একটি পাসপোর্টের জন্য জাতির আকুলতা

প্রকাশিত: ৪:৪৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৩০, ২০১৯
বিশেষ মতামত-
আজ আমার মনে তৃপ্ততা বিরাজ করছে। অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা আল্লাহ তায়ালার প্রতি। একটি পাসপোর্টের জন্য ওলামায়ে কেরামদের সংহতি দেখে ভালো লাগছে। একজন আলেমও কি আছেন? যিনি প্রকাশ্যে বলবেন, না বাবুনগরীকে পাসপোর্ট ফেরত দিবেন না! আশাকরি, এ মুহূর্তে শায়েখ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে দেশের সকল শায়েখই পছন্দ ও সমর্থন করছেন। অনেক দিন পর ওলামাদের একটি সংহতির নমুনা দেখা গেলো। জাতি তাঁর প্রতি সহমর্মিতা ও আকুলতা প্রকাশ করছে।
আল্লামা শাহ আহমাদ শফী, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, মাওলানা মামুনুল হক, মুফতী হাসনাত আমিনী সহ প্রায় সব মুয়াজ্জাজ আলেম নেতৃবৃন্দ সোচ্চার হয়েছেন একটি মাত্র ইস্যুতে। মানবিক ইস্যু। আগামীতে যে ভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব, সেটার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। দূরে বাত্তি দেখা যাচ্ছে।
আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে আশাবাদী। আলেম ওলামাদের মাঝে বন্ডেজটা মজবুত থাকা চাই। অনেকের ন্যায় আমিও ব্যক্তিগত ভাবে এটা নিয়ে সর্বদাই ফিকির করি।
পাসপোর্ট প্রাপ্তির জন্য কার অবদান বেশী? অবশ্যই ফেসবুকের। এটার উত্তর সোজা সাপ্টা বলে দিলাম। অন্য কোন দিন খোলাসা আলোচনা করা যাবে।
সকলে তাঁদের দাবীর মাঝে মোটামুটি দুটো কথা উচ্চারণ করেছেন, আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট অবিলম্বে ফেরত দিন, যাতে তিনি বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেন। এবং তাঁকে সরকারী খরচে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করুক সরকারে।
আমি ফেসবুক অডিয়েন্সকে বলবো, দুটো দাবীই মেনেছে সরকার। প্রথমটা মানতে গিয়ে যতটা ভদ্রস্থ হওয়া যায় ততোটাই হয়েছে। দ্বিতীয় দাবীটার ব্যাপারে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হুজুর নিজেই রাজী হন নি। প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নাল  আবেদীনের মুখের উপর বিণয়ের সাথে তিনি বলে দিয়েছেন, সরকারের অর্থ তিনি গ্রহণ করবেন না।
এমন দৃঢ় মনোভাব ও স্পষ্টবাদীতা তাঁকেই মানায়। আমি এখন সবচেয়ে খুশী। মাগনা খাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে তিনি ভবিষ্যতের জন্য একটি উপমা রাখলেন উম্মাহর সামনে। “আস্ত গরু মাইরা জুতা গিফট” গ্রহণ করলেন না তিনি। উম্মাহ একজন ঈমানের বলীয়ান দৃঢ়চেতা আলেমকে দেখলো, যিনি শারীরিক চরম সংকটাপন্ন অবস্থায়ও চিকিৎসার জন্য কোটি টাকার অফার ফিরিয়ে দিতে পারেন। তিনি একটু ইশারা দিলে যেতে পারতেন পৃথিবীর যে কোন দেশে। এনিহোয়্যার।
অবশ্য সরকারের অর্থ কোন ব্যক্তি বিশেষের নয়। জনগনের সম্পদ। হুজুর সরকারের এ ফান্ডের অর্থ গ্রহণ করলে সেটা শুদ্ধ হতো। পবিত্র হতো। এটা অধিকার হিসেবে তাঁর প্রাপ্য। তাঁর প্রচন্ড আত্মমর্যাদা আছে, বিধায় তিনি এইড নিতে গররাজি। এমন একজন মানুষকে আপনি সম্মাণ জানাতে বাধ্য।
২০১৩ সালে আমি নিজ ব্যস্ততায় ফেসবুকে বিচরণ করতে পারিনি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আল্লামা বাবুনগরীর হুজুরকে রিমান্ডে নিয়ে বহু রকমের অত্যাচার করা হয়েছিল। যা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি কর্ণেল (বরখাস্তকৃত) ফারুক ২৮ দিন রিমান্ডে  ছিল। কিন্তু মরে যাবে এমন কোন নিউজ বের হয়নি। আর বাবুনগরী হুজুর ছিলেন ২২ দিন। রিমান্ডে থাকাকালীন নির্যাতন ও মাত্রাতিরিক্ত ডায়াবেটিস এর কারণে তাঁর পায়ে পঁচন ধরেছিলো। ঘা কমতে ছিলো না। ডাক্তাররা স্পষ্ট  বলেছিলেন- তাঁর সুচিকিৎসা না হলে তিনি মারা যাবেন। অতঃপর সরকার তড়িঘড়ি করে জামিন দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হয়।  তখন আমার ছোট্ট একটা স্টাটাস ছিলো, “সরকার তাঁকে মরার জন্য মুক্তি দিয়েছে।”
তিনি দীর্ঘ চিকিৎসায় মোটামুটি সুস্থ হন।তবে কখনো পূর্নাঙ্গ আরোগ্য লাভ করেন নি।
আজ প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জনাব মিয়া মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন সুন্দর করে একটা কথা বলেছেন। তাঁরা আলেমে দ্বীনকে সম্মান করেন বিধায় নিজে এসে সরাসরি তাঁর হাতে পাসপোর্টখানা তুলে দিচ্ছেন। মনে হয়নি, এটা নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে। তবে কতকের মতে,  আলেমবান্ধব (!) সরকারের এটা কৌশল মাত্র!
এটি সরকারের অরাজনৈতিক ও ইনোসেন্ট পদক্ষেপ, তার একটা বড় প্রমাণ- তারা একটি ব্রান্ড নিউ পাসপোর্ট ইস্যু করে দিয়েছে। অর্থাৎ পূর্বের এনালগ  পাসপোর্ট  জমা নিয়ে ও ডিজিটাল পাসপোর্টের আবেদন নিয়েও গত ৫ বৎসরে সরকার তা ডেলিভারী দেয়নি। ২০১৩ সাল থেকে সেটা আটকে ছিলো। গতকালই পূর্ণ মেয়াদের মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট নগদে ইস্যু করে দিয়েছে। অন্যথায় নতুন মেয়াদের পাসপোর্ট ইস্যু করতে হুজুরকে পাসপোর্ট অফিসে যেতে হতো। ঝক্কি ঝামেলা নাই আর।
এখন তিনি যেথায় খুশী, সেখানেই যেতে পারবেন চিকিৎসার জন্য। অথবা মনে চাইলে ঘুরতে। স্বাধীনভাবে তিনি চলাফেরা করতে পারবেন।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আজ জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। তাঁর জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বি। আলেমদের যক্ষের ধন তিনি। তাঁকে বিনা চিকিৎসায় হারাতে কেউ রাজী না। বিদেশে গেলে অনেক টাকার দরকার। বিদেশে চিকিৎসা খরচের  উৎস কি? সেটা নিয়ে তাহকীক করা যাক।
১. নিজস্ব সম্পদ ।
২. সরকারের অর্থ ।
৩. মোহেব্বীনদের প্রদত্ত অর্থ।
সবচেয়ে উত্তম হবে, নিজস্ব সম্পদের দ্বারা নিজের চিকিৎসা ব্যয় মিটানো। একজন কওমী মুহাদ্দিসের যে আয় তার দ্বারা পারিবারিক ব্যয় মেটানোর পর ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত থাকার কথা না। যদি থাকে, তার পরিমাণ নেহায়েত কম হবে। এটা বাদ।
দ্বিতীয় অপশন হলো- সরকারের অনুদানপ্রাপ্তি। এখানে কিন্তু আছে। গতকাল তিনি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। বাবুনগরী হুজুরের যে ব্যক্তিত্ব, তাঁর সামনে ফের প্রস্তাব তুলতে অনেকেই সাহস পাবেন না। সামরিক সচিব সাহেবের অনেক সাহস। তিনি পরবর্তীতে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করাতে চেষ্টা করতে পারেন।  তাঁকে এ প্রস্তাব গছাতে পারলে সরকার একটু হলেও নির্ভার থাকতো। কা‌রণ সকলের জানা। তাঁর প্রতি চরম অসম্মান ও নির্দয় আচরণের একটা হিল্লে হলো বলে সরকার আত্মতৃপ্তি পেতো।
শোনা যায়, তাঁর প্রতি সরাসরি নির্যাতনকারীরা কেউই ভালো নাই। আযাবগজব চলছে দুনিয়াতেই। বাবুনগরী হুজুরে এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এখন টাকা আসবে কোত্থেকে? অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে অফারটা প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব দিয়ে রেখেছেন।
তৃতীয় অপশন। এ আয়োজনটা খুব আনন্দদায়ক হবে। দেশ ও দেশের বাইরে তাঁর লাখ লাখ ছাত্র ও ভক্ত আছেন। আমি তাঁর ছাত্র না, একজন ভক্ত। এ সংখ্যাটাই বেশী। হুজুরের চিকিৎসা বাবদ টাকা দিতে মরিয়া সবাই। একটা ট্রিটমেন্ট ফান্ড ডিক্লেয়ার হলে তাতে কত দ্রুত কোটির অংক ছাড়িয়ে যাবে, তা ভাবা যায় না। হয়তো একটা রেকর্ড হয়ে যাবে। পাল্টা ডিক্লেয়ার দিতে হবে, আপনেরা এবার থামেন। যে অর্থ এসেছে তা হুজুরের জন্য কাফি। আমি বেশী বলে ফেললাম না তো?
এ শেষ অপশনের মাধ্যমেই ইনশাআল্লাহ বিদেশে বেটার চিকিৎসা হবে। ব্যাংকক- সিঙ্গাপুর- মাদ্রাজ-দিল্লী- লন্ডন- আমেরিকা যেখানেই তিনি যাবেন, চিকিৎসা ব্যয় এসে যাবে। এটা আমি কয়েকদিনে তাঁর ভক্তদের আবেগ দেখে সহজেই বিশ্বাস করছি। ইনশাআল্লাহ।
তো আমরা হুজুরের পরবর্তী সম্মতি ও ইশারার অপেক্ষায়। তিনি যেটা বলবেন সেটাই বেটার অপশন হবে।
আমার নিজের সাথে ঘটা একটা কাহিনী শেয়ার করছি। আমার তখন বনানীতে অফিস। তখন কাকলী থেকে সরাসরি রিক্সায় কাফরুলের বাসায় আসা যেতো। আমার সাথে একজন মেহমান, তাঁকে সহ বাসায় আসবো। দরদাম করে রিক্সায় উঠে বসলাম। রিক্সাওয়ালা উঠে প্যাডেল ঘুরায় না। গাঁইগুই করতেছিলো। জানতে চাইলাম কি খবর? রিক্সায় চালাচ্ছো না কেন? জবাব দেয়না, আবার প্যাডেলও ঘুরায় না। এরপর বলে, সে যাবে না। কেন যাবে না তা আবার বলে না। অন্য রিক্সাও নেই যে, লাফ দিয়ে উঠে বসবো? এক পর্যায়ে বলে ফেললো, আপনেরা মোটা। আপনাগো টানতে পারুম না। মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ঐ মিয়া! যখন দরদাম করছিলাম তখন কি আমি চিকন ছিলাম?
বারডেমে আজ শোনা গেলো, আল্লামা বাবুনগরী একজন আলেমে দ্বীন, তাঁকে সম্মান জানাতে হয়। তাহলে ২০১৩ সালে কি তিনি আলেমে দ্বীন ছিলেন না?
লেখক, এক্টিভিস্ট, বিশ্লেষক।

মন্তব্য করুন