বিশেষ রিপোর্ট-
আল্লামা আহমদ শফীর নামে কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদরাসার মুহতামিম ও কক্সবাজার জেলা ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র সভাপতি মাও. মোহাম্মদ আলী মামলা করেছেন বলে একটি সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে।
প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া কক্সবাজার জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ' ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কক্সবাজার জেলা শাখার নেতৃবৃন্দের একাংশ একত্রিত হয়ে মাও. মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমনকি তারা মাও. মোহাম্মদ আলীকে কক্সবাজারে অবাঞ্চিত ঘোষণা করারও হুমকি দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন যে, মাওলানা মোহাম্মদ আলী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
এই বিষয়ে পাবলিক ভয়েস এর পক্ষ থেকে একটি অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ঘটনাটি মূলত মাওলানা মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত কিংবা ইসলামী আন্দোলন সংশ্লিষ্ট নয় বরং এ ঘটনা সম্পর্কিত লাইট হাউজ মাদরাসার সাথে।
এ বিষয়ে কথা হয়েছে কক্সবাজার জেলা ইসলামী আন্দোলনের সেক্রেটারি ও কক্সবাজার ৪ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে নির্বাচন করা মাওলানা শোয়াইব এর সাথে। তিনি পাবলিক ভয়েসকে বলেন,
“কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদরাসা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। একটি মহল মাদরাসা থেকে মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে সরিয়ে দিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে” সর্বশেষ তারা এই ঘটনার সাথে সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুরুব্বী ও হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে জড়িয়েছে! যা মোটেও কাম্য নয়।
মাদরাসার মুহতামিম (পরিচালক) হিসেবে মাওলানা মোহাম্মদ আলী সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি এবং তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এই মাদ্রাসাটি এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন এবং তিনি বিষয়টির সুন্দর নিস্পত্তি চান। তাছাড়া এই ঘটনার সাথে আল্লামা আ. হালিম বোখারী সংশ্লিষ্ট আছেন তাই এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে মুরুব্বী পর্যায়ের এই আলেমদের সম্মান বিনষ্ট হয়।
সূত্র থেকে জানা গেছে, লাইট হাউজ মাদরাসা নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে ছিল এবং এই বিরোধ নিস্পত্তির জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম এবং আর একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী। কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদরাসাটি মূলত আল্লামা আব্দুল হালিম বুখারী পরিচালিত চট্টগ্রাম ভিত্তিক কওমী মাদরাসা বোর্ড “ইত্তেহাদুল মাদারিস” অন্তর্ভুক্ত কিন্তু সেই সেই বোর্ড থেকে লাইট হাউজ মাদরাসাকে বের করে বেফাক অন্তর্ভুক্তির নামে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যারা এই চেষ্টা চালাচ্ছে তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আল্লামা আহমদ শফীকে লাইট হাউজ মাদরাসার “ছদরে মুহতামিম” (প্রধান পরিচালক) ঘোষণা করে দেয়। মাওলানা মোহাম্মদ আলী তা মেনে নিয়ে আল্লামা আহমদ শফীকে ছদরে মুহতামিম হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তিনি মাদরাসার মুহতামিম (পরিচালক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু কওমী মাদরাসা শিক্ষার সম্মিলিত বোর্ড “আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল ইসলামিয়া” এর গঠনতন্ত্রে নিয়ম করা হয়েছে “পূর্ব থেকে কোন বোর্ডের সাথে অন্তর্ভুক্ত কোন মাদরাসা কে অন্য কোন বোর্ড তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে না”। লাইট হাউজ মাদরাসা যেহেতু চট্টগ্রামের কওমি মাদরাসা বোর্ড ইত্তেহাদ অন্তর্ভুক্ত তাই সেটাকে বেফাক অন্তর্ভুক্ত করা হাইয়াতুল উলয়ার নীতি বহির্ভূত। তারপরও আল্লামা শফী সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা তখন তেমন কোনো কথা বলেননি।
এর কিছুদিন পর গত ৬ ডিসেম্বর মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আল্লামা আহমদ শফী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দিয়ে মাদরাসা থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের নোটিশ দেওয়া হয় যেখানে বহিস্কারের কারণ হিসেবে তিনি ইসলামী আন্দোলনের সাথে রাজনীতি করেন এটাও দেখানো হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি সমাধানের অনেক চেষ্টা করা হয় কিন্তু সমাধানের দিকে না গিয়ে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে এমনকি মাদরাসায় ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল, ক্লাস বর্জন ও আরো অনেক ধরনের তিক্ততার সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন : কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদরাসায় ছাত্রদের বিক্ষোভ ও পরিক্ষা বর্জন।
এরপর অনেকটা বাধ্য হয়ে মাদরাসা কমিটির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে মাও. মোহাম্মদ আলী বিষয়টি কক্সবাজার আদালতে উপস্থাপন করেন। (আদালতে মামলা নং-১৯/২০১৯) তাতে আল্লামা আহমদ শফিসহ ৩ জনকে মূল বিবাদী করা হয়। বাকী দুইজন হলেন- মাওলানা হাচ্ছেন মোহাম্মদ দিদার ও মাওলানা ইয়াসিন হাবিব। মোকাবিলা বিবাদী করা হয়েছে আরো ১৯ জনকে।
আদালত “হাইয়াতুল উলয়ার নিয়ম আমলে নিয়ে” মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে তার পদ থেকে বহিষ্কার অবৈধ ঘোষণা করে অর্থাৎ মাও. মোহাম্মদ আলীকে মাদরাসার মোহতামিম হিসেবে স্বপদে বহাল করেন। গত সোমবার (২১ জানুয়ারী) কক্সবাজার যুগ্ম-জেলা জজ ১ম আদালতের বিচারক ছৈয়দ মোহাম্মদ ফখরুল আবেদীন এ আদেশ দেন। যেহেতু তাকে বহিষ্কারের চিঠি আল্লামা আহমদ শফী স্বাক্ষরিত ছিল তাই আদালত সেই চিঠিকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় এবং সেই চিঠির ঠিকানায় “মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে তার পদ থেকে বহিষ্কার কেন অবৈধ হবে না” তা জানতে চাওয়া হয়। এটাই মুলত “মাওলানা মোহাম্মদ আলী আল্লামা আহমদ শফীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন” বলে প্রচারিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন : কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদরাসার সমস্যা সমাধান আদালতের রায়ে
সূত্র থেকে আরো জানা গেছে, পূর্ব থেকেই কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদরাসার ঘটনা সমাধানের চেষ্টা করছেন পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী আল্লামা শাহ আহমদ শফী বরাবর একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন বিষয়টি সুন্দর সমাধানের জন্য কিন্তু হাটহাজারী থেকে সে চিঠির কোন জবাব দেয়া হয়নি।
তবে এসব বিষয়ে কক্সবাজার জেলা হেফাজতের দায়িত্বশীল একজনের সাথে কথা বললে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
মাওলানা মোহাম্মদ আলী আল্লামা আহমদ শফীর সাথে বেয়াদবি করেছে এবং তার কাছে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে। মাওলানা পরিচয় কেউ এমন কাজ করতে পারে না। আল্লামা আহমদ শফী আমাদের মুরুব্বী ও এ দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম। তার বিষয়ে এমন কোন কাজ আমরা মেনে নেব না। মাও. মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যাবস্থা নেবো।
এ বিষয়ে হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর পুত্র মাও. আনাস মাদানীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলী সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তার মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পরও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে এর আগে এক বিবৃতিতে মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুহাম্মদ আলী পাবলিক ভয়েসকে বলেছেন, মাদরাসার সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনি ফোরাম মজলিশে শুরার এক সিদ্ধান্তে হাটহাজারী মাদরাসার মহা পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফিকে লাইটহাউজ মাদরাসার ছদরে মুহতামিম (প্রধান পরিচালক) নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি ছদরে মুহতামিম নিযুক্ত হওয়ায় মাদরাসাটি দ্রুত তার লক্ষ্যপানে পৌঁছতে সক্ষম হবে। এ জন্য মাওলানা মোহাম্মদ আলী মহান আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া এবং মজলিশে শুরার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
প্রসঙ্গত : ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট যাদের সাথেই কথা বলা হয়েছে সকলেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বী আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সম্মান রক্ষায় সবাই সচেষ্ট থাকা এবং "মামলাটি মাদরাসা সংশ্লিষ্ট, আল্লামা আহমদ শফী সাহেব সংশ্লিষ্ট নয়" দিকে খেয়াল রাখার অনুরোধ করেছেন।