যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন জো বাইডেন। এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন কমলা হ্যারিস।
বড় কোনো সংকট দেখা না দিলে আগামী চার বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকছেন তিনিই। সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকছেন কমলা হ্যারিস।
স্থানীয় সময় বুধবার বেলা ১১টার পর ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনে শপথ নেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট। তাকে শপথবাক্য পাঠ করান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। এর আগে, নির্ধারিত সময় সকাল ১০টার দিকেই ক্যাপিটলে পৌঁছান জো বাইডেন। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী জিল বাইডেন, নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস প্রমুখ।
একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন কমলা হ্যারিস। স্থানীয় সময় বুধবার বেলা ১১টার পর ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনে শপথ নেন তিনি।
আমেরিকার আড়াইশ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে কমলা হ্যারিসের নাম আলোচনার শীর্ষভাগে উঠে আসে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে যখন তিনি মার্কিন সিনেটর থেকে সোজা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নাম লেখান। কৃষ্ণাঙ্গ, তরুণ ও উদীয়মান রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ছিলেন উদারপন্থীদের কাছে সেরা পছন্দ। মনোনয়নের প্রাথমিক লড়াইয়ে সাধারণ প্রতিযোগী হিসেবে নামলেও অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথম সারিতে চলে আসেন কমলা হ্যারিস। বছরের শেষভাগে দেখা যায় একমাত্র আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে ডেমোক্রেট প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে টিকে রয়েছেন এ সিনেটর।
স্থানীয় সময় আজ বুধবার দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের কাছে শপথবাক্য পাঠ করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস শপথ নিয়েছেন বিচারপতি সোনিয়া সোটোমেওরের কাছে। সংবাদমাধ্যম সিএনএন ও এনবিসি এ খবর জানিয়েছে।
নজিরবিহীন নিরাপত্তার মধ্যে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। প্রথা ভেঙে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেননি বিদায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথের আগেই হোয়াইট হাউজ ছেড়ে ফ্লোরিডায় পাড়ি জমান তিনি।
শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন ও জর্জ ডব্লিউ বুশ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। ট্রাম্প না থাকলেও বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
শপথ নেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম ভাষণে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। বাইডেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিভক্তিকে ছাপিয়ে সব সময় ঐক্যের জয় হয়েছে।
এ ছাড়া বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলতে চান বলেও অঙ্গীকার করেন।
এদিকে নতুন প্রেসিডেন্টকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত ছিল ক্যাপিটল হিল। অন্যবারের চেয়ে এবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল আরো কঠোর। মোতায়েন ছিল ২৫ হাজার সেনা।
ওয়াশিংটন শহরের বেশিরভাগ অংশেই চলাচল আটকে দেওয়া হয়। শপথ অনুষ্ঠানে গণজমায়েত এড়াতে এবার জনগণকে বাড়িতে বসেই ভার্চুয়ালি বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠান দেখার অনুরোধ জানানো হয়।
এদিকে, শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে বুধবার সকালে ওয়াশিংটন ডিসির সেন্ট ম্যাথিউ গির্জায় হাজির হয় বাইডেনের গাড়িবহর। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী জিল বাইডেন। ক্যাথিড্রালে বাইডেনের পরিবারের অন্য সদস্যরা, নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস তাঁর পরিবারসহ প্রার্থনায় যোগ দেন।
মহামারির সময়ে হলেও এবার বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গান লেডি গাগা। মঞ্চ মাতান জেনিফার লোপেজসহ একাধিক তারকা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দুইবার অস্কারজয়ী হলিউড অভিনেতা টম হ্যাংকস।
জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের বিস্তারিত বৃত্তান্ত :
কে এই জো বাইডেন : পুরো নাম জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র। তবে সংক্ষিপ্ত জো বাইডেন নামে পরিচিত তিনি। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য় বাইডেন দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে অ্যাটর্নি হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এরপর নেমে পড়েন রাজনীতির ময়দানে। নিজ রাজ্য ডেলাওয়ারে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সিনেটর ছিলেন তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ৪৭তম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করে জো বাইডেন।
জন্ম : ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর জো বাইডেনের জন্ম। বাবা জোসেফ রবিনেট বাইডেন সিনিয়র, মা ক্যাথরিন ইউজেনিয়া ফিনেগান। মা আইরিশ বংশোদ্ভূত। উত্তরপূর্ব পেনসিলভেনিয়ার স্ক্র্যানটনে বেড়ে ওঠেন তিনি। বাবা বাইডেন সিনিয়র ছিলেন ফারনেস ক্লিনার। তবে জীবনের বড় একটি সময় তার কেটে গেছে গাড়ির সেলসম্যান হিসাবেও। ছোটবেলা থেকে প্রবল দারিদ্রের মাঝে বড় হয়েছেন মার্কিন এই রাজনীতিক।
নিজের মানসিকতা দৃঢ় করতে বাবা-মায়ের অবদান এবং দারিদ্রতাকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। যে দারিদ্রতা আর কঠিন জীবনযাত্রা তাকে একজন পোক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছে; তা অনেক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন বাইডেন।
পড়াশোনা ও শিক্ষা-জীবন : স্ক্র্যান্টনে সেন্ট পালস এলিমেন্টরি স্কুলে পড়াশোনা করেন বাইডেন। ১৩ বছর বয়সে পরিবার-সহ ডেলাওয়ারে আসেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বাচনশক্তিতে সমস্যা ছিল বাইডেনের। এ জন্য স্কুলে সহপাঠীরা প্রায়ই তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো।
সেন্ট হেলেনা স্কুল, বার্চমেরে অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষকদের নজর কাড়েন রোগাটে, ছিপছিপে কিশোর বাইডেন। ছোট্টবেলায় কথা বলতে গিয়ে আটকে যাওয়া শিশু বাইডেন আজ মার্কিন রাজনীতির অন্যতম আইকন।
কলেজ থেকে দাম্পত্য জীবন : ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনার পাঠ চুকেন বাইডেন। ছোটবেলা থেকে ফুটবল খেলার প্রতি ছিল অন্য রকম এক টান। জন এফ কেনেডির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম ভক্ত ছিলেন তিনি।
১৯৬১ সালের দিকে ধীরে ধীরে রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। রাজনীতির মাঠে নামার পর নেইলিয়া হান্টারের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই পরিচয় শেষ পর্যন্ত পরিণয়ে রূপ নেয় ১৯৬৬ সালে। তাদের ঘরে রয়েছে জোসেফ, হান্টার, নাওমি নামের তিন সন্তান।
রাজনৈতিক জীবন : জো বাইডেন ১৯৬৮ সালে একটি ল ফার্মে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭০ সালে নিউ ক্যাসেল কাউন্টি কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। এরপর নিজস্ব ল ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭২ সালের নভেম্বরে রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর স্যালেব বগসের বিপক্ষে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী মনোনীত হন তিনি। এরপর মার্কিন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে ফেলেন নিজের নাম। মার্কিন ইতিহাসে পঞ্চম সর্বকনিষ্ঠ সিনেটর হিসাবে নির্বাচিত হন ২৯ বছরের বাইডেন।
১৯৭৭ সালে ফের বিয়ে করেন বাইডেন। দ্বিতীয় স্ত্রী জিলের ঘর আলো করে কন্যা সন্তান অ্যাশলে জন্মান ১৯৮১ সালে।
রাজনীতিতে মোড় : ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি হিসেবে নিযুক্ত হন জো বাইডেন। ১৯৭০ সালে কান্ট্রি কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে প্রথমবার সিনেটে যান তিনি। এরপর ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০২ এবং ২০০৮ সালে সিনেটর হিসেবে টানা নির্বাচিত হন জো বাইডেন। সিনেটর হিসেবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ইরাক নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি।
ভাইস-প্রেসিডেন্ট : ১৯৭২ সালে বড় দিনের উৎসবের জন্য ক্রিসমাস ট্রি কিনতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান প্রথম স্ত্রী নিলিয়া। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিজের স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন বাইডেন। বলেছিলেন, তিনি স্বপ্ন দেখেন ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগে একবার সিনেটর নির্বাচিত হতে চান তিনি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে বলে স্ত্রীকে জানান।
স্ত্রীকে বলা স্বপ্নের বাস্তবায়নে রাজনীতির ময়দানে এবার জোরেশোরে আসার জানান দিলেন বাইডেন। ১৯৮৭ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেনশিয়াল প্রাইমারিতে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। তবে অসুস্থতার কারণে পরের বছর এই লড়াইয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন তিনি। ২০০৭ সালের কথা। আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল প্রাইমারিতে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন। ওই সময় বারাক ওবামা এবং হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে ব্যর্থ হন।
হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়াতে পারেননি তিনি। পরে ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে টেলিফোন পান তিনি। বাইডেনকে রানিংমেট হিসেবে বেছে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন ওবামা। ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত একই পদে ছিলেন তিনি।
কমলা হ্যারিসের বৃত্তান্ত : হিন্দুস্তান টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, কমলার জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ায়। তাঁর মা শ্যামলা গোপালন ছিলেন ও ক্যানসার গবেষক। ২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কমলার বাবা ডোনাল্ড হ্যারিসের জন্ম জ্যামাইকায়। তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। খুব কম বয়সেই কমলার মা–বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। তিনি হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৩ সালে হ্যারিস প্রথমবার নির্বাচনে জেতেন এবং সেন্ট ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি নির্বাচিত হন। তিনি ২০১০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হন।
ডোনাল্ড-শ্যামলা দম্পতির প্রথম সন্তান কমলা হ্যারিস ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর ওকল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। কমলার নামের শেষাংশ বাবার কাছ থেকে নেয়া, প্রথম অংশ মায়ের দেয়া। ওই সময় নাগরিক আন্দোলনে ডোনাল্ড ও শ্যামলা এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, এলাকার প্রায় সব প্রতিবাদ কর্মসূচিতেই তারা ছিলের সামনের সারির মুখ। মাঝে মাঝে মেয়ে কমলাকেও স্ট্রলারে করে সেসব কর্মসূচিতে নিয়ে যেতেন তারা।
কমলার বয়স যখন ৭ বছর তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। এরপর দুই মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় শ্যামলার সংগ্রামী জীবন। দুই মেয়ে নিয়ে বার্কলের একটি হলুদ ডুপ্লেক্স ভবনের উপর তলায় আশ্রয় নেন শ্যামলা। মেয়েরা যেন ভারতীয় ঐতিহ্যের শেকড় ভুলে না যায় সেদিকে শুরু থেকেই মনোযোগী ছিলেন কমলার মা। মায়ের কারণেই শৈশবে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বানানো ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ও হিন্দু মন্দির দুই জায়গাতেই দুই মেয়ের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
কমলা তার আত্মজীবনীমূলক ওই গ্রন্থে লিখেছেন- ‘মা ভালো করেই বুঝেছিলেন যে, তিনি দুটি কৃষ্ণাঙ্গ কন্যাকে বড় করছেন। তিনি জানতেন, তার বেছে নেয়া দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) মায়া (কমলার ছোট বোন) ও আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই দেখবে। আমরা যেন আত্মবিশ্বাসী, গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে বেড়ে উঠি তা নিশ্চিত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।’
ওই গ্রন্থে কমলা বাল্যকালে ভারতে বেড়াতে যাওয়ায় তার ওপর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নানার যে যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল সেটিও উল্লেখ করেছেন। কমলার নানা বাড়ি ভারতের তামিলনাড়ুতে। তার জয় কামনা করে ভোটের সময় তামিলনাড়ুতে পূজাও হয়েছে।
কমলার মা কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিক্ষকতার চাকরি নেন তখন কমলা ও মায়াকে কিছুদিন মন্ট্রিয়লেও থাকতে হয়।
কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি পড়ার পর হেস্টিং কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি নেন। ১৯৯০ সালে তিনি ওকল্যান্ডে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হন তিনি। ২০১০ সালে সামন্য ব্যবধানে জয়ী হয়ে হন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনিই প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ-আমেরিকান।
২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে বারাক ওবামাকে প্রার্থী করা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনে অসাধারণ বক্তৃতা দিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের নজরে আসেন কমলা হ্যারিস। যদিও ওবামার সঙ্গে তার পরিচয় ও সখ্যতা আরও আগে থেকেই ছিল। ২০০৪ সালে ওবামা সিনেটর হওয়ার আগে থেকেই তারা একে অপরকে চিনতেন। ২০০৮ সালে ওবামা প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলে তাকে সমর্থন দেয়া তৎকালীন সরকারি পদধারীদের তালিকায় কমলা ছিলেন অন্যতম।
কমলার জীবনে মধুর সময়টি আসে ২০১৪ সালে। ওই বছর তিনি আইনজীবী ডগলাস এমহফের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর দু’বছর পর সিনেট নির্বাচনে সহজে জয়ী হয়ে প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উচ্চকক্ষে পা রাখেন কমলা।
প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে দ্বিতীয় মার্কিন সিনেটর হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারণায় কমলা অভিবাসন ও বিচার প্রক্রিয়ার সংস্কার, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, নারীর প্রজনন অধিকার নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার ছিলেন।
এছাড়াও সিনেটের সিলেক্ট কমিটি অন ইন্টেলিজেন্ট ও জুডিসিয়ারি কমিটির সদস্য হ্যারিস কংগ্রেসের বিভিন্ন শুনানিতে ধারালো, বুদ্ধিদীপ্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও দ্রুত খ্যাতি অর্জন করেন।
২০১৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস এবং পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে ব্রেট কাভানহ’র শুনানিতে তার জিজ্ঞাসাবাদের ধরন দলের ভেতরে-বাইরে তুমুল প্রশংসা অর্জন করে।
৫৫ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্যতম একটি জনপ্রিয় মুখ হিসেবে পরিচিত কমলা। তিনি এমন সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়তে যাচ্ছেন, যখন করোনার জেরে আমেরিকার অর্থনীতি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রায় দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। বাড়ছে বেকার সংখ্যা।
বিবিসি জনায়, সান ফ্রান্সিস্কোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ও ক্যালিফর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল পদে থাকাকালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম প্রধান সমালোচক ছিলেন কমলা। গত বছরে একটা সময় কমলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার লড়াইয়েও ছিলেন। কিন্তু ডেমোক্রেটদের পার্টির অন্দরের লড়াইয়ে জো বাইডেনের কাছে হেরে যান তিনি। দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের সময় একাধিক বিতর্কে বাইডেনকে তীব্র সমালোচনাও করেছেন কমলা। কিন্তু সেই বাইডেনের সঙ্গেই তিনি এবার নির্বাচনে যাচ্ছেন।
হ্যারিস বরাবরই নিজের কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তিনি নিজেকে ‘আমেরিকান’ বলে সব সময় বর্ণনা করেন। ২০১৯ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে কমলা বলেন, ‘আমি যা আমি তাই। আমি এর সঙ্গেই ভালো মানায়। আপনাকে এটা খুঁজে দেখতে হলেও আমি এতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি।’
দুই বছরের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করার সময় হ্যারিস ডেমোক্রেটিক পার্টির উঠতি তারকা হিসেবে সম্মান অর্জন করেন। ২০১৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার জুনিয়র ইউএস সিনেটর নির্বাচনে বাজিমাত করেন। বিতর্কে ঝানু কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্রেটিক পার্টির উদারনৈতিক পক্ষের সঙ্গে বনেদিদের মধ্যে একটা যোগসূত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক নাগরিক আন্দোলনের সময়ে কমলা হ্যারিসকে অগ্রভাগে দেখা গেছে। এসব বিবেচনায় কমলা হ্যারিসই জো বাইডেনের রানিং মেট হিসেবে আলোচনার শীর্ষে ছিলেন।
এক টুইটে কমলা হ্যারিসকে নিজের রানিং মেট হিসেবে বাছাই করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছেন বলে জানান জো বাইডেন।
কমলা তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমেরিকার মানুষদের একত্র করতে পারবেন জো। কারণ তিনি সারা জীবন আমাদের জন্য লড়াই করেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এমন এক আমেরিকা গড়ে তুলবেন, যা আমাদের আদর্শ মেনে চলবে। দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আমি সম্মানিত এবং তাঁকে কমান্ডার ইন চিফ বানানোর জন্য যা করার প্রয়োজন, তা করব।’
কমলাকে বেছে নেওয়া সিদ্ধান্তে ভারতীয়রা উচ্ছ্বসিত হলেও খোঁচা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার লক্ষ্যে লড়াইয়ে থাকা ট্রাম্প মন্তব্য করেন, বাইডেনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া সত্ত্বেও কমলাকে নিজের ডেপুটি হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি ‘অবাক’ হয়েছেন।
কমলার আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড : অ্যান আমেরিকান জার্নি’ প্রকাশের কিছুদিন পরই ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
মনোনয়ন লড়াইয়ের শুরুর দিকে কমলাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারমন্টের সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং ম্যাসাচুসেটসের সেনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয়েছিল।
এমনকি এক বিতর্কে বাইডেনকে অতীতের নেয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও সম্প্রদায়গত বিভিন্ন ইস্যুতে নাজেহাল করে ছেড়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী।
তখন জনমত জরিপগুলোতে কমলার অবস্থান ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে। তবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। তার প্রচারণা শিবিরেও দেখা দেয় নানা জটিলতা। এরপর ডিসেম্বরে মনোনয়ন দৌড় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আইন ও বিচার বিভাগের মতো জায়গায় কাজ করা ক্যালিফোর্নিয়ার এ সিনেটর ডেমোক্র্যাটদের প্রগতিশীল ও উদারপন্থি অংশের মূল বিরোধের জায়গাগুলো এড়িয়ে সাবধানে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেটা তো হয়ইনি, উল্টো দুপক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা হারাতে হয় তাকে। সে কারণে ডিসেম্বরে আইওয়ার ডেমোক্র্যাট দলের প্রথম ককাসের আগেই মনোনয়ন দৌড় থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন কমলা হ্যারিস।
মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়ার পর চলতি বছরের মার্চে বাইডেনকে সমর্থন দিয়ে হ্যারিস বলেন, ‘বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট করতে সাধ্যের সবটাই করবো।’
গেল মে মাসে মিনিয়াপোলিসে পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকে ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলার সামনে আবারও সামনে আসে। ফ্লয়েড হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের যে কয়জন রাজনীতিবিদ সমাজ ও বিচারব্যবস্থায় সংস্কারের দাবিতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন কমলা তাদের অন্যতম ছিলেন। এরপর গেল ১১ আগস্ট কমলাকে নির্বাচনী জুটি হিসেবে বেছে নেন বাইডেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক থেকে অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, গর্ভপাত, সবেতন ছুটি, সমকারীদের অধিকার, শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, আবাসন, কর ব্যবস্থাপনা সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে হ্যারিস ডেমোক্র্যাট মধ্যপন্থি ও প্রগতিশীলদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। যদিও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে তার বার বার অবস্থান বদল ভোটারদের সাময়িক দ্বিধাগ্রস্তও করেছিল।
আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যুদ্ধের বিরোধী কমলা ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে আসারও কঠোর সমালোচক। এছাড়াও তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একনিষ্ঠ সমর্থক।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে পুলিশ নীতিতে বদল আনারও দাবি তুলেছেন। কমলার বাগ্মিতা, অভিবাসী শেকড়, কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতি এবং অ্যাটর্নি ও সিনেটর হিসেবে অভিজ্ঞতা দিয়ে ডেমোক্র্যাটরাও যুক্তরাষ্ট্রে বিভাজনের রাজনীতির সমাপ্তি টানার স্বপ্ন দেখছে।