শুধু পাসপোর্ট ফেরৎ নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বাবুনগরীর চিকিৎসার দাবি

প্রকাশিত: ৬:৩২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০১৯

বিশেষ প্রতিবেদন-

ইবনে মুসা

আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ না দেওয়া তার সঙ্গে আরেকটি জুলুম ও অমানবিক বলে মন্তব্য করেছেন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ওলামায়ে কেরাম। তার পাসপোর্ট ফেরৎ দিয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনায় উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাবার দাবি জানান তারা। আজ ২৮ জানুয়ারি সোমবার পাবলিক ভয়েসের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে এ সমস্ত কথা বলেন দেশের শীর্ষ আলেমরা।

ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম শায়েখে চরমোনাই বলেন,

শুধু পাসপোর্ট ফেরৎ দেওয়া নয়, বরং আল্লামা বাবুনগরীর চিকিৎসা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় করা সরকারের দায়িত্ব। নাটক-সিনেমার নায়ক-নায়িকা এবং খেলোয়ারদের চিকিৎসার দায়ভার সরকার নিচ্ছে, কিন্তু আল্লামা বাবুনগরীর মতো ন্যায়পরায়ণ, সত্যের পথে নির্ভীক, একজন বুযুর্গের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার না নিয়ে ভুল করছে। সরকার চিকিৎসার দায়িত্ব তো নিচ্ছেই না বরং পাসপোর্টও আটকে রেখেছে! হেফাজতের সঙ্গে সরকারের ভালো সম্পর্কের পরও হেফাজত মহাসচিবের সঙ্গে এ আচরণ প্রত্যাশিত নয়। আল্লামা বাবুনগরী দেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। সরকারের উদাসিনতায় তার কোনো ক্ষতি হলে, সে দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। তিনি আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া-সহ তার সমস্ত চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারকে গ্রহণ করার দাবি জানান। পাশাপাশি সমস্ত মসজিদ মাদরাসা এবং ওয়াজ মাহফিলে আল্লামা বাবুনগরীর সুস্থতা কামনায় দোয়া করার জন্য ওলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ মুসুল্লীদের প্রতি আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন- হেফাজত মহাসচিব বাবুনগরী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে

আল্লামা বাবুনগরীর এই চরম সঙ্কটাপন্ন সময়ে হেফাজত ইসলামের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতাকে তার পাশে দেখা যাচ্ছে না এবং তার পাসপোর্ট ফেরৎ আনার ব্যাপারেও তাদের পদক্ষেপ নিয়ে জনমনে রয়েছে কৌতুহল। অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে জোর প্রতিবাদ হচ্ছে। অনেকে মনে করেন হাটহাজারী চাইলেই আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ আনা সম্ভব। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পাবলিক ভয়েস থেকে যোগাযোগ করা হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীর সঙ্গে।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর এই সঙ্কটাপন্ন সময়ে হেফাজত ইসলামের সাংগঠনিকভাবে কোনো পদক্ষেপ রয়েছে কী না জানতে চাইলে মাওলানা ইসলামাবাদী বলেন,

আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি হেফাজত মহাসচিবের পাসপোর্ট ফেরৎ আনার জন্য। সরকারের উচ্চ পর্যায় বারবার যোগাযোগও করা হয়েছে। কিন্তু দিচ্ছি দেবো বলে দিচ্ছে না। বারবার যোগাযোগের পরও যদি পাসপোর্ট ফেরৎ না দেয় সেখানে আমাদের কী করার থাকতে পারে। তবুও আমরা চেষ্টা অব্যহত রেখেছি। আল্লামা বাবুনগরীর চিকিৎসার ব্যয়ভার হেফাজত ইসলাম গ্রহণ করবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না এটা সাংগঠনিকভাবে হেফাজতে ইসলাম গ্রহণ করবে না। তাছাড়াও আল্লামা বাবুনগরী অন্যের খরচ গ্রহণ করেন না বলেও জানান মাওলানা ইসলামাবাদী।

আরও পড়ুন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর চিকিৎসা চাই ; পাঠক মতামত

আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও তার ছেলে আনাস মাদানীর পাসপোর্ট ফেরৎ আনা হলেও বাবুনগরীর পাসপোর্ট কেন আনা হলো না এমন প্রশ্নের জবাবে হেফাজতের এই নেতা বলেন, সেটা সরকারই বলতে পারবে কেন বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ দেওয়া হয়নি। সরকারের সঙ্গে হেফাজতের বর্তমান যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে, সে জায়গা থেকে চাইলে হেফাজত ইসলাম আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ আনতে পারতো কী না? এমন প্রশ্নের জবাবে ইসলামাবাদী বলেন, আসলে আমরা চেষ্টায় ত্রুটি রাখিনি। সরকার যদি বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ না দেন, সেখানে আমাদের আর কী করার আছে।

আরও পড়ুন- কার জন্য কে কাঁদে

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জিরি মাদরাসার পরিচালক আল্লামা শাহ মুহাম্মাদ তৈয়্যব পাবলিক ভয়েসকে বলেন, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী এ দেশের একটি সম্পদ। তার মতো মুহাদ্দিস বাংলাদেশ আর পাবে কী না সন্দেহ আছে। আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট আটকে রাখা তার ওপর আরও একটা জুলুম।

তিনি বলেন,

আল্লামা বাবুনগরী বাংলাদেশের স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ মাজলুমে পরিণত হয়েছেন। রিমান্ডের মাধ্যমে তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করে তাকে অসুস্থ করে দেওয়া হয়েছে। এটা ছিল একটা জুলুম, আর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ না করে দেওয়া এবং পাসপোর্ট ফেরত না দেওয়া আরেকটা একটা বড় জুলুম।

তিনি অতিদ্রুত আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ দেওয়ার দাবি জানান।

গবেষক আলেম ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসাইন বলেন, আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট আটকে রাখা অমানবিক। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি রেখে বলেন, যাতে মানবিক দিক চিন্তা করে হলেও আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ দেওয়া হয়। ডক্টর খালিদ পাবলিক ভয়েসকে বলেন,

আল্লামা বাবুনগরীর নামে আদালতে মামলা এবং তিনি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজেও জড়িত নন। তার মাধ্যমে দেশের কোনো ক্ষতিও হচ্ছে না, তবুও তার পাসপোর্ট কী কারণে আটকে রাখা হয়েছে সেটা সরকারই বলতে পারবে।

তবে এই মুহূর্তে তার শারীরিক যে অবস্থা, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মানবিক দিক লক্ষ্য করে হলেও আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ দেওয়ার দাবি জানান ডক্টর খালিদ হোসাইন।

বিশিষ্ট ওয়ায়েজ মাওলানা ফরিদ উদ্দীন আল মোবারক বলেন, বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন এবং সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডেও তিনি জড়িত নন। আল্লামা বাবুনগরী দেশের মানুষের জন্য একজন সম্পদ। তার মতো একজন অরাজনৈতিক ও গ্রহণযোগ্য শীর্ষ বুজুর্গের পাসপোর্ট আটকে রাখা অমানবিক। তার পাসপোর্ট ফেরৎ দেওয়া এবং চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব বলে দাবি করেন মাওলানা ফরিদ উদ্দীন আল মোবারক।

বরেণ্য ওয়াজ মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবী বলেন, আল্লামা বাবুনগরী বাংলাদেশের প্রথিতযশা একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম। তার জনপ্রিয়তা শুধু দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে তার জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি রয়েছে। পাসপোর্ট আটকে রেখে তার সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা অমানবিক।

“বিরোধীদলের কেউ এমন অসুস্থ হলেও মানবিক কারণে কাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু আল্লামা বাবুনগরী কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি না হয়েও চরম অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন। এটা সম্পূর্ণ জুলুম।”

আল্লামা বাবুনগরীর পাসপোর্ট ফেরৎ পাওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আল্লামা বাবুনগরীর জামাতা মাও. আবদুল্লাহ  জানান,

পাসপোর্ট ওকে থাকার পরও পাসপোর্ট ফেরৎ দেওয়া হচ্ছে না। আমরা পাসপোর্ট এর জন্য পাসপোর্ট অফিসে গেলে তারা আল্লামা বাবুনগরী ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন যে পাসপোর্ট সচল রয়েছে। আমরা পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট ফেরৎ দেবে কী না জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসের সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্মকর্তা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করতে বলেন। আমরা এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করলে তারা ফেরৎ দিবেন বলে বলে আমাদের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পাসপোর্ট ফেরৎ দিচ্ছেন না।

উল্লেখ্য : ২০১৩ সালের আলোচিত সেই ৫ মে’র পর গ্রেফতার হন হাদীস বিশারদ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। ঐ সময় রিমান্ডেও নেওয়া হয় দেশের প্রথিতযশা এই আলেমকে। গ্রেফতার পরবর্তি সময় থেকেই নানা রোগে ভুগছেন তিনি। স্বাভাবিক জীবনযাপন করাও অসম্ভব হয়ে পরে তার জন্য। হুইল চেয়ারে করে চলতে হচ্ছে আল্লামা বাবুনগরীকে। গ্রেফতারের পর পাসপোর্ট জব্দ করায় উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়াও সম্ভব হয়নি তার।

গত ২৬ জানুয়ারি শনিবার হঠাৎ অসুস্থবোধ করেন বাবুনগরী। বাম পা ফুলে ওঠে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঐদিন বিকালে রিজেন্ট এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে চিকিৎসার জন্য তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকার খিলগাঁওস্থ খিদমাহ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সেখানে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন। এখন পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।

মন্তব্য করুন