ভাষান্তর : ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী
হারিয়ে যায় সব স্মৃতীর শহর:
আমার জীবনের একটি বিরাট অংশ কেটেছে দামেশকের একটি মাদরাসায় ৷ এটি সে অঞ্চলের সুপ্রাচীন শাফেয়ী প্রতিষ্ঠান ৷ প্রতিষ্ঠার দিক থেকে জামেয়া আযহারের কাছাকাছি সময়ের ৷ কালের সাক্ষী এই প্রতিষ্ঠান নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে সামনে বেড়েছে ৷ বর্ণিল সময়ের মুখোমুখী হয়েছে ৷ সর্বশেষ এটি বেসরকারী জাতীয় মাদরাসা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ সেখানে আমার ত্রিশ বৎসর কেটেছে ৷
প্রতি শুক্রবার আমরা বের হতাম ৷ আছরের পরে একটি কক্ষে সমবেত হতাম ৷ আলোচনা করতাম ৷ স্মৃতী হাতড়ে বেড়াতাম ৷ অতীতের গল্পে হারিয়ে যেতাম ৷ সবাই খুব মজা করে এতে অংশগ্রহণ করত ৷ জীবন মানে কী? শওকী বলেছেন, জীবন মানেই ভালোবাসা, ভালোবাসা মানে জীবন৷ আমি বলি না, জীবন মানেই স্মৃতীকথা ৷ স্মৃতীকথা মানেই জীবন ৷ যার জীবনের স্মৃতীকথা হারিয়ে গেল তার সবই হারিয়ে গেল৷
কিন্তু কিছুদিন পূর্বে সেই প্রিয় প্রতিষ্ঠানে যাই ৷ দেখি প্রধান ফটকটি আছে ৷ যথারীতি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৷ ভিতরে গিয়ে দেখি একী! সব উজাড় হয়ে গেছে ৷ মাদরাসা নেই ৷ ভবন নেই ৷ ভিতর্র মানুষগুলো নেই ৷ বাজার হয়ে গেছে৷ বিশাল বাজার ৷ আহত হই ৷ স্মৃতীর রাজ্যে প্রিয় মুখগুলো খুঁজে নেই৷
আহত মনে ভাবতে লাগলাম ৷ কে তাহলে রইবে আমার সাথে৷ কোন সম্পর্কটি তাহলে টিকে থাকবে ৷ শেষ প্রর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিবে ৷ আমার আপন থাকবে৷
আলোকিত প্রেমময় গন্তব্য:
মা-বাবা চলে গেল, হারালাম তাদেরকে ৷ ভাই-বোন দূরে গেল৷ বিচ্ছিন্ন হলাম তাদের থেকে ৷ কন্যারাও নিজ নিজ পরিচয় ঠিকানা গড়ে নিল ৷ শেকড় জড়ানো জীবন থেকেও আরও সুখী হল নতুন জীবনে ৷ শুভ কামনাও তাদের জন্য নিরন্তর ৷ বন্ধু-বান্ধবদের রঙ্গিন জীবনও হারিয়ে গেল ৷ শিক্ষাজীবনের প্রাণবন্ত দূরন্ত প্রহরগুলোও ধূলোমলিন হয়ে গেল ৷ পরিকল্পিত সূদীর্ঘ জীবনের এই সাজানো আয়োজন কী তাহলে অসহায় নিঃস্বঙ্গ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে ৷ একাকী গুমড়ে গুমড়ে কাঁদবে ৷ ঠিক তখনই চিন্তার আঁধার দূর হল ৷ ভাবনার কালিমায় আলো ছড়িয়ে পড়ল ৷ মহামূল্যবান জীবন অনিশ্চয়তার শংকামুক্ত হল৷
হ্যাঁ অবশেষে একটি চিরন্তন বন্ধনের সন্ধ্যান পেয়ে যাই ৷ যে বন্ধনে ভাঙ্গন আসে না ৷ যে সম্পর্কের সূর্য কখনও অস্ত যায় না ৷ যে ভালোবাসায় কখনও বজ্রপাত হয় না ৷ যে প্রেম কখনও প্রাণহীন হয় না ৷ যে জীবন্ত গল্প কখনও স্মৃতীর অতীত হয়ে যায় না ৷ কেউ ইচ্ছা করলেই এখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে না ৷ সেই প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক ও বন্ধন হল আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক ও বন্ধন ৷ যে পবিত্র বন্ধন কেউ চাইলেই ভেঙ্গে ফেলতে পারে না ৷ যার কোমল পরশ থেকে কেউ চাইলেই দূরে যেতে পারে না৷
জীবনগল্পের নিরব সাক্ষী:
আপনারা গভীর মনোযোগের সাথে শুনুন ৷ বিশ্বাস করুন ৷ আমি আমার দীর্ঘ জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা থেকে বলছি, এটি কৃত্তিম কোনো ওয়াজ নয় ৷ স্বরচিত কোনো সুবিন্যস্ত নীতি কথাও নয় এটি ৷ বরং মানুষ যেমন সিনেমার পর্দায় ধারাবাহিক কোনো নাটক বা অনুষ্ঠান দেখে-তেমনই আমি পূর্ণ জাগ্রত অনূভুতির সাথে জীবনঘনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে খুব কাছ থেকে খোলা চোখ দিয়ে "বর্ণিল জীবন" নামক টেলিফিল্মটি দেখে এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারপর বলছি, শুধু একটি সম্পর্কই টিকে থাকে জগতে ৷ শুধু একটি বন্ধনই আলো দেয় দিন রাত জীবনে৷
আপনজনকে ভুলে যেতে নেই:
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, আমরা তা ভুলে যাই ৷ একটিমাত্র নিরাপদ প্রেমের কেন্দ্রকে আমরা বিস্তৃতীর আড়ালে রেখে আত্বভোলা সেজে যাই ৷ আমরা আমাদের আস্থার একটিমাত্র বাতিঘর আল্লাহকে ভুলে যাই ৷ আমরা যখন আল্লাহকে ভুলে যাই ৷ আল্লাহ আমাদেরকে আত্বভোলা বানিয়ে দেন ৷ আসুন মহান প্রভুর এই অমোঘ বাণীর মর্ম উপলব্ধি করার চেষ্টা করি৷
"তোমরা তাদের মত হয়ে যেওনা যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল ৷ তারপর আল্লাহ তাদেরকে আত্বভোলা বানিয়ে দিয়েছেন"
আমরা কী সত্যিই নিজেদেরকে ভুলে যাই? কেন ? কীভাবে ? কখন ? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় চলছে ৷ কিভাবে কাটাচ্ছি আমরা সময়? হ্যাঁ হয়ত নামাজেও দাঁড়াচ্ছি কখনও, কিন্তু অর্ধচিন্তা নামাজে থাকলে অর্ধচিন্তা ডুবে থাকে অশুদ্ধ কামনা বাসনায় ৷ দিনভর মানুষের সাথে আড্ডাবাজিতে সময় নষ্ট হচ্ছে নিশ্চিন্তে ৷ আর নামাজের জন্য ১০/১৫ মিনিট সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ছে ৷ দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, সেখানেও ঘন্টার ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে ৷ কিন্তু মসজিদের এই পবিত্র সময়টুকো বড় অস্বস্থিতে কাটছে ৷ কষ্ট করে ডুকলেও বের হওয়ার জন্য পাগল হয়ে থাকছে মন ৷ কেন? আমার মন কী আমার সাথে শত্রুতা করছে? কেন আমার মনকে আমি শান্ত তৃপ্ত করতে পারছি না এখানে?
বুদ্ধীর দীপ্তি কোথায় ?
আমার জীবনের পূজী আমার সময় ৷ এই পূজীকে কোথায় বিনিয়োগ করছি? কোথায় লাগাচ্ছি? জীবন ও সময় কী যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছি? কোনো তরুণ কে জিজ্ঞেস করুন, সে তার সময় কে কোথায় ব্যায় করছে? কেন করছে? সদুত্তর পাওয়া আপনার জন্য কষ্টকর হবে৷
আমার ও আপনাদের অবসর ৷ আমার ও আপনাদের সময় এইতো জীবন ৷ কিন্তু এই অমূল্য সম্পদই সবচেয়ে নোংড়া বিষয়ে নষ্ট হচ্ছে ৷ আজে বাজে বই পড়া অর্থহীন আড্ডা, সিনেমা নাচ গান ড্রামা নাটকে জীবন ডুবে আছে ৷ যাতে দুনিয়া ও আখেরাতের কোনো ফায়দাই নেই ৷ হিরা যোহরতকে মাটির মত বিলিয়ে দিচ্ছি! বরং বিপদ কিনে আনছি ৷ কেন? আত্বভোলা হয়েছি এই জন্য ৷ আমরা যখন আল্লাহকে ভুলে গিয়েছি তখন আল্লাহ কল্যান চিন্তা থেকে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন ৷ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ৷ আমি তুমি প্রত্যেকেই জীবনের মুখোমুখী ৷ মানে সময়ের মুখোমুখী দাড়িয়ে আছি ৷ সময় যদি বেঁচে যায় তাহলে জীবন বেঁচে যাবে ৷ সময় যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে জীবনও নষ্ট হয়ে যাবে ৷ তাই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক যতো সূদৃঢ় হবে , জীবনের নিরাপত্তাও ততো নিশ্চিত হবে৷
উপভোগ্য জীবনের সন্ধানে:
আমাদের স্থূল ভাবনা কখনও আমাদের বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় ৷ তুমি কোথা থেকে এসেছ? ওখানে কী কেউ তোমার আপন ছিল? অথচ আল্লাহই আমাদের সব জগৎ কে গড়ে তুলেছেন ৷ তিনিই সব সময় আপন ছিলেন ৷ জন্মপূর্ব মাতৃগর্ভের জীবনের ব্যপারে আমি কিছুই জানতাম না, কিন্তু মহান প্রভু তখনও আমার আপন ছিলেন ৷ আমার সব প্রয়োজন পূরণ করেছেন ৷ আমাকে নিরাপদে রেখেছেন ৷ মৃত্যু পর্যন্ত তিনিই আমাদের নিরাপত্তা দেন ৷ আপন করে রাখেন৷
এমন পবিত্র চিন্তায় যে এই বন্ধনকে অটুট রাখে, মহান প্রভুর সাথে নিত্য সম্পর্ক জুড়ে রাখে ৷ তাকেই জীবনের সর্বাধিক আপন ভাবে ৷ সেই ঈমানের স্বাদ ভোগ করতে পারে ৷ ঈমানের স্বাদের এই ব্যাখ্যাটি আমার নয়, বরং রাসূলে কারীম সা, এরশাদ করেছেন, যে এটা বলবে-- সে ঈমানের স্বাদ পাবে ৷ যে এটা করবে-- সে ঈমানের স্বাদ পাবে ৷
এই বলা ও করার সারমর্ম ও নিংড়ে নেয়া জলই হল এই চিন্তা ও অনূভুতিকে গভীর মমতায় লালন করা যে , আমার মন মনন, আবেগ অনূভুতি সব প্রিয়তম প্রভু আল্লাহর জন্য অষ্ট্রপ্রহর নিবেদিত ৷ ঈমানের অকৃত্তিম স্বাদ তখন সর্বাঙ্গে বিরাজ করবে ৷ অনূভুত হবে ৷ এই বিশুদ্ধ জান্নাতী স্বাদ তখন চিন্তা কে জীবন কে পৃথিবীর অন্য যে কোনো ভোগ্য বস্তু থেকে বহুগুণে উপভোগ্য ও বিমূগ্ধ করে তুলবে !
(সমাপ্ত)