সুনামগঞ্জের শাল্লায় নিরীহ হিন্দুদের বসতভিটায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় স্থানীয় যুবলীগ সভাপতি মূল হোতা হিসেবে জড়িত সত্ত্বেও কতিপয় সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যম প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ও ভেরিফিকেশন ছাড়াই সংঘবদ্ধভাবে হেফাজতে ইসলামকে জড়িয়ে অপপ্রচারণা চালানোর প্রতিবাদ জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী আজ সংবাদমাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে আজিজুল হক বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে যখনই কোনো ধরনের হামলা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তখনই আমাদের দেশের কতিপয় ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া লক্ষণীয়ভাবে হেফাজতে ইসলাম এবং দেশের ওলামায়ে কেরাম ও মাদ্রাসার ওপর দায় চাপিয়ে বিভ্রান্ত্রিকর ও প্রপাগান্ডামূলক সাংবাদিকতার চর্চা করে, যা সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিমালার পরিপন্থি। সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনা নিয়ে কয়েকটি ভারতপন্থী মিডিয়া ঘটনার গভীর অনুসন্ধান ও সংবাদের ভেরিফিকেশন নিশ্চিত না করেই সংঘবদ্ধভাবে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। অথচ পরবর্তীতে ঘটনার ভিন্ন বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে। এটিকে আমরা ইসলামবিদ্বেষী হলুদ সাংবাদিকতার ‘টেক্সটবুক উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছি।
তিনি বলেন, এটি প্রায়ই দৃশ্যমান যে, ইসলাম, মুসলমান, ওলামায়ে কেরাম ও মাদরাসা প্রশ্নে কিছু চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সবসময় প্রপাগান্ডার কলাকৌশল অবলম্বন করে থাকে। আর বিশেষত তৌহিদি জনতার আধ্যাত্মিক রাহবার ও হেফাজতে ইসলামের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী (দা.বা.) সম্পর্কে তারা ক্রমাগত মিথ্যাচার করে এসেছে। সাম্প্রতিককালে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক সম্পর্কেও তারা প্রপাগান্ডা চালানো শুরু করেছে। সচেতন তৌহিদি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আলেম-ওলামা গর্জে উঠলে কোনো বাতিল অপশক্তির রেহাই হবে না।
তিনি আরো বলেন, ইসলাম ও আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে সাংবাদিকতাকে প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ক্রমাগত ব্যবহার করার কারণে আজ কিছু মিডিয়া সচেতন জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়েছে। বিশ্বাসযোগ্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা শুধু সংবাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তা-ই নয়, বরং সাংবাদিকতার পেশাদার নীতিমালার মূল ভিত্তিও বটে। তাই, আমরা সেকুলার মিডিয়াগুলোর প্রতি সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণে আরো দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
শাল্লায় সংখ্যালঘু হামলার বিস্তারিত ঘটনা :
গত ১৭ মার্চ বুধবার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় নোয়াগাঁও গ্রামের এক যুবকের বিরুদ্ধে হেফাজত নেতা মামুনুল হককে কটূক্তি করে ফেসবুক পোস্ট দেয়ার অভিযোগ তুলে সেখানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলা করা হয়। আশপাশের গ্রামগুলোর কয়েক শত মানুষ জড়ো হয়ে এ হামলা চালান বলে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে। ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাটের ঘটনাও ঘটে।
প্রাথমিকভাবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও আলেমদের উপর এ ঘটনার দায়ভার চাপানো শুরু হয় কিন্তু পরবর্তি অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে এ ঘটনার মূল হোতা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং এ হামলা পুরোটাই রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে করা হয়েছে। জাতীয় দৈনিক যুগান্তর এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছে যে, হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে মামুনুল হকবিরোধী ফেসবুক স্ট্যাটাসের কোনো সম্পর্ক নেই বরং জলমহাল নিয়ে পূর্ববিরোধের জের ধরে ঝুমন দাশ আপনের আপত্তিকর ফেসবুক স্ট্যাটাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেই এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী অসীম চক্রবর্তী ও দীপক দাস জানান, হামলার মূল নেতৃত্বে ছিলেন দিরাই উপজেলার নাচনী গ্রামের বর্তমান ইউপি সদস্য সরমঙ্গল ইউনিয়ন যুবলীগের ওয়ার্ড সভাপতি শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ও একই গ্রামের পক্কন মিয়া।
তারা জানান, স্বাধীন মেম্বার ও পক্কন মিয়ার নেতৃত্বে মাইকে ঘোষণা দিয়ে তারা লোকজনকে সংগঠিত করে গ্রামে তাণ্ডব চালায়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাচনী গ্রামের স্বাধীন মেম্বার স্থানীয় বরাম হাওরের কুচাখাই বিলের ইজারাদার। জলমহাল নিয়ে স্বাধীনের সঙ্গে কিছুদিন ধরে ফেসবুকে কটূক্তির দায়ে গ্রেফতারকৃত যুবক ঝুমন দাশসহ নোয়াগাঁওয়ের কিছু লোকের বিরোধ চলছিল।
জলমহালে অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ ও জলমহালের পানি শুকানোর ফলে চাষাবাদে সেচের পানির সংকটের ব্যাপারে নোয়াগাঁওয়ের হরিপদ দাশ ও মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ দন্দ্র দাস শাল্লা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর স্বাধীন মেম্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ জানুয়ারি সরেজমিন কুচাখাই বিলে গিয়ে অবৈধ শ্যালোমেশিনসহ মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করে জলমহালের পানি ছেড়ে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মোক্তাদির হোসেন।
এ সময় বাঁধ কাটার কাজ করেন নোয়াগাঁও গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অকিল চন্দ্র দাসের ছেলে অমর চন্দ্র দাস ও পানি ছেড়ে দেয়ার দৃশ্য ফেসবুকে প্রচার করেন একই গ্রামের ঝুমন দাশ।
এ ঘটনায় স্বাধীন মেম্বার নোয়াগাঁও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিলেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। ঝুমন দাসের এ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে হেফাজতের অনুসারী ও তার নিজস্ব লোকদের দিয়ে বুধবার নোয়াগাঁও গ্রামে ভাংচুর ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ করেন গ্রামের অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার।
ভুক্তভোগীদের দাবি, মামুনুল হকের অনুসারীদের উসকে দিয়ে নিজের শরীরের ঝাল মেটাতে হিন্দুদের বাড়িতে তাণ্ডব চালান স্বাধীন ও তার অনুসারীরা। নোয়াগাঁও গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত শৈলেন চন্দ্র দাশ বলেন, স্বাধীন ও পক্কনের নেতৃত্বে আমাদের ঘরবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। তারা আমার ঘরের টাকা-পয়সা ও অলঙ্কার লুট করে নিয়ে গেছে। স্বাধীনের সঙ্গে আমাদের গ্রামবাসীর ঝামেলা চলে আসছিল। সে বরাম হাওরের কুচাখাই বিল সেচতে চায়, আর আমরা গ্রামবাসী বাধা দেই। বিল সেচার কারণে জমিতে পানি দেয়া যায় না। পানির অভাবে জমি ও ক্ষেত নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা ইউএনও সাহেবের কাজে অভিযোগ করেছি। অভিযোগকারী ছিলেন আমার কাকা হরিপদ দাশ। এ কারণেই হরিপদ বাবুর আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর বেশি ক্ষতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধা অকিল চন্দ্র দাশ বলেন, আমি ঘরে ছিলাম। আমার ঘরের দরজা ভেঙে সব কিছু তছনছ করে টাকা-পয়সা ও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটসহ অনেক কিছু নিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা বলার পরও তারা আমারে রেহাই দেয়নি। হামলা করেছে শত শত মানুষ। আমি শুধু পক্কন মিয়া ও স্বাধীন মেম্বারকে চিনতে পেরেছি। স্বাধীন মিয়ার সঙ্গে আমাদের বিরোধ ছিল। ওসি ও ইউএনও সাহেব যখন বাঁধভাঙার অনুমতি দিলেন তখন আমার ছেলে অমর চন্দ্র দাশ বাঁধ কাটে। এ কারণেই সে আমার ঘরে বেশি ভাংচুর করেছে। এ ঘটনায় স্বাধীন মেম্বারের বিচারের দাবি করেন তিনি।
এদিকে নোয়াগাঁও মাঠে এ ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত নাটেরগুরু স্বাধীনসহ সব অপরাধীর গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ২২ জনকে গ্রেফতার করলেও নাটেরগুরু স্বাধীন মেম্বার ও পক্কন মিয়া অধরা থাকায় এলাকায় চাপা ক্ষোভ ও শঙ্কা বিরাজ করছে। তবে পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, স্বাধীন ও তার পেছনে যারা জড়িত আছে সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। কেউ রেহাই পাবে না।