প্রবাস থেকে স্বদেশের গল্প

প্রকাশিত: ৬:৪২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৫, ২০১৯

বদরুল বিন আফরুজ (ফ্রান্স প্রবাসী)

দেশের জীবন আর প্রবাস জীবনে একটা বড় পার্থক্য আছে। দেশে আপনি আপনার পরিচিত পরিবেশ, পরিবার-বন্ধুবান্ধব থেকে যত দূরেই থাকেন, সেটার একটা লিমিট আছে- এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার খুব বেশি বড় না। অন্তত ডানেবামে দেশি মানুষ ত পাবেন যে কোন সময়। বিদেশের ব্যাপারটা এই দিক থেকে একটু ক্রিটিকাল। জীবনে পরপর দুইটা বাক্য ইংরেজিতে না বলা কাউকে ধরে ইংরেজদের রাজ্যে ছেড়ে দিলে ব্যাপারটা বড় কষ্টকর। তার মধ্যে চাইলেই দেশে ফেরত যাওয়া সম্ভব না- আর সব বাদ দিলেও হয়না দেশ ছেড়ে প্রবাসী আশা পরিবার আর নিজের স্বপ্ন বুনা।

খাবার-দাবারও অপরিচিত- এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে সবাই পিজা-বার্গার-কোক খায়, কিন্তু দেশের বাইরের পিজা-বার্গার-কোকও দেশের চেয়ে আলাদা। ভাত তো নাই আর সব খাবারেই লবণ কম লাগে, সব খাবারই মিষ্টি, মশলা বলে কোন বস্তু নাই- এইসবের চেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে কী খাবেন এটা দোকানে গিয়ে বোঝাতে পারতে তো হবে! আপনি মনে মনে বাংলা থেকে তাদের বাসায় গুগুল থেকে অনুবাদ করে কিছু একটা বলবেন, দোকানের সার্ভিস ম্যান সেটা হাসিমুখে ধৈর্য ধরে শুনবে, শুনে বলবে, বুঝি নাই, আবার বল। আপনি আবার বলবেন, এবার একটু বেশি সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করে মাখিয়ে ফেলবেন এবং সে আরও কনফিউজড হয়ে আপনাকে আবার বলতে বলবে, ততক্ষণে আপনার খিদের চৌদ্দ গুষ্টি মারা যাবে।

যারা নিজে রান্না করতে পারেন তাদের জন্য ব্যাপারটা একটু সহজ- কিন্তু ইউরোপ বড় অদ্ভুত দেশ, এই দেশে গাড়ি ছাড়া বেশিরভাগ জায়গাতেই নড়াচড়া করা যায় না। দেশে আপনি “এই রিকশা” বলে ডাক দিয়ে বাজারে গিয়ে দরদাম করে মটরশুঁটি কিনে নিয়ে এসে সেটা বোয়াল মাছ দিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলেছেন হয়ত- এই দেশে সেটা কঠিন ব্যাপার। এখানে বাজারে যাওয়া একটা ফর্মাল ব্যাপার-স্যাপারের মত- বিশেষ করে নতুনদের জন্য। যেহেতু আপনার গাড়ি নাই, আপনাকে এলাকার সব গাড়িওয়ালাকে বোকার মতো রিকোয়েস্ট করতে হবে- তাদের কারো দয়া হলে সে আপনাকে বাজারে নিয়ে যাবে।

সেই বাজার অনেকক্ষেত্রেই বাসা থেকে আধা ঘন্টা চল্লিশ মিনিট দূরে হবে এবং প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেটা হবে ইউরোপীয়ান দোকান- সেখানে পরিচিত মশলাপাতি কিছু পাবেন না। যা পাবেন সেটাই কিনে এনে বাসায় এসে রানা করে ফেলবেন; আপনি পাকা রাঁধুনি- তাতে হয়ত হলুদ-মরিচ-আদা-রসুন ছাড়াই রান্না কোনমতে উৎরে যাবে- কিন্তু সেটার টেস্ট কম- বরং রান্নার পর যেটা হবে সেটা গরমগরম আপনার নিজের মাথায় ঢেলে দিতে ইচ্ছা করবে। কয়েকদিন এইসব খেয়ে খেয়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেলে আশেপাশে কোন এক ভারতীয় অথবা পাকিস্তানি দোকানের সন্ধান পাবেন- সেখান থেকে আদা-রসুন-মরিচ-হলুদ-জিরা কিনে কষিয়ে ফার্মের মুরগি রেঁধে সেটা দিয়ে তিন বেলার ভাত এক বেলায় খেয়ে যখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে যাবেন তখন খেয়াল হবে যে অলরেডি কয়েক মাস পার হয়ে গেছে। রোজ রান্না করা সম্ভব না। কাজেই এরপর থেকে সপ্তাহে একদিন রাঁধবেন এবং তার পরের ছয়দিন সেই এক রান্না ফ্রিজ থেকে বের করে মুখ বাঁকা করে খাবেন

খাওয়ার সমস্যা আসলে সহ্য করে ফেলা যায়- যেটা সহ্য করা যায়না সেটা হল কথা না বলতে পারার কষ্ট।এর জন্য চাই যে দেশে আছেন সে দেশের ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা। কিন্তু এটা একজন পূর্ণ বয়ষ্কের জন্য খুবই কষ্টকর। একজন ততটুকু শিখতে পারে যতটুকু তার নিজের চলার জন্য প্রয়োজন। এজন্য ভাষাগত একটা বড় ব্যবধান থেকে যায়।

নিজের গল্প দিয়ে বোঝাই; যখন প্রথম ইউরোপ আসলাম বাসার সবাই দিনরাত কাজেই থাকেন তখন দরজা বন্ধ করে মোবাইল টিপা ছাড়া অন্য কিছু করার থাকে না , আর আমি একা একা পথেঘাটে ঘুরে বেড়াই। প্রতিদিন দেশে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলি- সেটা ছাড়া বাকি পুরো সময় জবান বন্ধ। প্রথম কয়েকদিন কষ্ট করে সহ্য করে নিলাম- কিন্তু এক সপ্তার মাথায় মনে হল, সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে দেশে চলে যাই। দেশে গিয়েই করবোটা কি? না হয় চলেই যেতাম। কিন্তু প্রবাসীরা কেবল স্বপ্নের বীজ বুনে যায়। মাস শেষে কষ্টের টাকা বাংলাদেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে একটা কথাই খালি মনে বাঝে- ‘সুখে থেকো তোমরা’।

আপনাদের কাছে অনুরোধ, যারা দেশে আছেন আর বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন অথবা পুত্র-কন্যা কিংবা স্বামী-স্ত্রী যেই প্রবাসী হোক না কেন সব কিছুর মধ্য দিয়ে প্রবাসীদের সেই কষ্ট, অনুভূতি, বেদনা, নীরব কান্না একটু বোঝার চেষ্টা করবেন। কোন কিছু বলে মনে কষ্ট দিবেন না। তাঁদেরকে যতখানি সম্ভব একাকিত্ব থেকে দূরে রাখবেন, তাঁদেরকে যতখানি সম্ভব নিজেদের কাছে রাখার চেষ্টা করবেন।

মন্তব্য করুন