কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতের কাছাকাছি লাইটহাউস এরিয়ায় আলোচিত 'কক্সবাজার লাইটহাউস দারুল উলুম কওমী মাদরাসায়' প্রায় দুই বছর পর ফিরলেন মাদরাসার সাবেক মুহতামিম মাওলানা মোহাম্মদ আলী।
গতকাল (৮ জানুয়ারী) মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটি বিশেষ করে স্থানীয় কমিশনার ও নেতৃত্বস্থানীয় লোকদের ফুলেল শুভেচ্ছার মাধ্যমে তিনি মাদরাসায় ফিরেছেন বলে জানা গেছে।
মাদরাসায় ফেরা নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে মাওলানা মোহাম্মদ আলী পাবলিক ভয়েসকে বলেন - 'কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদ্রাসাটি আমার রক্ত-ঘামে উন্নতি করা একটি মাদ্রাসা। আমি মাদ্রাসার সাথে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত ছিলাম। কিন্তু একটি মহল ষড়যন্ত্র করে দুই বছর আগে আমাকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করেছিল। যা নিয়ে আইনি লড়াইসহ আমি ধৈর্য ধারণ করে গিয়েছি। দু'বছর পরে মাদ্রাসায় ফিরতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করছি। মাদরাসায় ফিরতে গণমাধ্যমসহ যারাই যখন যেভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছে তাদের সবার প্রতি ধন্যবাদ প্রকাশ করছি।'
[৮ জানুয়ারী (গতকাল) মাদরাসায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দদের নিয়ে প্রবেশ করেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী।]
এর আগে গত প্রায় দু বছর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. জিবিত থাকাকালীন সময় তার এক স্বাক্ষরের মাধ্যমে মাদরাসার সকল দায়িত্ব থেকে বহিস্কার করা হয়েছিলো মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে। এবং মাদরাসার সদরে মুহতামিম রাখা হয়েছিলো আল্লামা শফী রহ. কে এবং নির্বাহী মুহতামিম রাখা হয়েছিলো আল্লামা শফীপূত্র আনাস মাদানীকে।
স্থানীয়ভাবে মাদরাসার দায়িত্বে ছিলেন মাওলানা কেফায়েত উল্লাহ নামের কক্সবাজারের একজন আলেম। যিনি বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।
ওই সময় কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই প্রভাব খাটিয়ে অন্যায়ভাবে মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে বহিস্কার করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিলো। যার নেপথ্যে ছিলো আল্লামা শফীপূত্র আনাস মাদানী। এবং বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনাও হয়েছিলো। এমনকি আল্লামা শফী রহ. এর নামে মামলা করা হয়েছে বলেও একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেখানে তখন কক্সবাজারের হেফাজতের দায়িত্বে থাকা ও বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত মাওলানা ইয়াসিনসহ কয়েকজন আনাস মাদানীকে সঙ্গ দিয়েছিলো মাদরাসাটি দখল করতে।
আরও পড়ুন :
লাইটহাউস মাদরাসা নিয়ে আল্লামা শফীর নামে মামলা ; নেপথ্য ঘটনা কী?
মাদরাসা রক্ষার জন্যই আমি আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে মামলা করেছি : মুফতী হাবিবুর রহমান
আল্লামা শফীর নামে প্রচারিত মামলা করার নির্দেশনাটি বানোয়াট
আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে মামলা : আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রতিবাদ বিবৃতি
এছাড়াও মাওলানা ইয়াসিনের বিভিন্ন অন্যায়ের সঙ্গী মাওলানা কেফায়েতকে মাদরাসার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। এ ক্ষেত্রে তারা আল্লামা শফী রহ. এর প্রভাবের ব্যবহার ও তার ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীসহ স্থানীয় প্রশাসনের অন্যায় সহযোগিতা গ্রহণের অভিযোগ ছিলো। এবং তারাই দু বছর আগে মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে বহিস্কার করে হয়রানী করেছিলো। তবে মাওলানা কেফায়েতকে মাদরাসার শিক্ষকরা অনাস্থা দিয়ে বহিস্কারের আবেদন করেছিলো অনেক আগেই।
তাছাড়া বিগত দুই বছরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারা মাদ্রাসা পরিচালনা করতে পারেননি বলে জানা গেছে। শিক্ষকদের বেতন বাকি সহ মাদ্রাসার ছাত্র কমে যাওয়া ও মাদ্রাসার কোন উন্নতি না হওয়ার দৃশ্যমান কিছু ব্যর্থতা ও তাদের দেখা গেছে।
এরপর গতকাল (৮ জানুয়ারী) মাওলানা কেফায়েতকে সরিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে দু বছর পর ফের পূনর্বহাল করা হয়েছে মাদরাসাটিতে। তবে কোন পদে, কিভাবে তাকে পূনর্বহাল করা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়নি। আগামি ১৪ জানুয়ারি মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল পরবর্তিতে শুরা বৈঠক করে এসব দায়িত্ব ভাগ করা হবে বলে জানা গেছে।
দীর্ঘ দুই বছর পর মাওলানা মোহাম্মদ আলী মাদ্রাসায় পদার্পণ করলে ছাত্র শিক্ষক ও সর্বসাধারণের মাঝে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ তাদের প্রিয় অভিভাবককে ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। উপস্থিত শুরা সদস্যরা পূনরায় মাদ্রাসার উন্নয়ন কর্মকান্ড ও পড়ালেখা গতিশীল করতে এলাকাবাসী সহ সকলকে প্রতিষ্ঠানের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানান।
বিষয়গুলো নিয়ে বিরোধ নিস্পত্তিতে ভূমিকা রাখা ১২ নাম্বার ওয়ার্ড লাইট হাউস কলাতলি কক্সবাজারের কমিশনার কাজী মুরশেদ আহমেদ বাবুর সাথে পাবলিক ভয়েসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান - দীর্ঘদিন পর মাদরাসার বিরোধের নিস্পত্তি হয়েছে জেনে আমি খুশি হয়েছি। আমরা মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে মাদরাসায় পূনর্বহাল করেছি এবং মাওলানা আনাস মাদানীর নিয়ন্ত্রিত শুরা বাতিল করেছি।
নতুন করে শুরা বিষয়ে তিনি বলেন - মাওলানা আনাস মাদানীসহ মাদরাসার এতদিন যারা পরিচালনা করেছেন তাদের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ৫ জন এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী কর্তৃক নির্ধারিত ৫ জন এবং কমিশনার হিসেবে তার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ৩ জনসহ মোট ১৩ জনের শুরা কমিটি গঠন হবে এবং মাদরাসাটির সকল দায় দায়িত্ব ঢেলে সাজানো হবে।
তিনি আরও বলেন - শুরা কমিটির সদস্য, ছাত্র-শিক্ষক, ও এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় পুনরায় মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে পুনর্বহাল ও সংবর্ধিত করে তাহার অফিস হস্তান্তর করা হয়েছে। তাহার অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ দুই বছর যাবত এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এভাবে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া যায় না। তাই সকলের প্রচেষ্টায় মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে ছাত্রদের লেখাপড়া ও মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নে পুনর্বহাল বাহাল করা হয়েছে।
তবে একটি সূত্র থেকে জানা গেছে - স্থানীয়ভাবে সমালোচিত মাওলানা ইয়াসিনদেরকে সরিয়ে হলেও আল্লামা শফীপূত্র মাওলানা আনাস মাদানী মাদরাসাটির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে চাচ্ছেন এবং তিনি কোনো সমস্যা সৃষ্টি ছাড়াই নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদরাসাটি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কর্তৃক পরিচালিত হওয়ার পক্ষে। এ বিষয়ে সরাসরি মাওলানা আনাস মাদানীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপে তার কাছ থেকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলেও কিছু বলেননি।
মাওলানা মোহাম্মদ আলীর মাদরাসায় ফেরা নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকসহ অনেকেই। লাইট হাউস মাদরাসার প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ নামে একটি অংশ জানিয়েছে - দীর্ঘ দুই বছর যাবত লাইট হাউস মাদ্রাসা নিয়ে বিরাজমান ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে অবশেষে মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক, এলাকাবাসী ও হাজারো শুভাকাঙ্ক্ষীদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা মুহাম্মদ আলীকে লাইট হাউস দারুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবে পূনর্বহাল করায় তারা খুশি।
তারা মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে 'মাদ্রাসার উন্নয়নের রূপকার, জেলার অন্যতম আলেমে দ্বীন, হাজারো আলেম সমাজের আশা আকাংকার প্রতীক' বলেও তাদের মতামতে জানিয়েছেন।
বিরোধ নিস্পত্তিতে স্থানীয় কমিশনার ও নেতৃত্বস্থানীয়দের অবদান ছিলো ও তাকে মুহতামিম হিসেবে পূনর্বহাল করা হয়েছে জানিয়ে তারা বলেন - স্থানীয় কমিশনার ও মাদ্রাসার শুরা সদস্য জনাব কাজী মুরশেদ আহমেদ বাবু স্থানীয় প্রশাসন, মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক ও এলাকাবাসীর পক্ষে ৮ জানুয়ারী বাদ এশা মাওলানা মুহাম্মদ আলীকে মুহতামিম হিসাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আলীকে স্বপদে বহালের মাধ্যমে প্রমাণিত হল হক্বের বিজয় ও অন্যায়ের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
লাইটহাউস মাদরাসার ঘটনার ধারাবাহিকতা জানতে নিচের সংবাদ ও প্রতিবেদনগুলো পড়ুন :
পাবলিক ভয়েস ডেস্ক প্রতিবেদন।
সম্পাদনা ও বিন্যাস : হাছিব আর রহমান।