ইউরোপের ডাক্তার

প্রকাশিত: ৬:৩৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৯
বদরুল বিন আফরুজ, ফ্রান্স প্রবাসী
ডাক্তারী লাইফটা বিখ্যাত কোনো এক বিখ্যাত অভিনেতার অভিনেত্রীর জীবনীর মতো। দেখা যায় যে– শুরু করেছিলেন শখে শখে , পরে পুরোটাই প্রোফেশনাল হয়ে যায়। জীবন মরন শপে দেন এক নেশায় । কসাই এখানা থেকে উপরে ওঠার সিঁড়ি যেন এক অসীম। বাংলাদেশের মেডিকেলে যারা পরে তারা খুব শখ করে আসে এই প্রোফেশনে। মানব সেবা পরম ধর্ম। বুদ্ধের বাণী , শুদ্ধ বাণী। মানুষের সেবা , গরীবের পাশে দাঁড়িয়ে দুনিয়া আখেরাত উদ্ধার করে দিবে। তাই দিয়েই আসলে শুরু হয়। স্টুডেন্ট লাইফে কিছু দিন করা যায় গরীবের জন্য কিছু কিছু। ইন্টার্ণ লাইফেও করা যায় সময় সুযোগ বুঝে। কিন্তু ফ্রি চিকিৎসা সম্পর্কে নেগেটিভ ধারনা বাঙ্গালিদের। তাই চাইলেও সরে আসতে হবে ফ্রির দরজা থেকে। পরে যখন পেশা হিসেবে শুরু করবেন চেম্বারশীপ।
পরিবার আর আত্মীয় স্বজন বাদ দিয়ে তখন আর ফ্রি কাউকে দেখার আগ্রহ মোটেও থাকবে না নিজের মধ্যে। রোগী দেখার পর অর্থ নেয়া আস্তে আস্তে বাধ্যতা মূলক হয়ে যায় কসাই। ফ্রি শব্দ টা শুনলেই তখন কসাইর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এর পর বছর গড়িয়ে গড়িয়ে কসাই যখন এসিট্যান্ট প্রফেসর হয়ে যাবেন। ভালো কোনো জায়গায় কসাইয়ের চেম্বার হবে। তখন টাকা পয়সার লেনদেন করবে আপনার চামার টাইপের একজন কসাই এসিট্যান্ট। সে আর গরীব ধনী , ডাক্তার -নন ডাক্তার এই সবের কি বুঝবে। ধীরে ধীরে আপনার চেম্বারে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায় সেই শৈশবের স্বপ্ন আর সেবা করার মনুষ্যত্ব । ডাক্তার নামের কসাই হয়ে যাবেন একজন প্রকৃত অর্থের বিনিময়ে সেবাদানকারী একজন প্রাণী। তারপর আরো ব্যস্ত হয়ে যায়।
তখন ডাক্তার কসাই তখন হারিয়ে ফেলবেন রোগীর সাথে ভালো ব্যবহার করার অভ্যাসটাও। রোগীর দিকে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশন লেখার সময় থাকবে না। দুই এক কথায় বিদায়। অসন্তুষ্টি নিয়ে রোগী বাড়ি ফিরেন। বাংলাদেশে ভালো ডাক্তার হইতে হইলে দুই একটা ম্যাজিক চিকিৎসা দেখাইতে পারলেই তিনি হয়ে যান ভাল কসাই , আর এই ম্যাজিকে কসাইয়ের পরবর্তী জীবনের দ্বার খুলে যায়। আর এই দ্বার সবাই পায় না। আর কয়েক বছর পর। ডাক্তার এখন ফুল কসাই প্রোফেসর। কসাইয়ের সিরিয়াল পেতে ৬ মাস লাগে। তখন কিসের ফ্রি , কিসের কি। তাকে দেখাতে পারাটাই রোগীর সৌভাগ্য মনে করে ।দরকার হলে ডাক্তারের ভিজিট , সাথে চেম্বারের মামার এক্সট্রা ভিজিট । তখন ডাক্তারের পেশার সাথে কসাইয়ের নেশা যোগ হয় পুরো দমে। রাত ৩টায় ডাক্তারের কসাইখানার চেম্বার শেষ হয়। তাই বাংলাদেশের ডাক্তার নামের কসাইয়ের জীবনী গুলো যেন পুরোটাই চিত্র শিল্পীর জীবনের প্রতিচ্ছবি।
ডাক্তার এখানে উদাহরন মাত্র। সব প্রোফেশনেই একি অবস্থা । মৌলিক আদর্শ ধরে রাখা খুব কঠিন হয়েগেছ। আমি বাংলাদেশের ডাক্তার নামের কসাই দের আগ থেকেই দেখতে পারিনা,সবগুলা শয়তানের দুলাভাই। আসলে প্রফেসর হওয়া যে বহু কষ্টের কাজ সেটা ৯৯% বাঙ্গালী জানেনা। ইউরোপে ১জন প্রফেসর ডাক্তার এর মর্যাদা আমাদের দেশের হাই কোর্টে / সুপ্রিম কোর্টের বিচার পতিদের থেকে কম না। ইউরোপ এর ডাক্তাররা কত ভাল এই নিয়ে দেশের মানুষের আক্ষেপ দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। আমি যে দেশে থাকি সেখানে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান সরকারী। কেউ যদি ডাক্তার দেখাতে চান তাহলে তাকে ফোন করে আগে সিরিয়াল নিতে হবে। লোকাল হেলথ সেন্টারে একজন ডাক্তার দিনে ১০ জন রোগী দেখবেন। হেলথ সেন্টার এর বাহিরে এক এক জন ডাক্তার রোগী দেখেন ৫ থেকে ৭ জন – বেশি দেখার জন্য বাধ্য করতে পারবেন না এইটা তাদের সিস্টেম।
আগে ফোন করলে আগে সিরিয়াল অথবা অনলাইনে নিতে হবে। বাংলাদেশের মত বাহিরে কসাই গিরি সিস্টেম নেই। আমার স্টরি দিয়েই শুরু করি – আমি বাই রোডে যখন স্পেনে ঢুকেছি তখন আমার শরীরে প্রচন্ড জ্বর কাশি যার লক্ষণ খুবই খারাপ মেডিকেল ও যেতে পারছি না, কারণ ইউরোপের মাটিতে কাগজ ছাড়া মেডিকেলে দেখানো যায় না আর আমার কাগজ নেই কাগজ ছাড়া রোগী দেখে না। দোকান থেকে ঔষধ কিনে খাচ্ছি কিন্তু কমছে না। বিছানায় শুয়ে গেছি লক্ষণ বেশ ভালো না তাই মামার একজন রুমমেট নিয়ে মেডিকেলে নিয়ে গেলেন প্রথমেই ভাষা জানিনা মামার রোমান্টিক কিছু বলছেন কাউন্টারে তার কাগজ চাইল বললাম নাই আমার অবস্থা দেখে ডাক্তার কে ফোন দিয়েছে ডাক্তার নিজেই আসলেন আমার সামনে ভিতরে নিয়ে গেলেন আমাকে সমস্যা কি এই যে জ্বর কাশি আচ্ছা কাগজ? নেই বলে চোখে জল ডাক্তার জল দেখে আরে কাঁদছেন কেন সাথের উনি কাগজ নাই এখন তার কি হবে এজন্য কাঁদছেন , ডাক্তার আরে আমি আছি কাগজ নাই তো কি হয়েছে।
ডাক্তার বলল, একটা ফিল্ম লাগবে আর রক্ত, কাশি টেস্ট করতে হবে বসে থাকেন এখানে গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে তবে টাকা লাগবে? টাকা তো নেই তখন ডাক্তার টেলিফোনে কোথায় যেন দীর্ঘ সময় কথা বলছেন ওকে টাকার টেনশন করবেন না আমি দেখছি কিছু সময় পর দুইজন এনজিও সংস্থার লোক ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ আমাকে দেখিয়ে ডাক্তার বলছেন উনার কাগজ, টাকা কিছু নেই উনার চিকিৎসা জরুরি আপনারা যদি উনার খরচ বহন করেন তাহলে চিকিৎসা শুরু করব তারাও তখন বলে নিল ঠিক আছে আমরা দেব যা আসে একটি ফরমে আমার স্বাক্ষর আর তারা ছবি তুলে চলে গেল।
রিপোর্টের সব কাগজপত্র ডাক্তারের কম্পিউটারে চলে আসছে ডাক্তার দেখে বললেন ভর্তি হতে হবে, তোমার টাইফয়েড হয়ে গেছে। ভর্তি হয়ে গেলাম সাথে কেউ নেই একা একটি রুমে দরজা ডাবল বন্দীর মতোই মনে হচ্ছে বন্দী হলে কি হবে একের পর এক ডাক্তার আসছেন খাবার ও আসছে সাথে আপেল কমলা কলা বিস্কিট কফি ইত্যাদি সেবা করার কোনো ত্রুটি ছিল না। মেডিকেল ১৮ দিন ছিলাম সাথে কেউ ছিল না এতে মনে কোন দুঃখ নেই কারণ পরিবারের মানুষ বা আত্মীয় স্বজন যে সেবা টুকু দিবে। ডাক্তার নার্স তাদের কাছ থেকেই এর চেয়ে ভালো সেবা পেয়েছি যা আমি কল্পনাও করতে পারেনি।
মেডিকেল থেকে যেদিন আমাকে বিদায় দিবে ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করতেছে তুমি কি স্পেনে থাকবে না অন্য কোথায় চলে যাবে, আমি বললাম অন্য জায়গায় চলে যাব আরে না যেও না তোমার কমপক্ষে ৬ মাস চিকিৎসা করাতে হবে প্রতি মাসে মাসে আমি টেস্ট করব তোমার রুগ কোন পর্যায়ে আছে পরে অন্য কোথাও চলে যেও, আমিও ঠিক আছে ডাক্তার ওকে বাসায় চলে যান।
আমার বাসায় ডাক্তার ঔষধ পাঠিয়ে দিয়েছেন মাসে মাসে চেক করাতে ডাক্তার আমাকে ফোন দিতেন লাস্ট টেস্টের পর ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন আসি আমাকে তার ভাষায় বোঝাতে না পেরে গুগল ট্রান্সলেট থেকে ট্রান্সলেটর করে আমাকে গুডবাই, থ্যাঙ্ক ইউ, টাটা বলে, বিদায় দিলেন আর আমার সুমঙ্গল কামনা করেন এইসব লেখি কম্পিউটার ঘুরিয়ে আমাকে দেখালেন আমি তার প্রেমে আত্মহারা তখন আমি গুডবাই বলে বিদায় নিচ্ছি ডাক দিয়ে আমাকে একটা সেলফি তুলতে চাইল এটা সেলফি তুলে বিদায় নিয়ে আসছি। এজন্যই প্রথমে বলছি ডাক্তার আসলেই ইউরোপ আর আমার দেশের সব ডাক্তার ক্লিনিকের মালিকরা কসাই। টাকা ছাড়া সরকারি ডাক্তার, মেডিকেল অথবা সরকারি চারা ডাক্তার ও ক্লিনিক এসবে টাকা ছাড়া কোনোভাবেই চিকিৎসা দেবে না। ওরা মানব সেবার নামের কসাইরা।

মন্তব্য করুন