

মুফতি আশেক হাসান কাসেমী:
মৌলবাদের পরিচয় ও জন্ম: ইংরেজি Fundamentalism শব্দ, যার বাংলা করা হয়েছে ‘মৌলবাদ’ শব্দটি দ্বারা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, শব্দটি প্রথম ১৯২২ সালে ব্যবহার করা হয় আমেরিকায়। ১৮০০ সালের পর থেকে শুরু হয় বিজ্ঞানের নতুন স্রোতে । সেই স্রোতধারায় ভেসে যাবার উপক্রম হয় খ্রিস্টধর্মের অনেক বিশ্বাস ও মতবাদ। সে সময় নাস্তিক্যবাদের (atheism) প্রসার ব্যাপকতা লাভ করে। তখন আমেরিকান খ্রিস্টানদের Protestant সমাজের একটি অংশ খ্রিস্টধর্মের সংরক্ষণের জন্য একটি আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন Milton এবং Lyman Stewart নামের দুই ভাই। তারা ছিলেন তেল ব্যাবসায়ী। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্ববধানে ৬৪ জন লেখক (যাদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত, পাদ্রী এমন কি মন্ত্রীও; কিন্তু কোনো মুসলমান অবশ্যই নয়) ধারাবাহিকভাবে ১২টি ভলিউমে খ্রিস্টধর্মের মূল বিষয়াদি বর্ণনা করেন। এই ভলিউমগুলোর নাম দেয়া হলো The Fundamentals. ধীরে ধীরে ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দেয়া অনেক খ্রিস্টান এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই মতবাদের নাম দেয়া হল Fundamentalism (মৌলবাদ) এবং এই মতবাদে যারা বিশ্বাস স্থাপন করতে লাগল তাদেরকে বলা হল Fundamentalist বাংলায় যার সরাসরি অর্থ হয় ‘মৌলবাদী’।
পাঠক অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করবেন যে, এই Fundamentals বা মৌলবাদের উৎপত্তির সঙ্গে কোরান-হাদিস-ইসলাম-মুসলমান এবং কোনো মুসলিম দেশের দূরতম সম্পর্কও নেই। কিন্তু এটা বড়ই দুঃখজনক এবং আফসোসের বিষয় যে, মৌলবাদের জন্মস্থান এবং সংরক্ষণাগার আমেরিকা আজ মুসলমানদেরকে মৌলবাদী বলছে এবং মুসলিম দেশসমূহে মৌলবাদ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এ কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, নাস্তিক্যবাদ (যা প্রতিহতের জন্য খ্রিস্টান তথা মার্কিন মৌলবাদের জন্ম) এবং ইসলামী পরিভাষায় প্রচলিত ‘কুফর’ একই অর্থ বহন করে না। নাস্তিক্যবাদের (atheism) অর্থ স্রষ্টাকে অস্বীকার করা এবং যারা এই কাজ করে তাদেরকে নাস্তিক (atheist) বলে। পক্ষান্তরে ইসলামের যে কোনো বিষয়কে অস্বীকার করাকে ‘কুফর’ বলে। যেমন আবু জেহেল, আবু লাহাব প্রমূখ স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে কাফের কারণ তারা ‘রিসালাতে’ অবিশ্বাসী ছিল। এই যুগেও ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ‘কাদিয়ানীরা’ সন্দেহাতীতভাবে ‘কাফের’ কারণ তারা বিশ্বাস করে না যে, হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। অথচ কাদিয়ানিদেরকে কেউ নাস্তিক বলে না।
একটি শয়তানী ও ছলছাতুরী: খোমেনির অনুসারী কিছু ইরানি ছাত্র ০৪-১১-১৯৭৯ ইংরেজিতে তেহরানস্থ আমেরিকান দূতাবাসে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৬৬ জন আমেরিকানকে পণবন্দী করে। দিন কয়েক পরে প্রথম দফায় ১৩ জন ও পরে ১ জন মোট এই ১৪ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকী ৫২ জনকে ছাত্ররা দীর্ঘ সময় ধরে আটক রাখে ও বিভিন্ন দাবী-দাওয়া উত্থাপন করতে থাকে। এই ৫২ জন সুদীর্ঘ ৪৪৪ দিন বন্দীদশায় অতিবাহিত করার পরে ২১-০১-১৯৮১ তে মুক্তি পায়। ঐ সময়ে পশ্চিমা মিডিয়া খোমেনির ও ইরানের বিপ্লবের আদর্শকে প্রচারের জন্য ইসলামী মৌলবাদ Islamic Fundamentalism) পরিভাষাটি তৈরি করে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, খোমেনি ছিলেন একজন কট্টর শিয়া। খোমেনির চিন্তা-চেতনা-মতবাদ ইত্যাদি ইসলামের শ্বাশত ধ্যান-ধারণার সাথে সাংঘর্সিক। সুতরাং এখানেও একথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে ‘ইসলামী মৌলবাদ’ আর ‘দ্বীন ইসলাম’ কস্মিনকালেও এক জিনিস নয় ।
বাংলাদেশে মৌলবাদের প্রয়োগ ও ধুর্তামি: ‘বাংলাদেশে মৌলবাদ বিস্তার লাভ করছে’ কিংবা ‘বাংলাদেশ মৌলবাদীদের দখলে চলে যাচ্ছে’ ইত্যাদি বলতে বলতে ইদানিং কিছু কিছু বিদেশি ও তাদের এদেশি বশংবদ দেশবাসীর ঘুম হারাম করে দেবার উপক্রম করেছে। এ কথাগুলোতে আসলে কি কোনো সত্য নিহিত আছে? এ প্রশ্নের সোজা সাপ্টা উত্তর হচ্ছে ‘না’। জঘন্য মিথ্যাচার ছাড়া এগুলো আর কিছুই নয় । মিথ্যাচার এ জন্য বলা হচ্ছে, কারণ এদেশে জনসংখ্যার ৫% জনও খ্রিস্টান নয়। তাহলে এদেশে Fundamentalism বা মৌলবাদ কীভাবে বিস্তার লাভ করে? দ্বিতীয়ত খোমেনির মতবাদই (যাকে কদর্থে ইসলামী মৌলবাদ বলা হয়ে থাকে) বা কীরূপে প্রতিষ্ঠা পাবে যেখানে এদেশের মুসলমানদের ৫% জনও শিয়া নয়! এদেশে শিয়াদের কোনো মাদরাসা নেই; অধিকন্তু এদেশের প্রতিটি ইসলাম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (কওমী কিংবা আলিয়া) ও সেসবের নেতৃবৃন্দ শিয়াদেরকে ইসলাম হতে বিচ্যুত একটি গোমরাহী দল বলে বিশ্বাস করে। এতে কারো কোনো সন্দেহ থাকলে যে কোনো মসজিদ-মাদরাসার ইমাম-উস্তাদদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখুন উনারা কী বলে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে অবস্থিত শিয়া মসজিদ ছাড়া এদেশের আর কোথাও শিয়াদের কোনো কার্যক্রম নেই। অতএব, ইরান কর্তৃক রফতানিকৃত তথাকথিত ইসলামী মৌলবাদ খুঁজতে হলে সর্বাগ্রে সেটা শিয়া মসজিদেই তালাশ করা উচিত। অথচ সেখানে সেনা-পুলিশ-র্যাব অভিযান পরিচালিত হতে কখনো শোনা যায়নি। এর কারণ কি অজ্ঞতা, না অনিচ্ছা, সেটা দেশের সরকারই বলতে পারবেন। বিপরীতে আমরা দেখি যে মৌলবাদ খুঁজতে আর মৌলবাদী ধরতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় সময়ে বিভিন্ন মাদরাসায় অভিযান চালায়, অনেক ক্ষেত্রে নিরীহ ছাত্র-ওস্তাদদের ধরে এনে নির্যাতন চালায়। সেলুকাস! সত্যিই বিচিত্র। যাদের আজীবন সাধনা মৌলবাদের (চাই সেটা আমেরিকার হোক কিংবা ইরানের হোক) বিরুদ্ধে, তাদেরকে অপবাদ দেয়া হয় মৌলবাদী নামে! বর্তমানের চিত্র হচ্ছে, ধর্মের কথা বললেই কিংবা ধর্মের দাওয়াত দিলেই মৌলবাদের তোকমা দিয়ে দেওয়া হয়। এটা যেমন সরকার করে, তেমন বিরোধী দল বা শক্তিগুলোও করে। এটা একটা ধুর্তামী ছাড়া আর কিছুই নয়।
মৌলবাদী নয় মুসলমান: মৌলবাদ একটি পারিভাষিক শব্দ যার রযেছে সুনির্দিষ্ট অর্থ। মসজিদ-মন্দির-গির্জার অর্থ যেমন সুনির্দিষ্ট, পাদ্রী–পুরোহিতকে ইমাম সাহেব বললে যেমন ভুল হয়, যুদ্ধকে জিহাদ বলা যেমন সত্যের অপলাপ, উপবাস যেরূপ রোজা হয় না, পীর-বুজুর্গকে সাধু-সন্ন্যাসী বলা যেমন ভুল; ঠিক তেমনি একজন মুসলমানকে মৌলবাদী বলে অভিহিত করা চরম অসাধুতা। যারা এ কাজ করে তারাই জ্ঞানপাপী।
লেখক, পরিচালক, খিদমাহ এ্যারাবিক একাডেমি
যাত্রবাড়ী, ঢাকা-১২০৪