদ্বয়।
এরপর থেকে জাতীয় দৈনিক গুলোতে দেশের শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবীদদের প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় সম্পর্কে।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহঃ বলেন,
“ফতোয়া অ-অনুমোদিত ও অবৈধ ঘোষণা করার কোন ক্ষমতা এই দুই বিচারকের নেই। তাদের দেয়া ঐ রায় কোরআন হাদীসের বিপক্ষে। কোরআন হাদিসের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কেউ বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি।
(৫ জানুয়ারী ২০০১- দৈনিক মানবজমিন)
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহঃ বলেন,
“হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণের রায় দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণকে আহত করেছে। এই রায় বাংলাদেশের হাইকোর্টের মর্যাদা ও ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধকে আহত করেছে। মুসলিম দেশ হিসাবে বহিঃর্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
(৫ জানুয়ারী ২০০১- দৈনিক ইনকিলাব)
মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম, পীর সাহেব চরমোনাই রহঃ বলেন,
“ইসলাম ধর্মটাই নির্ভর করে ফতোয়ার উপর। ইসলাম তো হাইকোর্টের ওপর নাজিল হয়নি যে, হাইকোর্টের রায় নিয়ে ইসলাম পালন করতে হবে। ইসলামী শরিয়ত দ্ধারাই ফতোয়া নিয়ন্ত্রিত হবে। ফতোয়াকে শাস্তিযোগ্য বলা অপরাধ। একে প্রতিহত করার জন্য কাউকে নির্দেশ দেয়া আরও বড় অপরাধ। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের কোথাও ধর্মের মৌলিক বিষয় নিয়ে আদালত কর্তৃক এহেন রায় প্রদানের দৃষ্টান্ত নেই। বরং ইহুদী খ্রিষ্টানদের দেশ ইউরোপে ধর্মের প্রতি অবমাননাকর বিষয় ও বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য “ব্লাসফেমী” আইন রয়েছে।”
(৬ জানুয়ারী ২০০১- দৈনিক ইনকিলাব)
খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক রহঃ বলেন,
“সব ধরণের ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় ভয়ংকর এবং ইসলাম বিধ্বংসী। অবিলম্বে এই রায় প্রত্যাহার করে নিতে হবে। রায় দানকারী দুই বিচারপতিকে তওবা করতে হবে।”
২০০১ সালের পহেলা জানুয়ারী ফতোয়া সম্পর্কে হাইকোর্টের রায়ের পর পরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ সারা দেশ অশান্ত হয়ে পড়ে, প্রায় প্রতিদিনই চলতে থাকে মিছিল – মিটিং, মসজিদে মসজিদে খুৎবা, আলোচনা, পর্যালোচনা। ২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের প্রতিবাদে শুক্রবার ওলামা মাশায়েখ ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে মহা সমাবেশের ডাক দেয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ পল্টন ময়দানে সমবেত হতে থাকে। দুপুর ১২টায় মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহঃ এর সভাপতিত্বে সমাবেশ শুরু হয়। জুম্মার পর ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সংক্ষিপ্ত সময়ে আয়োজিত এ সমাবেশের উপস্থিতি ছিল বিশল। সমাবেশে ৬ দফা ঘোষণা পাঠ করেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহঃ।
সমাবেশে বলা হয় ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে। জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার উপক্রম। ১৯৬১ সালে আইয়ূব খান কর্তৃক প্রবর্তিত শরীয়ত বিরোধী মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিলের দাবী জানানো হয়। শেখ মুজিবের ছবি ও প্রতিকৃতি সরকারী বেসরকারি সকল অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থাপনের জন্য সংসদে যে আইন পাশ করা হয়েছে তা মান্য করা শরীয়ত সম্মত নয়। শরীয়ত বিরোধী এই আইন রদ করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধের ষড়যন্ত্র বন্ধ ও দ্বীনি শিক্ষা এবং শরীয়তের আইন বাস্তবায়নের দাবী জানানো হয়।
সমাবেশ থেকে পরদিন শনিবার বৃহত্তর ঢাকায় সকাল – সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়, বিভিন্ন বিভাগে লংমার্চ, পরবর্তী বুধবার জেলা – উপজেলায় ডিসি ও টি.এন.ও কে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি এবং ১লা এপ্রিল ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়।
এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর নূর মসজিদে ঘটে এক পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।
হরতাল চলাকালে পুলিশ কনস্টেবল বাদশা মিয়াকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সরকার এবং তার প্রভাবাধীন প্রচার মাধ্যম গুলোতে উগ্রভাবে প্রচারণা চালাতে থাকে যে মৌলবাদীরা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য ব্যবহৃত লিল্লাহ বোর্ডিং এর ছুরি – চাকুকে বিটিভি ও ইটিভিতে প্রচার করা হয় বিকৃত ভাবে। ঐ দিন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহঃ সহ আরো ৬৫ জন আলেমকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
৪ ফেব্রুয়ারি রবিবার গ্রেফতারের খবর শোনা মাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাজার হাজার জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। মিছিল, শ্লোগানে মিছিলে প্রকম্পিত গোটা শহর। তৌহিদী জনতার উত্তাল আন্দোলনে টান টান উত্তেজনা বিরাজমান। ঢাকায় মাদ্রাসা ছাত্রদের উপর পুলিশের হিংস্র আক্রমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিস্থিতি কে আরো উত্তপ্ত করে। ঐ দিন রংপুর থেকে ফেরার পথে পুলিশ অতিশীপর বৃদ্ধ শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহঃ, মুফতি ইজহারুল ইসলাম এবং এ,আর,এম আব্দুল মতিনকে গভীর রাতে ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈর এলাকার চন্দ্রা মোড় থেকে গ্রেফতার করে।
৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী আল্লামা আজিজুল হক ও মুফতি আমিনী রহঃ সহ গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার জনতা টি.এ.রোডে, রেলগেইট থেকে ফকিরাপুল ব্রীজ পর্যন্ত অবস্থান নেয়।
এই মিছিল ছিল সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি এবং মুসলমানদের জোশ ও জজবার মহড়া। সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর অঘোষিত রাজপথ রেলপথ অবরোধ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং নজীরবিহীন। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর নেতৃত্বে ছিলেন তাদের ভালবাসা ও সন্মানের পত্র “বড় হুজুর”। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নিউজ মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও “বড় হুজুর”। আল্লামা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর রহঃ পরের দিনের কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য ষোল সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি আলাপ আলোচনার পর জনতাকে শান্তিপূর্ণভাবে ঘরে ফিরে যেতে আহবান জানায় এবং পরের দিন ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় “তাসবিহ হাতে জিকিরের সাথে” শান্তিপূর্ণভাবে স্ব স্ব অবস্থান থেকে হরতাল পালনের আহবান জানান।
২০০১ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি…
হরতাল। নীরব নিস্তব্ধ গোটা শহর। দোকান – পাট খোলেনি। গাড়ির চাকা ঘোরেনি। অফিস আদালত, স্কুল কলেজ সম্পূর্ণ বন্ধ। স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হচ্ছে সর্বত্র। নেই কোন প্রতিবন্ধকতা, সংঘাত – সংঘর্ষ। নীরবতা ভেঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে খন্ড খন্ড জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিল।
শহরের প্রধান প্রধান মোড় গুলোতে পিকেটিং চলছে। এদিকে টহলরত পুলিশ ভ্যান আতংক সৃষ্টির লক্ষ্যে ফজরের নামাজের পর থেকেই পথে পথে দাড়ি – টুপিওয়ালা যাকে যেখানে পেয়েছে টেনে হিচঁড়ে ভ্যানে তোলে। কাউতলী, পৈরতলা, বিরাসার, ঘাটুরা, গোকর্ণঘাট এবং পীরবাড়ীর মোড় থেকে শত শত শহরবাসীকে বন্দী করা হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তাসবীহ হাতে জিকিররত তৌহিদী জনতা ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার সামনে ১০টার দিকে জড়ো হতে থাকে। ঠিক সাড়ে ১০টার দিকে আলেম ওলামাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক টি.এ. রোড অতিক্রম করে রেল স্টেশন রোডের দিকে গিয়ে মিছিলটি স্টেশন চত্বর থেকে ঘুরে আবার শহরে যাচ্ছিল। কিন্তু জেলা পরিষদ মার্কেটের দক্ষিণ প্রান্তে রেলগেইটের কাছে বিডিআর বাহিনী এক অভিনব পদ্ধতিতে লাল ব্যানার ঝুলিয়ে রাখে যাতে সাদা কালিতে লেখা ছিল, “সাদা রেখা অতিক্রম করলে গুলি করা হবে”।
সচেতন মহলের প্রশ্ন ছিল কার্ফু কিংবা ১৪৪ ধারা জারী করা ছাড়াই রেলগেইটের কাছাকাছি আসলে গুলি করার পরিকল্পনা কি পূর্ব থেকেই ছিল?
এ সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিল?
কেন নিয়েছিল?
মিছিলটি কালীবাড়ীর মোড় হয়ে বাটারফ্লাই কোম্পানির শোরুমের বরাবর আসলে দাঙ্গা পুলিশ মিছিলটি ঘিরে ফেলে এবং মিছিলের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন মিছিলটি আরো পিছনের দিকে ফিরিয়ে আনে। এসময় জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট মিছিলে গুলি করার জন্য লিখিত অনুমতি দিয়ে দেয়।
তারপরই বিডিআর বাহিনী কোনরূপ পূর্ব সতর্কীকরণ ছাড়াই নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। মুহূর্তের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাজুল ইসলাম সহ আরো অনেকে সড়কের উপর লুটিয়ে পড়েন।
ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বোরচিত ঘটনা। একটানা চলতে থাকে টা-টা-টা শব্দ। শহরের প্রধান সড়ক টি.এ.রোডে চলে কয়েক ঘন্টা ব্যাপী নারকীয় তান্ডব।
কি প্রতিরোধ? কোথায় প্রতিরোধ? আক্রমন তো শুধুই একতরফা। সকাল ১১টায় কালীবাড়ীর মোড়ে একটি বুলেট এফোর ওফোর করে দেয় শহীদ আলাউদ্দিনের তলপেট। একই সময়ে পাওয়ার হাউজ রোডের ছাত্রাবাসের সামনে বুলেটের নির্মম শিকার হন শহীদ সুজন। তার লাশ সেখান থেকে প্রায় দু’শ গজ রাস্তা টেনে হিচঁড়ে কালীবাড়ীর মোড়ে এনে পুলিশের ভ্যানে তোলা হয়।
কাউতলী মোড়ে ঝড়ে পড়ে আরেকটি তাজা প্রাণ শহীদ হাফেজ সাইফুল ইসলাম। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শহীদানের সংখ্যা, শহীদ তাজুল ইসলাম, শহীদ মুহাম্মদ ওসমান ও শহীদ মুখলেছুর রহমানকেও নির্মম ভাবে শহীদ করা হয়।
বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলতে থাকে থেমে থেমে গুলির শব্দ আর মটারের আওয়াজ। গুলিবিদ্ধ ছাত্র জনতাকে ধরাধরি করে কিংবা পাঁজাকোলে করে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে। সেখানে এক বিভিষীকাময় অবস্থা। ডাক্তার নেই, ঔষধ নেই, এম্বুলেন্স অকেজো। লাশ পড়ে আছে মর্গে। আহতরা ভুগছে এক কঠিন নিরাপত্তাহীনতায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সংকটাপন্ন হচ্ছে আহতদের জীবন। স্বজনরা রক্তের সন্ধানে হন্য হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিকরাও রেহাই পাননি পুলিশ – বি.ডি.আর এর আক্রমন থেকে। ঢাকা থেকে আগত ফটোসাংবাদিকদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার ডকুমেন্ট গুলো নষ্ট করে দেয়া হয়। টিএ রোডে একজন সাংবাদিক ভিডিও করছিলেন এই ধ্বংসযজ্ঞের, বিডিআর সেই ক্যাসেটের ফিতাও ছিড়ে ফেলেন প্রকাশ্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা শহর এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলি রক্তস্রোতে প্লাবিত। কান্নার রোল ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র। একটি আতংকিত শিহরণে ছটফট করছে গোটা জনপদ। ৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে লাশ বুঝে নিয়ে যাওয়া হল ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে।
তারপর জিকিরের সাথে শহীদি মিছিল চলে গেল জেলা ঈদগাহ ময়দানে। শহীদদের লাশ ঈদগাহ ময়দানে পৌছা মাত্র ইসলাম প্রিয় জনতার ঢল নামে। ঈদগাহ ময়দান লোকে লোকারণ্য।
ফতোয়া রক্ষার জিহাদে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন তারা হলেন,
শহীদ হাফেজ সাইফুল ইসলাম
শহীদ তাজুল ইসলাম
শহীদ আলাউদ্দিন
শহীদ মুহাম্মদ ওসমান
শহীদ মুখলেছুর রহমান
ও শহীদ সুজন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গুলিবিদ্ধ ৭ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুরুতর আহত হন ২৬ জন। এবং কর্তব্যরত ৫ জন সাংবাদিকও সেদিন আহত হন। কারারুদ্ধ হয়েছিল ৩৬ জন।
৬ ই ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্বরণে ও নৃশংস এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে এবং গ্রেফতারকৃত তৌহিদী জনতার মুক্তির দাবীতে থমথমে পরিবেশে ৮ ই ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর ২ টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর মুক্তমঞ্চে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসভা।
ভয়, আতঙ্ক, প্রশাসনের হয়রানি এবং শ্যেন দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে জনতার উত্তাল তরঙ্গ থেকে ভেসে আসে আল্লাহু আকবার ধ্বনি। শুধু শোক নয় প্রতিবাদ প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল সবার অন্তরে। শহীদের লাল রক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর ঈমানী চেতনায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
পৌর মুক্তমঞ্চ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উপচে পড়া জনতা অবস্থান নেয় রাস্তায়। পৌর মুক্তমঞ্চের জনসভায় উপস্থিত হন পীর সাহেব চরমোনাই রহঃ। ঐ জনসভায় প্রত্যেক শহিদের পরিবারকে নগদ ১০ হাজার টাকা করে দেন। পরে বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আমীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিম, পীর সাহেব চরমোনাই (রহঃ) “ব্রাহ্মণবাড়িয়া কে শহিদবাড়িয়া হিসেবে নামকরণের ষোষণা দেন”। এরপর থেকে ৬ শহীদের ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শহীদবাড়িয়া করার জোর দাবি ওঠে দল মত নির্বিশেষে সর্ব মহলে। সেসময় অনেক দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তোরা সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থলে শহিদবাড়িয়া লেখা শুরু হয়ে যায়।
ইসলামের জন্য শহীদবাড়িয়ার তৌহিদী জনতার বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস স্বরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে। নিরন্তর অপব্যাখ্যা ও তথ্যসন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশবাসীকে ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ৬ই ফেব্রুয়ারি ফতোয়া বিরোধী আন্দোলনে শহিদবাড়িয়ার দুঃসাহসী তরুণদের আত্মদানের বীরোচিত কাহিনী অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চির অম্লান।
-লেখক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মী