

আমিন ইকবাল
শুরু হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯। গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিকে স্মরণ এবং সারাদেশে বাংলা ভাষার সৃজনশীল ধারাকে ছড়িয়ে দিতে বাংলা একাডেমি নিয়মিতভাবে আয়োজন করে মেলাটির।
মাসব্যাপী এ মেলা বইপ্রেমীদের প্রাণের স্পন্দন যোগায়। সৃজনশীলতায় ফুটে ওঠে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই বইপ্রেমীদের প্রাণে উচ্ছ্বাস নামে; আনন্দ-উল্লাসে ছুটে আসে বইমেলায়।
শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-বৃদ্ধ—সবাই আসে প্রাণের মেলায়। লাখো পাঠকের পদচারণায় ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে মুখরিত থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে—অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন। যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের উপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন।
আরও পড়ুন- উপজেলা নির্বাচন, কী করবে ইসলামপন্থীরা?
৩২টি বই-ই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হন।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতাও চিত্তরঞ্জন। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন করেন।
১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়—লেখক পাঠক ও প্রকাশকদের দাবির প্রেক্ষিতে।
বইমেলায় প্রকাশনীর স্টলগুলো প্রকাশক এলাকা, প্রকাশক-বিক্রেতা এলাকা, শিশুকর্নার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি এলাকায় বিভাজন করে স্থান দেয়া হয়। এছাড়া মেলা চত্বরকে ভাষা শহিদ—সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নামে ভাগ করা হয়।
এ মেলায় দেশের খ্যাতনামা (!) প্রকাশনী অংশগ্রহণ করে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারেরও বহু রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান, যেমন—বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ইত্যাদি স্টল নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়। মেলায় ইদানীং বিভিন্ন ডিজিটাল প্রকাশনা যেমন—সিডি, ডিভিডি ইত্যাদিও স্থান করে নিয়েছে। বেশ জনপ্রিয়তার সঙ্গে জায়গা নিয়ে আছে লিটল ম্যাগাজিনও।
তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালির প্রাণের মেলায় বিশাল আয়োজনের ভিড়ে অত্যন্ত সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয় ইসলামকে! উপেক্ষা করা হয় ইসলামি প্রকাশনা, ধর্মীয় লেখক, কবি, সাহিত্যিক ও গবেষকদের। নামমাত্র দু’চারটি ইসলামি প্রকাশনা মেলায় সুযোগ পেলেও বঞ্চিত হয় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নামিদামি অনেক ধর্মীয় প্রকাশনা। যেসব প্রকাশনী রাজধানীর বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন প্রান্তে বসে প্রতিনিয়ত মুসলিম পাঠকের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
এ কথা জোর দিয়েই বলতে পারি—মেলায় অংশ নেয়া প্রকাশনীর (হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া) সবাই মিলে যে পরিমাণ বই প্রকাশ ও পরিবেশন করে, বাংলাবাজারে এমনও কিছু ইসলামি প্রকাশনী আছে—যেগুলো এককভাইে এর চেয়ে বেশি বই প্রকাশ ও পরিবেশন করে থাকে। তাদের বইয়ের মানও বেশ ভালো।
এদিকে মেলার পাঠকদের মধ্যেও রয়েছে ইসলামি বইয়ের বিপুল চাহিদা। তবে কেন ইসলামি প্রকাশনাকে একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল দেয়া হয় না? কেন উপেক্ষা করা হয় ধর্মীয় পাঠকের পাঠচাহিদাকে?
এ দেশের মানুষ ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাসী। তারা দেশ ও মাটির সঙ্গে ধর্মকেও বুকে আগলে রাখে স্বগৌরবে। কিন্তু কিছু আধুনিক বুদ্ধিজীবীর মারপ্যাঁচে ধর্ম অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের কাছে। সংকীর্ণ হয়ে আসছে ধর্মের চর্চাও। একই সঙ্গে সুকৌশলে চলছে ধর্মবিরোধী অপপ্রচার।
এরই ধারাবাহিকতায় বইমেলায় প্রায়ই প্রকাশ হয় আপত্তিকর কিছু রচনা। যে রচনা শুধু ধর্মবিরোধীই নয়; মানবতারও বিপক্ষে। ধর্মবিরোধী বই মানুষে মানুষে হিংসা বাড়ায়। অশান্তি সৃষ্টি করে সভ্য সমাজে। নষ্ট করে প্রাণের মেলার পরিবেশ।
২০১৫ সালে ‘রোদেলা’ প্রকাশনীর ধৃষ্টতার পর ২০১৬ সালেও একই কাণ্ড ঘটায় ‘ব-দ্বীপ’ প্রকাশনী। ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর গ্রন্থটি এতটাই অশ্লীল ও অশালীন যে, বামধারার লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন—বইটি অশ্লীল এবং না পড়ার মতো।
তিনি বলেছেন, ‘বইটির কয়েকটি লাইন আমাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পড়ে শুনিয়েছেন। কয়েক লাইন শোনার পর আর সহ্য করতে পারিনি। এত অশ্লীল আর অশালীন লেখা! আমি মনে করি লেখালেখির সময় কিছুটা সতর্ক থাকতে হবে। যাতে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না আসে। আমার অনুরোধ—কেউ যেন বইটি না পড়ে।’ [সূত্র : আমাদের সময় ডটকম]
এর আগে ২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনী ‘নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর’ নামে একটি অনুবাদ বই প্রকাশ করে। বইটিতে পবিত্র কুরআনুল কারিমকে কাল্পনিক আবিষ্কার, কুরআন মুহাম্মদের জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, কুরআনের বিধি-বিধানে অসঙ্গতি এবং নবীজি সা.-এর স্ত্রীদের চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়। মুহাম্মদ সা.-এর কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি নয় ভূত আসতো বলেও উল্লেখ করে বইটির নিষিদ্ধ ঘোষিত ইরানি লেখক আলি দস্তি।
বইটি প্রকাশ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে রিপোর্ট প্রকাশের পর বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষ থেকে রোদেলা প্রকাশনী এবং অনুবাদকদ্বয়ের শাস্তির দাবিতে আওয়াজ ওঠে সারাদেশে। পরদিন বাংলা বইয়ের রাজধানী বাংলাবাজারে তাদের ফাঁসির দাবিতে একটি বিক্ষোভ মিছিলও হয়। এর প্রেক্ষিতে মেলা কর্তৃপক্ষ স্টলটি বন্ধ করে দেয়।
প্রশ্ন হলো—একই ভুল বারবার হয় কেন? রোদেলা ধৃষ্টতা দেখিয়ে বন্ধ হওয়ার পরের বছর ব-দ্বীপ কী করে উলঙ্গপনা দেখানোর সাহস পায়?
বাংলা একাডেমি পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ অবশ্য জানিয়েছেন, ‘নীতিমালা ভঙ্গ করায় তারা ব-দ্বীপ প্রকাশনী বন্ধ করে দিয়েছেন।’
আমার জিজ্ঞাসা—বইটি মেলায় প্রবেশের পর কেন বন্ধ করতে হলো? আপনাদের কাছে তো আগেই কপি জমা দেয়ার নিয়ম। তখন যাচাই-বাছাই করেননি কেন? কেন হাজারো পাঠকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হলো? কেন-ই বা মেলা চলা অবস্থায় স্টল বন্ধ করে মেলার সৌন্দর্য নষ্ট করতে হলো?
পরিশেষে বলব—একুশে গ্রন্থমেলা আরও ব্যাপ্তি পাক, বাঙালি হৃদয় বইয়ের প্রতি আরও দরদি হয়ে উঠুক, হাজারো বইয়ের ভিড়ে জায়গা করে নিক ধর্মীয় প্রকাশনাও। বইয়ের পাতায় পাঠকের প্রাণ সঞ্চারের সঙ্গে মিলুক আত্মার খোরাকও।
লেখক- সহ-সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম