গত ১ মার্চ ভারতের গুজরাটের আহমদাবাদে বসবাস করা আয়েশা আরিফ খান নামের এক মেয়ে সবরমতী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার আগে একটি ভিডিও করেছেন তিনি। যে ভিডিওটি সবার মধ্যে প্রচন্ড চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
স্বামীর নির্যাতন, যৌতুকের দাবি, নিজ গর্বেই সন্তানের মৃত্যু এসব কারনে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে তার স্বামীকে লিখে যাওয়া একটি চিঠিতে জানিয়েছেন।
আত্মহত্যা করা ওই আয়শাকে নিয়ে এবার আবেগঘণ একটি বক্তৃতা দিয়েছেন ভারতের প্রভাবশালী মুসলিম রাজনৈতিক নেতা, সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের প্রেসিডেন্ট - আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের সামনে নারীদের নিয়ে দেয়া আবেগঘন সেই বক্তব্যটি ইতিমধ্যে নজর কেঁড়েছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার।
পাবলিক ভয়েসের পাঠকদের জন্য তার বক্তব্যটি অনুবাদ করে দেয়া হলো। অনুবাদ করেছেন - পাবলিক ভয়েস নির্বাহী সম্পাদক হাছিব আর রহমান।
ওয়াইসির বক্তব্য : ভারতের গুজরাটে আহমেদাবাদে বসবাস করা আয়েশা নামের যে মেয়েটির আত্মহত্যার হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমার সামনে এসেছে। আমি আপনাদের সকলের কাছে অনুরোধ করবো - আপনি যে সম্প্রদায়ের বা যে ধর্মেরই হন না কেন যৌতুক এবং নারী নির্যাতন নামের এই অভিশাপকে বন্ধ করুন। যদি আপনি পুরুষ হন তাহলে স্ত্রীর উপরে নির্যাতন করা বন্ধ করুন। কারন স্ত্রীর উপর নির্যাতন করা কোন পৌরুষত্বের পরিচয় নয়। স্ত্রীকে মারা কোন পুরুষত্ব নয়, স্ত্রীর কাছে যৌতুক চাওয়া, টাকা চাওয়া, এটা পুরুষ হওয়ার দাবি নয়।
যদি আপনি এমন কাজ করেন তাহলে আপনি নিজেকে পুরুষ বলার অধিকার রাখেন না।
ওই নিরপরাধ মেয়েটির উপর জুলুম করা হয়েছে। সে হতাশ হয়ে গেছে জীবন থেকে এবং অত্যাচার-নির্যাতনে বিরক্ত হয়ে এত বড় একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে। ওই পরিবারের সকল ব্যক্তিদের লজ্জিত হওয়া উচিত যারা আমাদের এই বোনটিকে এত বড় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করব আল্লাহ তায়ালা যেন তাদেরকে এর কঠোর সাজা দেয়।
আপনি কেমন পুরুষ যে আপনি মেয়েদের গায়ে হাত দেন। তাদেরকে মারেন, তাদের জীবন নষ্ট করার উপলক্ষ হন। আপনাদের মধ্যে মনুষত্ব কি হারিয়ে গিয়েছে!
তারা কেমন পুরুষ যারা স্ত্রীর কাছে যৌতুক চায়, তাদের গায়ে হাত দেয়, গর্ভবতী মায়ের উপর নির্যাতন করে, এরপর বাইরে বের হয়ে নিজেদেরকে নিষ্পাপ নিরপরাধ বলে।
মনে রেখো - তুমি মানুষকে ধোঁকা দিতে পারবা, সমস্ত দুনিয়াকে ধোঁকা দিতে পারবা, কিন্তু আল্লাহকে ধোকা দিতে পারব না।
মনে রাখবেন - আপনি যদি স্ত্রীদের গায়ে হাত দেন, তাহলে কিয়ামতের ময়দানে এই মারধরের এবং নির্যাতনের কঠোর হিসাব দিতে হবে।
আপনি বলেন যে, 'আমি হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা স. এর উম্মত কিন্তু লজ্জায় ডুবে মরা উচিত রাসূল স. এর উম্মত হয়ে আপনি মেয়েদের গায়ে হাত দেন, স্ত্রীদেরকে মারধর করেন। আপনি লজ্জিত হওয়া উচিত।
আপনার স্ত্রীদের কাছে যৌতুক চান অথচ ইসলামে যৌতুক চাওয়া হারাম! হারাম!! হারাম!!! আপনি শূকরের গোশত খান না কিন্তু যৌতুকের মত হারাম খাচ্ছেন। যৌতুকের অভিশাপকে বন্ধ করুন প্লিজ।
কবরে কি নিয়ে যাবেন? আপনি কোন মেয়ের উপর নির্যাতন করে কি নিয়ে কবরে যাবেন। কত সম্পদ আপনার প্রয়োজন! এ বিষয়গুলোকে গভীরভাবে চিন্তা করুনন। এই খারাপ এবং সমাজ বিধ্বংসী বিষয়গুলো বন্ধ করার সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং সমগ্র পৃথিবীর জন্য বলতে চাই আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ নিজ মেয়েদেরকে জান্নাতের রাজরাণী ভাবতেন। যখন নিজেদের মেয়ের সাথে দেখা করতে যেতেন, অথবা তারা রসূল সাল্লাল্লাহু ইসলামের কাছে আসতো তখন আমাদের নবী নিজের মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন সম্মান করতে। নবী স. এর মেয়ে ফাতেমার জন্য তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন। তাকে অভিবাদন জানাতে, আদর করতে নিজের কোলের কাছে এনে বসাতেন। অথচ আমরা কি করছি!
আমার প্রিয় বন্ধুরা - এখানে আমার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা রয়েছেন। আমি আমার রাজনৈতিক সকল দায়িত্বশীলদেরকে বলবো অন্যায় অবিচার এর বিরুদ্ধে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। যদি আমাদের কারো ঘরে এমন ঘটনা থাকে তাহলে সবার আগে তা দূর করতে হবে। যদি আমাদের পাড়া-মহল্লা এই ঘটনা কোথায় ঘটে তাহলে তাদেরকে বোঝাতে হবে এই পাপ কর্ম থেকে যেন তারা সরে আসে।
আমি আমার সকল মেয়েদেরকে বলবো - তোমাদের কোন ভয় নেই, তোমরা ভয় পাবা না, কখনো নিজের জীবন দেয়ার চেষ্টা করবা না। কখনো তুমি তোমার নিজের জীবন নষ্ট করবা না। আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমার মেয়েরা - তোমাদের জীবনের মূল্য রয়েছে আমাদের কাছে। যদি তোমাদের বাবারা কষ্টে থাকেন তাহলে মনে রাখবা আমরাও তাদের সাথে কষ্টে রয়েছি। কখনো নিজেদেরকে একা মনে করবা না। নিজেদের জীবন কখনো নষ্ট করবা না। কখনো নিজেকে ছোটো মনে করব না। ওই তাকে ছেড়ে দাও যে তোমার উপর নির্যাতন করে! লাত্থি দিয়ে চলে আসে তার কাছ থেকে। তারপরও নিজেকে রক্ষা করো। এমন ব্যক্তির তো প্রয়োজন নেই যে তোমার উপর নির্যাতন করে। যে তোমার কাছে যৌতুক চায়।
তোমাদের জীবন অনেক বড়। পায়ে ফেলে চলে আসে ঐ সমস্ত নির্যাতকদেরকে। আইনের ব্যবহার করো। আইনের আশ্রয় নাও। নিপীড়নের রিরুদ্ধে রুখে দাগাও। এমন অত্যাচার করা ব্যক্তিদের সাথে নিজের জীবন অতিবাহিত করার কোন প্রয়োজন নেই।
এরপর তিনি বলেন - একবার ভেবে দেখুন ওই বাবার উপর কি অতিবাহিত হচ্ছে যে ভিডিওতে দেখেছে তার মেয়ের মৃত্যুর সময়কে। এই ভয়ানক দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখে সে জীবিত থেকেও মরে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। তাই আমার প্রিয়জনেরা এই অন্যায়ের সমাপ্তি আমাদের দিয়েই হতে হবে। নির্যাতিত-নিপীড়িত সকল মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মেয়েদেরকে কখনোই অভিশাপ মনে করা যাবে না। ছোটো মনে করা যাবে না। নারীদের অগ্রগতি বাড়াতে আমাদের অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে।
যারা হিজাব পরিধান করে তারা কখনোই পিছিয়ে থাকবে না। বোরকা এবং হিজাব কখনও কোন উন্নতির বাধা হবে না। যদি আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কোন মেয়ে দান করেন তাহলে ছেলের থেকেও তাকে অধিক উপযুক্ত বানান। ছেলের থেকেও বেশি শিক্ষিত করে তুলুন। আমিও বাবা হয়েছি! আমারও সন্তান রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে অশেষ মেহেরবানি আমি আমার মেয়েদের জন্য আমার মধ্যে এত ভালোবাসা খুঁজে পাই যা আল্লাহতায়ালার আমার প্রতি অশেষ বড় মেহেরবানীতে।
হে আমার বন্ধুগন - এই কথাগুলো বলা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল তাই আজ বললাম। নারীদের রক্ষা করুন। তাদের বাঁচান।
ভিডিও :
প্রসঙ্গত : এ বিষয়টি আরও বিস্তারিতভাবে বুঝার জন্য ও আয়শার সকল অভিব্যক্তি জানার জন্য নিচের লেখা দুটি পড়তে পারেন।
লেখা - ১ : মৃত্যু কত অদ্ভুত...
আত্মহত্যার আগে দেয়া গুজরাটের আয়শার ভিডিও বার্তাটা দেখলাম। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা ভয়াবহ ব্যাথা অনুভুত হলো। মেয়েটা সাহসি ছিলো খুব কারন আমার পক্ষে কোনদিন সম্ভব হবে না মৃত্যুর আগে এমন স্বাভাবিক থাকা। এমন হাসিখুশিভাবে মিষ্টি রকমের ভিডিও দেয়া। মজার বিষয় হলো এই ভিডিওটা দেখার আগে আমি আর একটা ভিডিও দেখেছি যেখানে একটি মেয়ে ভ্যাকভ্যাক করে কাঁদতেছে তার বিড়াল মারা গেছে সেজন্য। এবং সে কান্নাটা খুবই হাস্যকর লেগেছে আমার কাছে। আসলেই পৃথিবীটা কত অদ্ভুত। তাই না!
গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে আয়শার স্বামী আরিফ খান ও তার পরিবারের অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে মেয়েটি। মৃত্যুর আগে নিজের পরিচয় দিয়েছে আয়শা আরিফ খান বলে। হাসিখুশিভাবে বলেছে যে - ‘আমি খুব খুশি আর শান্তিতে মরতে চাই। আমি লড়াই করতে চাই না। আমি আরিফকে ভালবাসি।’
কারো প্রতি কোন রাগ-ক্ষোভ নাই তার। কারো প্ররোচনা বা চাপে পড়েও সে আত্মহত্যা করছে না। ভিডিও প্রকাশের পর 'সবরমতী' নদীতে ঝাপ দিয়েছে সে। কিন্তু এটুকু সবর তার করা উচিত ছিলো। এটুকু ধৈর্য তার ধরা উচিত ছিলো। মেয়েটার জন্য খুবই খারাপ লাগছে আসলে। একে তো আয়শা নাম, দ্বিতীয়ত গুজরাটের মত একটি জায়গায় বসবাস। এছাড়াও খুবই আত্মসম্মানবোধের মেয়ে মনে হয়েছে তাকে। তাই এমন মৃত্যুটা সত্যিই হৃদয়ে দাগ কেটেছে।
আয়শার বাবাকে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেছিলো। তার বাবা কান্নায় কথা বলতে পারছিলেন না। তবে খুব দামি একটা কথা তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন যে - 'অনেক তো হিন্দু মুসলিম লড়াই হয়েছে। আমার আয়শা তো চলে গেছে, আর সে ফিরে আসবে না। কিন্তু অন্য আয়শাদের বাঁচাতে সাহায্য করুন আপনারা'।
বাবার উদ্দিশ্যেও মেয়েটির খুব আদরের বার্তা ছিলো। বাবেকে সে বলেছে - ‘বাবা, আর কতদিন আমরা আপনজনদের সঙ্গে লড়াই করব? আয়েশাকে আর লড়াই করতে বলো না কারণ আয়েশা আর যুদ্ধ করতে চায় না। আরিফ যদি স্বাধীনতা চায়, তাহলে বলি ও মুক্ত। আসো বাঁচি, এটাই সুযোগ। আমি খুশি। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে দেখা হলে আমি জানতে চাইব কী ভুল করেছিলাম আমি? দারুণ বাবা-মা, বন্ধুদের পেয়েছিলাম। তবু ভাগ্যে কিছু একটার অভাব রয়ে গেল। আমার আর কিছু বলার নেই। মেনে নিচ্ছি যে আল্লাহ তায়ালা আমাকে স্বল্প আয়ু দিয়েছেন।’
প্রতিটা কথাই পূর্ণাঙ্গ আবেগে ভরপূর ছিলো। মেয়েটি কোনভাবে বেঁচে গেলে কতটা খুশি হতাম বুঝানো যাবে না। শেষ কথায় অত্যন্ত সাবলিলভাবে সে বলেছিলো - ‘এই নদীটা ভীষণ সুন্দর। আশা করছি এটা আমাকে গ্রহণ করবে। আমি হাওয়ার মতো, আমি বয়ে যেতে চাই, আমি খুশি, আমার জন্য দোয়া করুন। জানি না জান্নাতে যেতে পারব কি না।’
এরপর সে নদীতে ঝাপ দিয়েছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। জান্নাত প্রত্যাশী ছিলো সে বারবার। কিন্তু আত্মহত্যার ব্যাপারে ইসলাম কঠোরতা প্রকাশ করেছে। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসায় বলেছেন - ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর করুণাময়।’ বুখারী শরীফের হাদিসেও রাসুল স. বলেছেন - হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন - রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও তার সেই যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, তার সেই যন্ত্রণাকেও জাহান্নামে অব্যাহত রাখা হবে।’ (সহিহ বুখারি, খণ্ড ২, হাদিস নং ৪৪৬)
তারপরও আল্লাহ তায়ালা চাইলে যে কোন কাউকেই ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে আত্মহত্যা পৃথিবীতে কোন কিছুর সমাধান নয়। পারিবারিক যন্ত্রণা ও স্ত্রীদের প্রতি স্বামীর অবজ্ঞা মেয়েরা কখনওই মেনে নিতে পারে না। এটা তাদের কুড়ে কুড়ে খায়। তাই স্ত্রীর প্রতি যত্নশীল হওয়া, তাকে পাঠ করা ও বুঝতে পারা একজন প্রকৃত পুরুষের গুন।
[আয়শা (বায়ে) আত্মহত্যার আগে করা ভিডিওটিতে এমন হাসিখুশি ছিলো মেয়েটি। আয়শা ও ও তার স্বামী আরিফ খান। (ডানে) বিয়ের সময়কার ছবি। ]
লেখা - ২ : কত বেদনার মৃত্যু...
গুজরাটের আয়শা নামের সেই মেয়েটির আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া একটি চিঠি পড়লাম আজ।
ছোট্ট ওই চিঠিটাতে অভিমান, প্রেম, কষ্ট, স্বামীর প্রতি মায়া, স্বামীর নির্যাতন, অনাগত সন্তানের প্রতি দরদ থেকে নিয়ে সবকিছু ভরপূর ছিলো। ছিলো সংসার জীবনে থাকা প্রতিটি মানুষের জন্য এক অনুপম শিক্ষা। ছেলে-মেয়ে সবার জন্য।
এখানেও মেয়েটি মৃত্যুসময়ের মত করেই তার চিরাচরিত সৌন্দর্য প্রকাশ করে গেছে। স্বামী আরিফ খানের কাছে নিজের মান-অভিমান আর দুঃখকে ফুটিয়ে রেখে গেছেন বেশ প্রেম মাখানো স্ত্রী-সূলভ নারীত্বের সাথেই।
একদম ইতিতে সে আরিফের জন্য লিখে রেখেছে - 'লাভ ইউ, ইতি : তোমার স্ত্রী - আয়শা আরিফ।'
চিঠির সর্বশেষে মেয়েটি লিখেছিলো; 'আরিফ - আমি তোমার চোখের প্রেমে পড়েছিলাম। ফিদা ছিলাম তোমার চোখ দুটোর জন্য। কেন ছিলাম - তা পরবর্তি জীবনে বলবো তোমাকে'। :'(
- এটা কতটা নিস্পাপ প্রেম স্বামীর জন্য তা বলতে পারবো না। স্ত্রী যখন স্বামীকে বলে - আমি তোমার চোখের প্রেমে পড়ে আছি, তোমার চোখের জন্য ফিদা আমি, এরচেয়ে কোন প্রেম হয়ত আর নেই কোথাও।
- এত প্রেমের পরও মেয়েটি বাঁচতে পারেনি। নিজেকে সঁপে দিয়েছে মৃত্যুর দুয়ারে। শুধু একটি মেয়ের প্রেম আর পূর্ণতাই যে সংসার বাঁচিয়ে রাখতে পারে না বরং পুরুষের সর্বোচ্চ সম্মিলন লাগে তা এ ঘটনাটায় বুঝতে পারছি আমি।
মেয়েটি চিঠিতে লিখেছে - 'তুমি তোমার দুস্কর্ম ঢেকে রাখার জন্য আমার চরিত্রে কালিমা লেপন করেছো। আমাকে জড়িয়ে দিয়েছো আসিফের সাথে। অথচ আসিফ আমার একজন বেস্টফ্রেন্ড ছিলো, আমার ভাই ছিলো।"
- ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু এই একজন জাস্ট ফ্রেন্ড। আয়শা এখানে ভুল করেছে তা বলবোই আমি। যদিও মৃত্যু দিয়ে মেয়েটি তার ভুলটুকুর বেশ কঠিন প্রায়শ্চিত্ত করে গেছে। এই জাস্টফ্রেন্ডকে জড়িয়েই তার স্বামী আরিফ তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়েছিলো। তবে এটা হয়ত একটা উসিলা ছিলো মাত্র। মৃত্যুর সময়ে করা সে হাসিখুশির ভিডিওতে মেয়েটি কোন নির্যাতনের কথা না বললেও রেখে যাওয়া চিঠিতে রোমহর্ষক একটি বর্ণনা ঠিকই দিয়ে গেছে। মনোবলে আঘাত করে গেছে তার স্বামীর।
চিঠিতে আরিফকে উদ্দেশ্য করে তার উপর হওয়া নির্যাতনের বিষয়ে মেয়েটি লিখেছিলো - 'তুমি আমাকে চারদিন একটি রুমে বন্দি করে রেখেছিলে। ওই সময় আমাকে খাবার-পানিটুকু দাওনি। সে সময় আমি প্রেগনেন্সিতে ছিলাম। তোমার আমার অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় ছিলাম। ওই সময়টাতেও তুমি আমাকে একটু সাহায্য করোনি। চারদিন পরে এসে কি করেছিলে মনে আছে! নাহ - কোন প্রেম করোনি। বরং আমাকে মেরেছো। মনমতো মেরেছো। যে মার খেয়ে কেবল আমি মানসিকভাবেই ভেঙ্গে যাইনি বরং আমার পেটে থাকা ছোট্ট সেই জুনিয়র আরিফও সেখানেই জীবনত্যাগ করেছে। তাই - আমিও অনাগত সময়ে তার কাছেই চলে যাচ্ছি"।
- এই লেখাটুকুতেও মেয়েটি নিজের নির্যাতনের বিষয় লিখতে গিয়ে তার গর্ভের বাচ্চাটিকে সম্বোধন করেছে 'জুনিয়র আরিফ' বলেছে। ভাবা যায়! তার সতিত্ব আর স্বামী বিষয়ে কতটা সতর্ক ছিলো আয়শা। কেন জানি না - আমি এই মেয়েটিকে পড়তে পারছি খুব করে। বুঝতে পারছি তাকে।
'আমি তোমাকে ধোকা দেইনি কখনও। বিশ্বাস রেখো। কিন্তু তুমি খুব হেসে-খেলে দুটো জীবন নষ্ট করে দিয়েছো। আই লাভ ইউ কুকু। আমি কখনওই ভুল ছিলাম না। বরং আমাকে নিয়ে তোমার অভ্যাসটাই ভুলে ভরা ছিলো।' অভিমানি মেয়েটি আরিফের মনোবলে চিঠির এ অংশটুকু দিয়ে চরমভাবে আঘাত করে গেলো। সীমা আর গণ্ডিতে থেকেই বুঝিয়ে দিলো নিজ স্বামীর অন্যায়টুকু।
- 'কুকু' নিশ্চয় আরিফের জন্য আয়শার দেয়া নাম। স্ত্রী তার স্বামীকে এ ধরণের নাম কখন দেয়। কতটা প্রেমে রাখলে দেয় তা যারা এমন কোন নামে সম্বোধিত হয় তারাই জানে। বাড়িতে আমার স্ত্রী আমাকে 'বুলবুল' বলে ডাকে। হাছিবুল থেকে বুল-বুল। অথচ আমার এটা নাম না। আমার নানা আমাকে হাছিবুল ডাকতো। বিয়ের মাস দেড়েক পর সম্ভবত আম্মা একদিন এটা বলছিলেন। তার সামনে আমাকে। সেখান থেকেই নামটিকে এভাবে সাজিয়েছে সে। এই নাম দেয়ার মায়া মর্ম আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। অনুভব করি।
আয়শা তার জীবনের শেষ আশাটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলো। নৈতিকতা, স্বামীপ্রেম, চরিত্রে আঘাত, অনাগত সন্তান সবকিছুতেই আঘাতপ্রাপ্তা হয়েছে। আশাহত হয়েছে। বিনিময়ে জীবনটা দিয়ে গেছে একদম।
আয়শার স্বামী গ্রেফতার হয়েছে। রিমাণ্ড হয়েছে। পুলিশ তাকে কোর্টে উঠিয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও মোটামুটি প্রমানের কাছাকাছি। তার হয়ত শাস্তি হবে। জীবন তারও অগোছালো হয়ে যাবে। কিন্তু একজন 'আয়শা' সে তার জীবনে আর কোনদিনই পাবে না। পাবে না আয়শার পেটে থাকা জুনিয়র আরিফকেও।
প্রতিবেদন : হাছিব আর রহমান।