
এক.
চন্দ্র বর্ষের প্রথম দিনটিকে চীনারা নববর্ষ হিসেবে পালন করে থাকে। এই উৎসবকে বলা হয় ‘চুন জি’। চীনারা তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে। চিনাদের জন্য নতুন বছর আসলে কোন তারিখ থেকে শুরু হবে এর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কারণ এই তারিখ প্রতি বছর পরিবর্তন হয়!বর্ষপঞ্জি অনুসারে এ বছর ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ থেকে চীনাদের নতুন বছর শুরু হচ্ছে। চীনাদের নববর্ষ আর বসন্ত দুটোই আগমন হয় একই সময়ে।
চায়নিজ নিউ ইয়ার উৎসব মূলত বছরের শেষ মাসে ক্রিসমাস উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায়, বাকী থাকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা। ক্রমান্বয়ে সেই উৎসবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চায়নিজদের মাঝেও। নতুন বছরকে তারা একেক বছর একেকটি প্রাণীর নামে নামকরণ করে থাকে। নির্দিষ্ট ১২টি প্রাণীর নাম ঘুরেফিরে রাখা হয় একেক বছর। এ বছরকে চীনা ক্যালেন্ডার মতে চায়নিজ নিউ ইয়ার আসছে (Earth Pig) শুকর বর্ষ হিসেবে। বাকি ১১টি প্রাণী হচ্ছে: ইঁদুর ষাঁড়, বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ভেড়া মোরগ, কুকুর এবং ভাল্লুক।
দুই.
যে দেশ গুলো চায় তারা বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করবে তারা সর্বপ্রথম যে জিনিসটা ডেভেলপ করে তা হলে কালচার। কালচার হলো এমন একটি জিনিস সেটার মাধ্যমে একটি জাতিকে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য পৌঁছাতে প্রবল ভাবে সাহায্য করে। যে কোন জাতিকে নিয়ন্ত্রন করতে কালচার বড় ধরনের ভুমিকা রাখে। আর বর্তমান বিশ্বে চায়না দিন দিন খুবই অগ্রসরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ কারে তার কালচারকে বুকে আগলে রাখে। বিশ্বের যে যে প্রান্তে চায়নিজ আছে তারা এই চায়নিজ নিউ ইয়ারসহ তাদের নিজস্ব বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল পালন করে থাকে।
এই ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে তারা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ঘুরে আসে। বছরের অন্য দিন গুলোতে তারা কাজ নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করে। আর এই কাজের সময় তারা অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেয় না।
চায়নিজদের ধর্ম বলতে এখনো কিছুই পাইনি! তারা রাষ্ট্রীয় ভাবেই ধর্মহীন। আমি অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি আপনার ধর্ম কী? শুধু আমার এক ম্যাডাম বলেছিলেন সে খিষ্ট্রান ধর্মকে পছন্দ করেন কিন্তু সে কোন ধর্মের সেটা বলতে পারেননি। তাছাড়া যতজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অনেকেই ধর্মের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা! সুতরাং তাদের কোনো ধর্মীয় উৎসব পালন করার মানেই হয় না। এক কথায় তাদের কোনো ধর্মীয় উৎসব নেই।
তিন.
আমি যখন প্রথম আমার ইউনিভার্সিটিতে পা রাখলাম তখন থেকে কেমন যেনো একা একা লাগা শুরু করল। আমি বড় হয়েছি একটি মুসলিম দেশে কিন্তু এখন এসে পড়লাম একটা ধর্মহীন দেশে। খানিকটা ভেবে নিজেকে সামলে নিলাম। খাপ খাইয়ে নিলাম সব কিছুকে।
কিন্তু আমি বাঙালি। আমার কিছু নিজস্ব কালচার আছে যা আমার পূর্ব পুরুষদের থেকে পেয়ে এসেছি। আমার দেশ আমাকে কিছু কালচার দিয়েছে যা আমার রক্তমাংসের সাথে মিশে গিয়েছে। যা আমি লালন করে আমার সমাজ পরিবেশ ও দেশের পরিচয় বহন করছি। যদি আমি কালচার কে ভুলে যাই তাহলে আমি মনে করি আমার অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলবো
চার.
ইউনিভার্সিটিতে আসার পর আমার কাছ থেকে যে হলফনামা নিয়েছিল সেখানে লেখা ছিল আমি তাদের কালচারকে মেনে নিব, শ্রদ্ধা করব এবং তাদের কালচারে নিজেকে অভ্যস্ত করব। আমার কালচার তারাও গ্রহন করবে কিনা সেটা পরিস্কার ছিল না কিন্তু কালচার এক্সচেঞ্জ করে দেশ কে ডেভলাপ করব।
প্রথম দিনের একটা অভিজ্ঞতা বলি- আমাদের ফরেনার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভার্সিটির এক ম্যাডাম একটা ব্রিফিং দিলেন। তিনি কালচার ডেভলপমেন্টের কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তোমাকে বলছি! আমাদের দেশের পোশাকের সাথে তোমার পোশাক এডজাস্ট করতে হবে। তোমার এই লম্বা পোশাকে আমরা দেখতে চাইনা। এছাড়াও তাদের কালচার বিষয়ে আরো অনেক দিক নির্দেশনা দিয়েছিল আমি তখন বললাম আমি মুসলিম দেশের একজন নাগরিক। আমার দেশ গনতন্ত্রে বিশ্বাস করে কিন্তু আমাকে আমার পোশাক চয়েজ এর ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে এমনকি আমার দেশ অন্য ধর্মের মানুষদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে। আমি ছোট থেকে এই কালচারে বড় হয়েছি তাই আমি এই পোশাক ত্যাগ করতে পারব না।
আপনিই তো বললেন কালচার এক্সচেঞ্জ করে আপনারা দেশ ডেভেলপ করতে চান। তাহলে আমি কেনো আমার কালচার নিয়ে আমি এখানে থাকতে পারব না? আমি তো আপনার কালচারকে ছোট করছি না। বরং শ্রদ্ধা আর ভালোবেসেই আপনার দেশে অতিথি হিসাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লেখাপড়া করতে এসেছি। আপনার কি মনে হয় নি আমার কালচারে আঘাত পড়ছে? তিনি চুপ করে গেলেন। আমি বিষয়টা বুঝতে পেরে বললাম মাই ডিয়ার ম্যাডাম! আই ইউল বি ট্রাই….
আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সব ফরেনারদের চায়নিজ নাম দিয়ে ডাকে কিন্তু তিনি আজো আমার মাজিদ নাম ধরেই ডাকেন! হয়তো তিনি কিছু বুঝতে পেরেছেন। কি বুঝতে পেরেছেন আশা করি পাঠকরাও বুঝবেন।
পাঁচ.
দড়ি বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যা অবস্থা হয় তা সবারই জনা। বিদেশ মানে কারো কাছে উন্মুক্ত স্থান। কারো কাছে নিজের আদর্শ কে প্রতিষ্ঠিত করার এক উর্বর ভূমি।
আমার দেখা অনেক উদাহরণ আছে যে বিভিন্ন দেশের মেয়েরা এসে এখানে নিজের কালচার কে বিলীন করে আজ তারা নাইট ক্লাবের এক নম্বর তারকা!
কিন্তু আমার বুক ফেটে যায় তখন! যখন দেখি আমার দেশের কোনো ছেলে মেয়ে এখানে এসে তার ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে এই সাময়িক সময়ে একটি ভিনদেশের সম্পূর্ণ অপরিচিত কালচার আপন করে নিয়েছে এবং নিজের কালচার ভুলে গেছে । যেমন প্রতি উইকেন্ডে নাইট ক্লাবে যাওয়া। দেশি বিদেশী রমণীদের সাথে আনন্দ ফূর্তিতে মেতে থাকা। বাবার কষ্টের টাকায় আরো সব ভিনদেশী ও কালচার কিনে নেয়া অনেকে তো মদ খাওয়া থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যা করে না আধুনিকতার নামে গার্লফ্রেন্ডের সাথে সারারাত মাস্তিতে ভরপুর থাকে! দেখা যায় পরের দিন ক্লাসে দেরি করে আসে আর টিচারদের সেই কথা টা সত্য হয়ে যায়- উই ক্যান ডেভেলপ ইয়োর ক্যান্ট্রি ইনটু এক্সচেঞ্জ অব ইউর কালচার!
তখন খুব খারাপ লাগে এই কালচার এক্সচেঞ্জ করতে গেয়ে আমার প্রান প্রিয় বন্ধুরা নিজেরাই আনকালচারের নিম্ন দেশে চলে যাচ্ছে। যে সমাজ তোমাকে বড় করল সে সমাজে আজ তুমি ঘৃণিত! আজ তুমি করুণার প্রাত্র হিসাবে পরিনত হচ্ছো। একবার ভেবে দেখছো কি?
ছয়.
আমি চাই! কালচার ডেভেলপ হবে কিন্তু কোনো জাতির সম্পূর্ণ কালচার কখনোই গ্রহণ করে নেয়া যেতে পারে না।
বাংলাদেশের নিজস্ব কালচার আছে। মুসলিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে আছে।
আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে পবিত্র কুরআনুল কারিম দিয়েছেন এই পবিত্র গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন সকল কালচারের সেরা কালচার। শুধু লিপিবদ্ধ করেই ক্ষান্ত হননি বরং ইসলামের এই কালচার প্রচারে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে “প্রাক্টিক্যাল ম্যান” হিসাবে গোটা পৃথিবীর কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন একটি জাতি কিভাবে নিজেদের আদর্শ ঐতিহ্য রক্ষা করে চলতে পারে। আমরা সেই জাতি যাদের ইতিহাসের মাঝে কোন গ্যাপ নেই। নেই কোনো মিথ্যাচার। আমাদের ইতিহাস গর্বের আনন্দের এবং প্রাপ্তির।
আমি মনে করি বাঙ্গালীরাও কালচার ডেভেলপ করবে কিন্তু তার নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্যকে ভুলে নয় বরং দেশ ধর্ম বুকে লালন করে তবেই দেশকে উন্নত করবে। কালচার ডেভেলপের নামে ভিনদেশী আদর্শ এবং তাদের কালচার অনুষঙ্গ আমাদের গেলানোর প্রয়োজন নেই আমাদের যথেষ্ঠ পরিমান নিজস্ব কালচার রয়েছে। আজ যা শুধু পরিচর্যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শত শত বছরের সেই ঐতিহ্য এবং আদর্শ।
লেখক : মাজিদুল হক। শিক্ষার্থী, সফটওয়্যার টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট, চানজু ইউনিভার্সিটি, চায়না।