দৌলতখানে একদিকে ইউএনও অপসারণের দাবি, অপরদিকে ঝাটকা নিধণের মহড়া জেলেদের

প্রকাশিত: ৭:২৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ১২, ২০২১

ভোলা প্রতিনিধি॥ ভোলার দৌলতখান উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) মো. কাওছার হোসেনকে অপসারনের দাবিতে গত তিন দিন ধরে দৌলতখানে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে সেখানকার ইউনিয়নের মেম্বার ও স্থানীয়রা।

গত সোমবার রাতে উপজেলার ভাবানীপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুল মতিনকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে আনসার সদস্যরা লাঞ্চিত করার অভিযোগ এনে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা।

যার ফলে গত তিন দিন ধরে দৌলতখানের মেঘনা নদীতে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। এ সুযোগে সেখানকার জেলেরা নদীতে মাছ নির্বিগ্নে মাছ শিকার করছে। দেখলে মনে হয় সেখানে সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দৌলতখানের বিভিন্ন মাছ ঘাটে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি মাছ ঘাটেই মাছ ব্যবসায়ী ও মানুষের সমাগম। নদী থেকে একে একে আসছে মাছ ধরার নৌকা। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই দৌলতখানের মাঝিরহাট মাছ ঘাট থেকে তজুমদ্দিন উপজেলার সীমানা পর্যন্ত এলাকায় শত শত মাছ ধরার নৌকা নিয়ে জেলেরা নদীতে মাছ শিকার করছেন। কেউ জাল টানছে আবার কেউ জাল ফেলছে। দেখলে মনে হবে ওই এলাকায় কোনো অভিযান নেই।

দৌলতখানের নতুন রাস্তা মাছ ঘাটে গেলে দেখা মিলে নদী থেকে মাছ ধরে আসা ইউছুফ মাঝি নামের এক জেলের সাথে। তারা তিন জন সকালে নৌকা ও জাল নিয়ে নদীতে মাছ শিকারে নেমেছেন। অভিযানের কথা জিজ্ঞেস করলেই সে বলে, এনজিওর ঋণের টাকা পরিশোধ করতেই তারা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নদীতে মাছ শিকারে গেছেন।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, দুই মাসের সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে তারা ১৬টি সচেতনতা সভা করেছেন। এবং বিভিন্ন স্থানে আটটি ব্যানার টানিয়েছেন। গত ১০ দিনে ১০ টি অভিযান ও দুই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়েছে।

জানা যায়, গত এক মার্চ থেকে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর ১৯০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকা সংরক্ষণের লক্ষে দুই মাসের জন্য সকল ধরণের মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। এরই ধারাবাহিকতায় জেলার দৌলতখান উপজেলার মেঘনা নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়।

নিষেধাজ্ঞার সপ্তম দিনে গত সোমবার রাতে দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কাওছার হোসেন আনসার সদস্যদের নিয়ে মেঘনা নদীতে অভিযানে নামেন। এসময় একটি মাছ ধরার ট্রলারসহ দুই জনকে আটক করে থানা সংলগ্ন পৌর মাছঘাটে নিয়ে আসলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে চতুরদিক থেকে জেলে ও স্থানীয়রা ঘিরে ফেলে। সেখানে উপস্থিত হয় ভাবানীপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল মতিন। এক পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন ইউপি সদস্য আবদুল মতিন। পরে সেখানে উত্তেজিত জনতার উপর লাঠিচার্জ করে আনসার সদস্যরা। এ অবস্থায় ইউপি সদস্য আনাসারদের লাঠির আঘাতে আহত হন। এর পর থেকেই উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও মাছ ব্যবসায়ীরা। যার ফলে গত তিন দিন ধরে দৌলতখানের মেঘনা নদীতে অভিযান বন্ধ রয়েছে।

এ সুযোগে দৌলতখানের জেলেরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠেছে।

এদিকে অভিযানকে কেন্দ্র করে আহত ইউপি সদস্য আবদুল মতিন গত তিন দিন ধরে দৌলতখান হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত ক্যাবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তার ওপর হামলার প্রতিবাদে সোমবার দৌলতখান উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যবৃন্দের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এছাড়াও বুধবার সকালে দৌলতখান উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যবৃন্দ ও সর্বস্তরের জনগণ এর ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় মানববন্ধনকারীরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কাওছার হোসেনের অপসারণ দবি করেন।

এ বিষয়ে দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কাওছার হোসেন জানান, সোমবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে মেঘনা নদীতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় চারটি মাছ ধরার ট্রলার ও সাত জেলেকে আটক করা হয়েছে। একই সাথে মাঝ নদীতে একটি বড় মাছ ধরার ট্রলারকে ধাওয়া দিলে তারা জাল ফেলে রেখে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে ট্রলারটিকে এক কিলোমিটার ধাওয়া করে আটক করা হয়। এ সময় ট্রলারে থাকা ৭-৮ জন জেলে পালিয়ে গেলেও মনির হোসেন নামে এক জেলেকে আটক করতে সক্ষম হয় আনসার সদস্যরা। পরে তাকে ট্রলারসহ পৌর মাছঘাট এলাকায় নিয়ে আসলে সেখানে স্থানীয়রা জড়ো হতে থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হন ভবানীপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুল মতিন। সে এসে তার ভাই মনির ট্রলার নিয়ে আত্মীয়র বাড়িতে গিয়েছে বলে তাকে ছেড়ে দিতে বলে। এবং তাকে নির্দোষ দাবি করেন। সে সেখানে উচ্চস্বরে চিল্লাচিল্লি করতে থাকে। তার ইশারায় এক পর্যয়ে সেখানে থাকা জেলেরা আমাদের কাছাকাছি চলে এসে আমাদের ওপর হামলা করতে চায়। পরে আমি আমার সাথে থাকা আনসার সদস্যদেরকে লোকজন সরিয়ে দিতে বললে তারা বাঁশি ফু দিলে লোকজনকে দৌড়ে চলে যায়।

এসময় ইউপি সদস্য আবদুল মতিন লোকজনের হুরোহুরিতে পরে গিয়ে ব্লকের সাথে আঘাত প্রাপ্ত হয়। এসময় রাতের অন্ধকারে তার গায়ে আনসারদের লাঠির দু’একটা আঘাত লাগতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ইউপি সদস্য অন্যভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে। এছাড়াও প্রতি বছর দৌলতখানে নদীতে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মৎস্য কর্মকর্তা জেলেদের হামলার শিকার হতে হয়েছে।

এ বিষয়ে দৌলতখান উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারি মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন জানান, জাটকা রক্ষা ও ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা সময়ের গত এক মার্চ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ১০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং দুইটি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হয়। অভিযানে ২০ হাজার মিটার জাল জব্দ করে আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়েছে। আমি থানায় খবর দিয়েছি। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা নদীতে অভিযানে যাবো।

তিনি আরো জানান, দৌলতখানে কোনো অফিসার আসতে চায় না। মনের বিরুদ্ধে আসতে হয়। আমিও এখানে অতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। আমার মূল দায়িত্ব হলো তজুমদ্দিনে। আমি নিজে অসুস্থ হয়েও দুইটি উপজেলা সামাল দিতে হয়। তবে নিষেধাজ্ঞার সময়ে নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করতে জোরদার অভিযানের বিকল্প নেই। অভিযান পরিচালনার জন্য জনবল দরকার। এখানে আমি ছাড়া মাত্র এক জন ফিল্ড অফিসার ও একজন পিয়ন রয়েছেন। আমাদের নিজস্ব কোনো যানবাহনও নেই। জেলেদের ট্রলার রিকুজিশন করে নদীতে অভিযানে যেতে হয়।

আহত ইউপি সদস্য আবদুল মতিন অভিযোগ করে বলেন, গত সোমবার তার ভাই মনির হোসেনের শ্বশুর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে বিকেলে মাছ ধরার ট্রলারে করে চার জন মহিলা ও দুই জন পুরুষসহ নোয়াখালীর আলেকজেন্ডার যায়। পরে রাতেই মহিলাদের সেখানে রেখে ট্রলার নিয়ে তারা দৌলতখানে ফিরে আসলে মাছ ঘাটে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাদের আটক করে। এবং মনির হোসেনকে নৌকার সাথে বেঁধে রাখে। পরে খবর পেয়ে ইউপি সদস্য আবদুল মতিন মাছ ঘাটে যায়। এবং মানুষের ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তার ভাই কি করেছে জানতে চায়। তারা নদীতে মাছ শিকারে গিয়েছে বলে জানান। এ সময় ইউপি সদস্য তার ভাইর শশুরের অসুস্থতার কথা জানান। এবং তার ভাইকে ছেড়ে দিতে বলেন। এসময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার তার সাথে থাকা আনসার সদস্যদেরকে ইউপি সদস্যকে পিটাতে বলেন। এতে ইউপি সদস্য আবদুল মতিন গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে দৌলতখান হাসপাতালে ভর্তি করেন।

মন্তব্য করুন