আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি তাদের ওপরে অবস্থিত আকাশের দিকে তাকায় না! কীভাবে আমি তা বানিয়েছি, সুশোভিত করেছি এবং তাতে কোনো ফাটলও নেই? (সুরা কাফ, আয়াত : ৬)
পবিত্র কোরআনের এই বাণী বুকে ধারণ করে যুগে যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা আকাশবিদ্যা চর্চায় ব্রতী হয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। মধ্যযুগের বিজ্ঞানী আল-সুফিকে বলা হয় ৯ জন শ্রেষ্ঠ মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীর একজন।
আল-সুফি ৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ইরানের রায় শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম আবদুর রহমান আল-সুফি, পশ্চিমে তিনি অ্যাজোফি নামেই সমধিক পরিচিত। শৈশব থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি ছিল অদম্য আগ্রহ। দিনাওয়ার ও ইসফাহান শহরে তিনি দীর্ঘদিন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের পাঠ গ্রহণ করেন।
আল-সুফি যখন জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা শুরু করেন, তখন গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল মৃতপ্রায়। টলেমির আল-ম্যাজেস্ট রচনার প্রায় সাড়ে আট শ বছর গত হয়েছে। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংস্কার ও নবায়নে মনোযোগ দেন আল-সুফি।
মহাকাশ ও নক্ষত্র নিয়ে আরবিতে অনেক বইপুস্তক রচনা করেন, যা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এক সময় তার প্রজ্ঞার কথা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইরানের বুয়িদ সাম্রাজ্যের সুলতান আদুদ-আদ্দাওলার রাজসভায় জ্যোতির্বিদ হিসেবে জায়গা করে নেন।
বিজ্ঞানী টলেমির বিখ্যাত আল-ম্যাজেস্ট বইয়ের অনুবাদ ও সম্প্রসারণ কাজ করেন তিনি। সময়ের আবর্তনে এবং সীমাবদ্ধতার কারণে টলেমির আবিষ্কৃত নক্ষত্র সম্পর্কিত তথ্যে নানা ভুল ধরতে সক্ষম হন তিনি।
সেসব সংশোধনও করেন তার বইপত্রে। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া কেন্দ্রীক গড়ে ওঠা হেলেনিস্টিক জ্যোতির্বিদ্যার আরবি অনুবাদের প্রধান কারিগর হিসেবেও তার নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। তারকাগুলোর গ্রিক ও ঐহিত্যবাহী আরবি নামের ব্যাপক বৈসাদৃশ্য ছিল, তিনিই সর্বপ্রথম সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন।
তার রচিত ‘সুয়ার আল-কাওয়াকিব’ তথা ‘বুব অব ফিক্সড স্টারস’ জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক বিশ্বনন্দিত কালজয়ী গ্রন্থ। বইটি রচনার উদ্দেশ্য ছিল যারা আকাশ দেখতে ভালোবাসে তাদের সঠিকভাবে নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় করানো।
বইয়ে তিনি ৪৮টি নক্ষত্রের নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো স্থান থেকে নক্ষত্রগুলো দেখা যাবে তাও অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, নক্ষত্রের রং ও আয়তন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়েছেন।
প্রত্যেক নক্ষত্রপুঞ্জের দুটি করে ছবি তিনি এঁকেছিলেন, যা বইয়ের অন্যতম বিস্ময়। একটি পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকানোর দৃষ্টিকোণে, দ্বিতীয়টি পৃথিবীর বাইরে থেকে আকাশের দিকে তাকানোর দৃষ্টিকোণে।
এছাড়াও বইয়ে তিনি ‘লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড’-এর ধারণা দিয়েছিলেন, যা কয়েক শতক পর আমেরিগো ভেসপুচি ও ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান আবিষ্কার করবেন।
এই বইয়ে আধুনিক কম্পাসের প্রাচীন রূপ অ্যাস্ট্রোল্যাবের আলোচনাও করেছেন তিনি। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পুরতে জ্যোতির্বিজ্ঞানে অ্যাস্ট্রোল্যাবের ব্যবহার শুরু হয়।
বইয়ে তিনি এই যন্ত্রের ১ হাজার ব্যবহার দেখিয়েছেন। জাহাজের দিক নির্দেশনা, ভূমি জরিপ, সময় নিয়ন্ত্রণ, নামাজের সময় এবং কেবলার দিক নির্দেশনা ইত্যাদি তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আল-সুফির আবিষ্কারগুলো পরবর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী যুবরাজ উলুগ বেগ তারই ভাবশিষ্য। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আল-সুফির কালজয়ী গ্রন্থ ‘বুক অব ফিক্সড স্টারস’ এখনো ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়নি।
বিজ্ঞানী আল-সুফির স্মরণে ২০০৬ সাল থেকে ইরানের অ্যাস্ট্রোনমি সোসাইটি ‘সুফি অবজার্ভিং কম্পিটিশন’-এর আয়োজন করে। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘গুগল ডুডলস’ আল-সুফির ১১১৩তম জন্মবার্ষিকী উৎযাপন করে।