একই ভাবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা তাদের সমাবেশ পাহারা দেয়ার সময় যদি একটু সচেতন হতে পারতো, মূর্তির ওখানে দলীয় পোষাকের বাইরে সাধারণ পোষাকে কর্মী নিয়োগ করতো তবে এসব অহেতুক বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হতো। কিন্তু তা না করে তারা নিজেরাই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। দেশের মানুষের কাছে ভুলবার্তা পৌছাতে সহযোগিতা করেছে। সুতরাং এর খেসারত তাদেরই ভোগ করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কী সত্যিই মূর্তি পাহারা দিয়েছে?
পলাশ রহমান
না, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কর্মীরা মূর্তি পাহারা দেয়নি। তারা মূলত পাহারা দিয়েছে নিজেদের সমাবেশ। বরিশাল নগর ভবনের সামনে আয়োজিত বিজয় দিবসের (১৬ ডিসেম্বর) সমাবেশ যাতে ঝনঝাটমুক্ত হতে পারে সেজন্য তারা পাহারা বসিয়েছে।
তারা অন্যদের কারোর অপকর্মের দায় নিজেরা নিতে চায়নি। নিজেদের রাজনৈতিক ধারা বাধাগ্রস্ত করতে চায়নি। কারন দেশের রাজনীতি এখন আর রাজনীতিতে নেই। সিঙ্গাড়ার মধ্যে কচু ঢুকে পড়ার মতো করে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে অপরাজনীতি।
শাসকশ্রেণী রাজনীতি করে, মেধা দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার পরিবর্তে অপরাজনীতি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেষ্টা করছে। তারা রাজনৈতিক বিরোধীদের রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা না করে অরাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করছে। যেমন কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘা যতীনের মূর্তি ভেঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগের একজন নেতা।
তিনি নিশ্চই সরকারকে বিপদে ফেরার জন্য যতীনের মূর্তি ভাংতে যাননি। ভেঙ্গেছেন সরকার বিরোধীদের বিপদে ফেলার জন্য। এ জাতীয় অপকর্মের দায় এড়াতে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা পাহারা দিয়েছেন তাদের সমাবেশ।
কিন্তু দেশবাসীর কাছে গিয়েছে ভিন্নবার্তা। সংবাদমাধ্যমে দেশের গণমানুষ সচিত্র সংবাদ দেখেছে, ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা গায়ে দলীয় পোষাক পরে মূর্তি পাহারা দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো দেশবাসীর কাছে এই ভুলবার্তা যাওয়ার দায় কার? যদি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের দৃষ্টিতে দায় খোঁজা হয় তবে আঙ্গুল উঠবে সংবাদ মাধ্যমের দিকে। তারা দেশবাসীকে ভুলবার্তা দিয়েছে। কিন্তু এখানেই কী দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? না, শুধু সংবাদ মাধ্যমের উপর দায় চাপিয়ে ইসলামী আন্দোলন দায়মুক্ত হতে পারে না। বরং এর প্রধান দায় নিতে হবে ইসলামী আন্দোলনকেই!
দেশে মূর্তি নির্মানকে কেন্দ্র করে এক রকমের রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের আদর্শ ভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসাবে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থান মূর্তি নির্মানের বিপক্ষে হলেও তারা এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে গ্রহণ করেনি। তারা মূর্তি নির্মানকে ধর্মীয় ইস্যু হিসাবে নিয়েছে এবং নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেছে।
কিন্তু সরকার পক্ষ যেহেতু ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল হিসাবে অপরাজনীতিকে বেছে নিয়েছে, তারা মূর্তি ইস্যুকেও অপরাজনীতির পাতিলে ঢেলে খিচুড়ি বানাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের হুমকি-ধামকি দিয়ে, মামলা-মোকাদ্দমায় ফেলে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। তারা এই ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলনের নেতা (সিনিয়র নায়েবে আমীর) মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করিমসহ দেশের অনেক ইসলামপন্থী নেতাদের বিরুদ্ধে দেশবিরোধী মামলা দেয়ার চেষ্টা করেছে।
আরও পড়ুন :
ইসলামী আন্দোলন : ইসলামপন্থী রাজনীতির এক অকাট্য বিশ্লেষণ
গাজী আতাউর রহমানরা কেনো পিছিয়ে থাকবেন!
সিটি নির্বাচন : শিরদাড়া টান করে কথা বলেছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারা
এমন একটা ঘোল খাওয়া পরিবেশের মধ্যে দেশের সাধারণ মানুষ যখন সংবাদ মাধ্যমে দেখে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা দলীয় পোষাক পরে মূর্তি পাহারা দিচ্ছে তখন সাধারণ মানুষ তা সাধারণ ভাবেই বিবেচনা করে। তারা ধরে নেয়- 'ঠ্যালার নাম বাবাজি'। অর্থাৎ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা মামলার ভয়ে মূর্তি পাহারা দিয়েছে। তারা দলীয় পোষাক গায়ে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছে।
এখানে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো দায় নেই। সাধারণ মানুষ সাধারণ ভাবে চিন্তা করবে এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসাবে ইসলামী আন্দোলনের বোঝা দরকার ছিল এই মুহুর্তে দলীয় পোষাক পরে নেতাকর্মীদের মূর্তির সামনে দাঁড় করানোর ধাক্কা কোথায় গিয়ে লাগতে পারে। এই ধাক্কা এখানেই শেষ হয়ে যাবে না। ভবিষ্যতেও ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক বিরোধীরা, ইসলাম বিরোধীরা এটাকে উদাহরণ হিসাবে ব্যাবহার করবে।
যেমন হেফাজতের মরহুম নেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফি সাহেব (রহ.) শেখ হাসিনার সাথে এক স্টেজে মিটিং করে হয়তো বড় কোনো অপরাধ করেননি, কিন্তু এটা একটা উদাহরণ হিসাবে থেকে গেছে। ভবিষ্যতে অনেকেই এটাকে উদাহরণ হিসাবে ব্যাবহার করবে। যা মোকাবিলা করা কঠিন হবে।
একই ভাবে আন্দোলনের বিজয় সমাবেশে সৈয়দ ফয়জুল করিম আওয়ামীলীগ এবং শেখ মুজিবর রহমান সম্পর্কে যেসব বক্তৃতা করেছেন তাতে দেশের গণমানুষের কাছে ভুলবার্তা গিয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই মুফতী ফয়জুল করীমের বক্তব্য ছিল অকাট্য, দালিলিক। কিন্তু এই সময়ে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এর কোন দিকটা সাধারণ ভাবে উঠে আসবে এবং ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক বিরোধীরা কোন দিকটা সামনে আনার চেষ্টা করবে বা কোন রঙ্গে উপস্থাপন করবে তা বিবেচনায় নেয়া দরকার ছিল। ইসলামী আন্দোলনের নেতা বিশেষ কোনো লেখক বা বই দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন, কিন্তু তা প্রকাশের সময় ক্ষেত্র বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন ছিল।
আরও পড়ুন :
চরমোনাই তরিকা : নারীরা উপেক্ষিত কেনো?
চরমোনাই তরিকা এবং জিকিরের লাফালাফি
ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান অবস্থান অত্যান্ত প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু এই উদ্যোগটা আরো গোছালো, একাডেমিক হওয়া দরকার। এই মুহুর্তে এত আনুষ্ঠানিক ভাবে আওয়ামীলীগ এবং শেখ মুজিবর রহমানকে ধার্মীক হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারন দেশের সাধারণ মানুষ ভালো নেই। সুশাসন নেই। কথা বলার, ভোট দেয়ার অধিকার নেই। খাবার, চিকিৎসা, বাসস্থানের নিশ্চয়তা নেই। দেশের শতভাগ মানুষ অনিরাপত্তায় ভুগছে। দূর্নীতিতে খাবি খাচ্ছে। এমন একটা সময়ে দেশের গণমানুষ এসব কথা সহজ ভাবে গ্রহণ করবে না এটাই স্বাভাবিক।
ইসলামী আন্দোলন যদি আরো বেশি কৌশলী হতে পারতো, তারা যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারতো যে- আওয়ামীলীগের নেতারাই মরিয়া হয়ে উঠবে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করতে, তারাই শেখ সাহেবের পূর্বপুরুষের ইতিহাস জাতীর সামনে তুলে ধরে বলবে শেখ সাহেবের রাজনীতি ইসলামের বিরুদ্ধে ছিল না। আওয়ামীলীগ ইসলাম বিরোধী দল নয়। তবেই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা প্রকাশ পেতো। কিন্তু তা না করে ইসলামী আন্দোলনের নেতা নিজেই যখন নেমে পড়েন আওয়ামীলীগ এবং শেখ মুজিবর রহমানকে ইসলামের বন্ধু হিসাবে প্রমাণ করতে গোলটা তখনই তৈরী হয়। গণমানুষের কাছে ভুলবার্তা যায়। রাজনৈতিক বিরোধীরা সুযোগ পায়।
একই ভাবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা তাদের সমাবেশ পাহারা দেয়ার সময় যদি একটু সচেতন হতে পারতো, মূর্তির ওখানে দলীয় পোষাকের বাইরে সাধারণ পোষাকে কর্মী নিয়োগ করতো তবে এসব অহেতুক বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হতো। কিন্তু তা না করে তারা নিজেরাই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। দেশের মানুষের কাছে ভুলবার্তা পৌছাতে সহযোগিতা করেছে। সুতরাং এর খেসারত তাদেরই ভোগ করতে হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জনপ্রিয় কলামিস্ট, প্রবাসী সাংবাদিক।
সংশ্লিষ্ট আরও লেখা পড়ুন :
একঝাঁক সৈয়দ বেলায়েত, সিদ্দিকী, মিছবাহ ও নেছার উদ্দিন চাই!
ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াতী মাস এবং চরমোনাইর মাহফিল
সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : দলের প্রতি ১২ টি প্রশ্ন
হালজমানার ওয়াজ ও জামায়াত প্রসঙ্গ
[মতামত বিভাগে প্রকাশিত যে কোনো লেখার দায় ও অবস্থান একমাত্র লেখকের। পাবলিক ভয়েস সম্পাদনা পরিষদ এ লেখার দায় বহন করে না এবং এটাও জরুরী না যে সম্পাদনা পরিষদ এ লেখার সাথে একমত হতে হবে]