নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মুসলিম বিশ্ব নীতি হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঠিক উল্টো! দেশের মুসলিম সম্প্রদায় থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য- সর্বত্রই পররাষ্ট্রনীতিতে ‘ইউটার্ন’ ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমন আভাস মিলেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির বিশ্লেষণমূলক এক প্রতিবেদনেও, তাছাড়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তো রয়েছেই।
বলা হচ্ছে, যক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ১ ভাগ মুসলিম। যারা ঐতিহাসিকভাবেই ডেমোক্রেটিক দলকে সমর্থন করেন। এবারের নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি, দলটি এই ভোটব্যাংককে কাজে লাগিয়েছে।
অন্যদিকে, এটিকে ব্যবহার করে ধর্মীয় বিভাজন রেখা টেনে সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান এবং প্রভাবশালী ইহুদিপন্থীদের ভোট টানতে বরাবরই সচেষ্ট ছিল রিপাবলিকানরা। কিন্তু এবার তাতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে করছেন না অনেকেই, যার প্রমাণ নির্বাচনী ফলাফল।
এ তো গেলো নির্বাচন কেন্দ্রিক হিসাব-নিকাশ। এবার আসা যাক মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নীতির বিষয়ে। রোববার বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বড়সড় পারিবর্তন আনছেন বাইডেন, তা তার ইরান-সৌদি নীতিতেই স্পষ্ট।
বিশ্লেকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেবেন জো বাইডেন ও তার রানিং মেট কমালা হ্যারিস। নির্বাচনী প্রচারনায় একনায়ক ও কর্তৃত্ববাদী শাসকদের কবলে থাকা এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোটাদাগে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণের কথা বলেছেন তারা।
বাইডেনের নীতিতে ছয় জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে ২০১৫ সালে সম্পাতিক ইরানের পরমাণু সমঝোতা গুরুত্ব পাবে। এ চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প।
এখন সে চুক্তিতে ফেরা হোক বা না হোক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় যুক্ত হবেন বাইডেন। ইরান চুক্তি কঠোরভাবে মেনে না চললে নিষেধাজ্ঞাও না তোলার কথা জানিয়েছেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে- সৌদি জোট ও তাদের ইয়েমেন যুদ্ধে ট্রাম্পের অব্যাহত সমর্থন। এই সমর্থন বন্ধ করে সৌদি জোটকে শান্তির দিকে নিয়ে যাবেন বাইডেন। মার্কিন বামপন্থী দল ও কংগ্রেসের অনেক আইনপ্রণেতাও এই যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে।
মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দুই দেশ ইরান ও সৌদি আরব নীতিতে ভারসাম্য আনবেন জো বাইডেন। এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি বিশ্লেষক ড্যানিয়েল প্লেটকা বলেন, ট্রাম্পের সৌদি ঘেঁষানীতি থেকে সরে এনে ‘ইরানমুখী’ হবেন বাইডেন।
বাইডেন মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বৈরাচারী শাসকদের সঙ্গে তামাশা করে চললে, সৌদি নির্যাতন ক্ষমা করে দিলে, মিশরের প্রেসিডেন্টকে 'প্রিয় একনায়ক' সম্বোধন করলে সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়ে এবং বিশ্বব্যাপী অসন্তুষ্টির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এরই অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের বিদ্যমান সম্পর্ক পর্যালোচনা করার কথা বলেছেন বাইডেন। সেইসঙ্গে ইয়েমেনে দেশটির নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধে মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বাইডেনের মতে, ইয়েমেন যুদ্ধ, সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা, ভিন্নমত ও নারী অধিকারকর্মীদের দমনের মতো ভয়াবহ নীতি অনুসরণে সৌদিকে 'ব্ল্যাংক চেক' দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এদিকে, গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া ট্রাম্পের আরব-ইসরায়েল নীতি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান থেকে সরে এসে তেল আবিবের স্বার্থ রক্ষায় সম্ভব সবকিছু করেন তিনি। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি এবং শতাব্দীর সেরা চুক্তির নামে ফিলিস্তিনকে পঙ্গু করার নীতি নেন ট্রাম্প।
এর ঠিক বিপরীতমুখী হয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করবেন নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনের মার্কিন কনস্যুলেট খোলা, ফিলিস্তিনিদের মার্কিন সহায়তা দেয়া, সেখানে কাজ করা জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করবেন তিনি। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তিকে স্বাগত জানান বাইডেন।
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সমান স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করার কথা জানিয়েছেন জো বাইডেন। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলির জীবনের সমান মূল্যে বিশ্বাসী বলে জানান তিনি।
বাইডেনের মতে, দ্বি-রাষ্ট্রের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের বিদ্যমান সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এর মাধ্যমেই ইসরায়েল ও ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উভয় দেশ পারস্পরিক স্বীকৃতির মাধ্যমে সহাবস্থান করবে।
দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের সম্ভাবনাকে দুর্বল করতে পারে- কোনো পক্ষের এমন একতরফা যেকোনো পদক্ষেপ, অবৈধ ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেন বাইডেন।
এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা পুনর্বহালে দ্রুত পদক্ষেপ, মার্কিন আইন অনুযায়ী শরণার্থীদের সহায়তা, অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক সঙ্কট লাঘব এবং ওয়াশিংটনে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশনের (পিএলও) মিশন ফের চালু করতে কাজ করবেন তিনি।
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ তুরস্কের ক্ষমতা থেকে রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে হটাবেন বলে বছর খানেক আগে দেয়া একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রতি সামনে আসলেও এ ক্ষেত্রে নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি এখনো পাওয়া যায়নি বাইডেনের।
লেবাননে দুর্নীতি মুক্তির জন্য এবং স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ ও বাস্তবায়নে সেদেশের নাগরিকদের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাইডেন।
লেবাননের স্থিতিশীলতা রক্ষায় দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে সমর্থন, বৈরুত বিস্ফোরণের ক্ষতি কাটিয়ে উঠা এবং শরণার্থী সমস্যা সমাধানে সহায়তা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন তিনি।
এশিয়ার মধ্যে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের বাসিন্দাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাইডেন। সেখানে গণতন্ত্র দুর্বল করতে ভিন্নমত ও প্রতিবাদ দমনে নিষেধাজ্ঞা ও ইন্টারনেট সেবার বিষয়টি নিয়েও কাজ করবেন তিনি।
আসামে ভারত সরকারের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) কার্যকর এবং নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (সিএএ) পাস করা এবং এর প্রেক্ষাপটে পরবর্তীতে দেশটির নানা পদক্ষেপে হতাশা ব্যক্ত করেছেন জো বাইডেন।
মোদি সরকারের এমন পদক্ষেপ ধর্মনিরপেক্ষতা, বহু-জাতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলেও মনে করেন তিনি।
বাইডেনের মতে, চীনের জিনজিয়াংয়ে ১০ লাখের বেশি উইঘুর মুসলিমকে জোরপূর্বক আটকে রাখা অযৌক্তিক। সেখানে বন্দী শিবির পরিচালনার বিরোধিতা করা এবং এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কাজ করবেন তিনি।
মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর নিপীড়নের শিকার হওয়া এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য করায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও নৃশংসতাকে ঘৃণ্য কাজ মনে করেন বাইডেন। তার মতে, দেশটির এমন কর্মকাণ্ড শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে।
ইসমাঈল আযহার/পাবলিক ভয়েস