বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহের সর্ববৃহত শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মহাসচিব পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা দেশের প্রবীণ আলেম ঢাকার প্রশিদ্ধ দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা আবদুল কুদ্দুস বেফাকের আমেলা সদস্যদের সামনে একটি দীর্ঘ ও আবেগঘণ বক্তব্য দিয়েছেন।
বক্তব্যে তিনি তার উপর আরোপিত অভিযোগ ও বেফাকে তার দীর্ঘ কর্মযজ্ঞ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। পাঠকদের জন্য তার বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
আজ ৩ অক্টোবর শনিবার বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর মজলিসে আমেলায় বেফাকের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র সহসভাপতি ও মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ সাহেবের স্বাগত বক্তব্য।
দেশের সব প্রান্ত থেকে বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে আজকের এই মজলিসে আগত আমেলার মুহতারাম সদস্যবৃন্দের সবাইকে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক মুবারকবাদ। আল্লাহ তাআলা সকলের এই মেহনতকে কবুল করুন।
বেফাক একটি সুপ্রাচীন সংগঠন। জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন বোর্ড। সূচনালগ্ন থেকে কওমী অঙ্গনের শীর্ষ মুরব্বীগণের তত্ত্বাবধানে এ বোর্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ওলামায়ে কেরামের সম্মিলিত মেহনত-মুজাহাদা, ইখলাস ও দুআর বদৌলতে বেফাক বর্তমানের অবস্থানে পৌঁছেছে। আমাদেরকে এতিম করে বিদায় নেওয়া মরহুম শায়খ আল্লামা শাহ আহমাদ শফী রহ. এর সুদক্ষ সভাপতিত্বে দেড় যুগ ধরে বেফাকের কর্মপরিধি দিন দিন বিস্তৃতি লাভ করেছে।
বেফাকের দীর্ঘতম সময়ের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার জাহানাবাদী রহ. এর ইন্তেকালের পর বেফাকের উল্লেখযোগ্য সব মুরব্বী, শূরা, আমেলা এবং সর্বোপরি সদ্য প্রয়াত সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. কর্তৃক আমাকে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অতঃপর মজলিসে উমূমীতে নির্বাচিত মহাসচিব হিসাবে নিয়োগ করেন। তখন বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন আল্লামা আশরাফ আলী সাহেব রহ. (কুমিল্লার হুযুর)। হযরতের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ সময় আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
আমার উস্তাদ, শায়খ ও মুরব্বী আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর দুআ এবং ওলামায়ে কেরামের সকলের সহযোগিতায় আমি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব ও সিনিয়র সভাপতির অর্পিত দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি, আমার কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে আমি তা যথাসাধ্য পালনের চেষ্টা করেছি। কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে ন্যূনতম কোনো সম্পর্কও আমার নেই। বেফাকের গঠনতন্ত্র, নিয়মনীতি ও মুরব্বীগণের পরামর্শ মোতাবেকই সকল কাজ আঞ্জাম দিয়েছি। ফলে বেফাক তার ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও সুশৃঙ্খল সময় অতিবাহিত করেছে। যার কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হলো :
আমাদের মুরব্বী ও শায়খ আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর নেক দুআ ও মুরব্বীগণের প্রচেষ্টায় আলহামদুলিল্লাহ বেফাকের নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে সামাদ নগরে বহুতল ভবনের কাজ শুরু হয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে উক্ত ভবন নির্মাণের জন্য একাধিকবার তহবিল গঠনের আলোচনা করা হয়েছিল। এই নির্মাণপ্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় আনুমানিক বিশ কোটি টাকা। মরহুম সভাপতি ও মুরব্বীগণের দুআয় আলহামদু লিল্লাহ ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ, নতুন তহবিল সংগ্রহ কিংবা কোনো প্রকার চাঁদা ওঠানো ছাড়াই বেফাক নির্বিঘ্নে উক্ত প্রকল্প সম্পন্ন করার সামর্থ্য রাখে। অথচ চলমান এ প্রকল্প শুরুর আগেও নতুন তহবিল গঠনের প্রস্তাব উঠেছে। আমি তা নাকচ করে দিয়ে বলেছিলাম, বেফকের বর্তমান তহবিল দ্বারাই ১৮ কাঠা জায়গার উপর নির্মাণাধীন ১১তলা ভবনের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করা উত্তমরূপেই সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ। বর্তমান ব্যাংক স্টেটমেন্ট এ কথার সাক্ষ্য দেয়।
আপনারা অবগত আছেন, মুরব্বিদের দুআ ও পরামর্শে করোনাকালীন অভাবের সময়েও বেফাক গত চার মাসে বেফাকভুক্ত মাদরাসাগুলোতে আলহামদু লিল্লাহ পাঁচ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করেছে। পাশাপাশি বেফাক অফিসের পশ্চিমে অবস্থিত ভবনটির উত্তরে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ষোল শতাংশ জমি খরিদ করেছে। এই বিপুল অংকের অনুদান, জমি ক্রয় ও ২০ কোটি টাকার নির্মাণপ্রকল্প বাধাহীনভাবে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সমাপ্তির পরও বেফকের যাবতীয় কাজ স্বাভাবিক গতিতে চলবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতেই সভাপতি মরহুম আল্লামা শাহ আহমাদ শফী রহ. এর নেক তাওয়াজ্জু ও মুরব্বীগণের দুআয় এ সব কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। বেশ কিছু সমস্যা শনাক্ত করে তার যথাযথ সমাধানের মাধ্যমে যখন বেফাক উন্নতির পথে দ্রুত এগুচ্ছে, তখনই কওমী অঙ্গনকে কলুষিত করার উদ্দেশ্যে একটি চক্র বেফাকের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। ইতিপূর্বেও তারা ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতিসাধনের চেষ্টায় রত ছিল। এরই অংশ হিসাবে গত তিন মাস যাবত বেফাকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে (যেসবের অধিকাংশই সমাধা হয়েছে এবং কিছু প্রক্রিয়াধীন) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এ আলোচনা ও সমালোচনায় আমার বিরুদ্ধে এমন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যা এ অঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষেও শোভনীয় নয়। মানহানি, মিথ্যাচার, অপবাদ, কুৎসা রটনা, ঘটনা ও তথ্যের বিকৃতি কোনোটি করতেই কার্পণ্য করা হয়নি।
আমি একজন মানুষ। মানুষ হিসাবে আমি ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। কেউ ভুল করলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। শরীয়তসম্মত উপায়ে সাজার নিয়ম আছে। তবে এর জন্য অবশ্যই দোষ প্রমাণিত হতে হবে। কেউ দাবি করল আর অমনি তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করা বা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা কিংবা কোনোভাবে নাজেহাল করা শরীয়া, আইন ও নীতি-নৈতিকতা পরিপন্থী।
বেফাকের সঙ্গে দেশের অধিকাংশ শীর্ষ কওমী আলেম বিভিন্নভাবে যুক্ত। এর নির্দিষ্ট সাংগঠনিক রূপ, বিভিন্ন কমিটি ও একটি গঠনতন্ত্র রয়েছে। বেফাকের সভাপতি, সিনিয়র সহসভাপতি ও অন্যান্য সহসভাপতি, মহাসচিব, সহকারী মহাসচিব, বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিবর্গ, শুরা ও আমেলার সদস্যবৃন্দসহ বেফাকে কর্মরত স্টাফগণের কেউই গঠনতন্ত্রের বাইরে নন। নীতি, নিয়ম মানতে তারা সকলেই বাধ্য। এ বিষয়ে কারও কোনো অভিযোগ নিয়মতান্ত্রিকভাবে বেফাক কর্তৃপক্ষের বরাবরে জানানোই শরীয়া, নৈতিকতা ও আইনের দাবি।
আমার মেয়াদকালে বেফাকের, আর বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল ক্বওমিয়্যার কো-চেয়ারম্যান হিসাবে এ দুটি প্রতিষ্ঠানে কোনোরূপ অনিয়ম হয়ে থাকলে আমার দায়িত্ব ও ক্ষমতা পরিমাণ অংশের দায়-দায়িত্ব আমার। এজন্য বেফাকের গঠনতন্ত্র আমাকে যেভাবে জবাবদিহি করতে বলেছে, তা আমি করতে বাধ্য। আমার সময়কালের আগের শত-সহস্র অনিয়ম বা ভুল-ত্রুটির দায় আমার নয়। এসবের সাথে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তারা বেফাকের শূরা, আমেলা ও গোটা কওমি ঘরানার সামনে জবাবদিহির জন্য তৈরি থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। একটি উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার ঝড় তৈরি করে সব যুগের সব ব্যক্তির সকল দায়-দায়িত্ব ও রাগ-জেদ একটি ব্যক্তি বা ব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়া কখনোই ন্যায় ও সুবিচার নয়। এলোমেলো প্রোপাগান্ডা, নিয়ম-অনিয়মের মনগড়া ব্যাখ্যা, গঠনতন্ত্র সম্পর্কে না জেনে সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর সিদ্ধান্ত ও পরামর্শকে জাল প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করে তা বিতর্কিত করা, এমনকি তাঁর সম্পর্কে যাচ্ছেতাই মন্তব্য, উক্তি এবং সমালোচনা করা, বেফাকের অভ্যন্তরীণ কর্ম-শৃঙ্খলা বিনষ্টে যে যার মতো অনধিকার হস্তক্ষেপ করা, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সামনে প্রকাশ্যে কোমলমতি ছাত্রদের উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গুটিকয় ব্যক্তিকে অফিসের ডেকোরাম অমান্য করার উৎসাহ প্রদান করা, ছাত্র-তরুণদের একাংশকে উদ্ধত ও প্রগলভ বানিয়ে তোলার মতো নিম্নমানের উস্কানি প্রদান করা—এক শ্রেণির লোকের ভুল চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি ছাড়া কিছুই নয়।
এসব বিষয়ে বেফাকের সিনিয়র মুরব্বীগণ সারা দেশের ওলামায়ে কেরাম ও চিন্তাশীল ছাত্র-তরুণ যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। কওমির ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের এই বিষময় ধারা এই মোবারক জামাতকে বিশাল ক্ষতির সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে। কথাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুনে এগুলোকে মুখরোচক গল্পের মতো প্রচার করা হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কল রেকর্ডের খন্ডিত অংশ প্রচার করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা চলছে। সে সবের ব্যাপারে দায়িত্বশীল শ্রেণী রহস্যজনক আচরণ করেছেন। উপরন্তু আমার ‘যবত ও আদালত সাকেত’ বলে কটাক্ষ করে আমাকে অপসারণের চেষ্টা করা হয়েছে। আমি সরে গেলেই কওমী অঙ্গন শান্ত হয়ে যাবে?
অনেকের প্রশ্ন, এত কিছুর পরও আমি কেন পদ আকড়ে আছি?
আমি ইনসাফ ও বিবেকের দরবারে বলতে চাই, আমি কেবল একজন ব্যক্তি আব্দুল কুদ্দুছ নই। আমাকে পদত্যাগ করতে বলা মানে বেফাকের মহাসচিবকে পদত্যাগ করতে বলা। এ দায় কেবল আমার ব্যক্তির নয়, বেফাকেরও। আমার সময়কালের কোনো অর্জন ও সুনাম যেমন বেফাকের অর্জন ও সুনাম তেমনি কোনো দুর্নাম ও ক্ষতিও বেফাকের দুর্নাম ও ক্ষতি। তাছাড়া কারও ব্যাপারে কোনো অভিযোগ উঠলে অবশ্যই তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এটাই ইনসাফ ও নীতি-নৈতিকতার দাবি। অথচ শুরু থেকেই বরং আমাকে হেনস্তা করার পাশাপাশি বাইরে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডায় ইন্ধন দেওয়া হয়েছে।
আমি মনে করি, যখন কথা উঠেছে অবশ্যই তা আলোচনা হবে। বিষয়টি সুরাহা হওয়াও প্রয়োজন। আর তা অবশ্যই হবে বেফাকের দায়িত্বশীলগণের মজলিসে। والمجالس بالأمانة অথচ তা চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরুর প্রথম দিকেই দ্বিতীয় দিনে আমি সিনিয়রদের সঙ্গে পরামর্শ ও প্রকৃত ঘটনা নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক তলব করেছি। তখন সমাধানে কেউ আগ্রহী বলে মনে হয়নি। অত্যন্ত দুঃখজনক প্রতিউত্তর পেয়েছি। তৃতীয় দিনে আমি প্রচারের জন্য বেফাকে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছি। মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে বিবৃতি পাঠালেও রহস্যজনক কারণে তিনি বেফাক থেকে তা প্রচার করতে অস্বীকৃতি জানান। উপরন্তু তাকে এ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে মর্মে মিডিয়ায় অপপ্রচারও করেন। অথচ বিষয়টি আমি অফিসিয়াল রুলস ও গঠনতন্ত্র মোতাবেক অত্যন্ত সাবলীলভাবে শুধু মহাপরিচালককে বলেছিলাম। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা মিডিয়া দেখতে চায়নি যে, কী লেখা ছিল সেই বিবৃতিতে।
এরপর বেফাকে মিটিং হয়। কোনো মিটিংয়েই আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের নিয়মতান্ত্রিক সুরাহার পথ বের করা হয়নি। প্রচারিত খন্ডিত ফোন কলের বিষয়েও আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। অথচ ফোন কল যে অসম্পূর্ণ ও খন্ডিত তা যেকোনো ব্যক্তির জন্য সহজেই বোঝা সম্ভব। কেবল বাইরের আলোচনা-সমালোচনার কথা উঠিয়ে বিভিন্নভাবে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই আমি যে দোষী নই, উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচারিত কল রেকর্ডের যে সুষ্ঠু ব্যাখ্যা আছে, তা যেন কারোরই শোনার ফুরসত নেই। অবশেষে বাধ্য হয়ে বেফাক সভাপতির কাছে আমার ব্যাখ্যা পেশ করেছি। ব্যাখ্যা পেশ করার পাশাপাশি আমি আমার সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছি। আমার সেই আবেদন না-মঞ্জুর করে হযরত আমাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেছেন এবং আমার বিষয়ে হযরতের পক্ষ থেকে বিবৃতিও প্রদান করা হয়েছে। সে বিবৃতি নিয়েও নানান কথা হয়েছে। বেফাক অফিস থেকে বলা হয়েছে, এ বিবৃতি চাপে পড়ে দেওয়া হয়েছে।
এহেন পরিস্থিতি দেখে যে কেউ এটাই বুঝবেন যে, বিষয়টির নিয়মতান্ত্রিক সুরাহা কেউই চান না। চাওয়া কেবল আমার সরে দাঁড়ানো। আমি চলে গেলেই সকলে স্বস্তি ও প্রশান্তি লাভ করবেন। বিষয় কেবল এতটুকু হলে আমি সরে যেতে প্রস্তুত। বরং আমি তো বেফাকে এভাবে কখনোই আসতে প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে আমেলা ও উমূমীর যে মজলিসে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সে মজলিসের সকলেই সাক্ষী যে, আমি দায়িত্ব গ্রহণে বার বার অপারগতা প্রকাশ করেছি।
খন্ডিত ফোনালাপ দুটির ব্যাখ্যা :
সহকারী নাযেম নিয়োগ দেওয়া প্রসঙ্গ : বেফকে কাউকে নিয়োগ দেয়ার জন্য নিয়োগ কমিটি রয়েছে। তারাই এ ব্যাপারে বলবেন। বেফাকে সহকারী নাযেমে ইমতিহান নিয়োগের প্রয়োজন ছিল। এজন্য লোকও খোঁজা হচ্ছিল। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং এ পদে আগ্রহী—সব মিলিয়ে লোক পাওয়া কিছুটা কঠিনই মনে হলো। নাযেমে ইমতিহান বার বার বলছিলেন যে, তিনি লোক খুঁজে পাচ্ছেন না। তখন আমি বলেছিলাম, ‘আমি একজন লোক দেব। যিনি এ পদের জন্য যোগ্য।’ সঙ্গে আমি এ কথাও বলি, ‘আমি যে তাঁর কথা বলছি এটা কাউকে বলবেন না।’ কথাটি উপস্থাপন করা হয়েছে এভাবে যে, আমি নিজ ক্ষমতাবলে লোক নিয়োগ দিচ্ছি। أستغفر الله العظيم
বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। মহসচিব নিজ ক্ষমতাবলে নিজস্ব লোক নিয়োগ দিবেন, এমন অপবাদ দেওয়া বা কথা বলার সুযোগ না রাখার জন্যই পরীক্ষানিয়ন্ত্রক মুফতী আবু ইউসুফ সাহেবকে ‘মহাসচিব সাহেবের পাঠানো লোক’ হিসাবে পরিচয় দিতে নিষেধ করেছিলাম। বরং সহকারী নাযেমের পদপ্রার্থী যিনি হবেন, তিনি তার যোগ্যতাবলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের নিকট যোগ্য প্রমাণিত হলে যেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ কার্য সম্পাদিত হয়, অযোগ্য হলে না হয়, মহাসচিবের প্রেরিত লোক বলে প্রচারিত হলে নিয়োগ বিভাগ যেন কোনোরূপ প্রভাবিত না হয় বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিধিবিধান লঙ্ঘিত না হয় সেজন্যই আমি নিজের কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলাম। এবং নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে যথাযথভাবেই পরিচালিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, সহকারী নাযেম হিসাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে এ পদে কোনো নিয়োগই হয়নি।
সুতরাং মহাসচিব নিজস্ব লোক নিয়োগ দিয়েছেন বা নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন, এধরণের কোনো কথা বলার কোনোই সুযোগ এখানে নেই। অতএব এক্ষেত্রে ফোনালাপ কোনো দূষণীয় বিষয় তো নয়ই; বরং তা নৈতিক দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা ও সতর্কতার আলামত। এ সতর্কতা প্রশংসার দাবিদার। দায়িত্বশীল ব্যক্তির নিজ কর্মকর্তাকে এই দাপ্তরিক নির্দেশনার ফোন রেকর্ড করা ও প্রকাশ করা; বরং শরীয়ত, গঠনতন্ত্র ও আইনের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। বিশেষ করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব কথা রেকর্ড করা, খন্ডিতাংশ প্রকাশ করা এবং এর অপব্যাখ্যা করে কাউকে হেয় ও অপরাধী সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা করা একটি জঘন্যতম নৈতিক অপরাধ।
তাকমীল মারহালায় সুযোগ প্রদান প্রসঙ্গ :
কেন্দ্রীয় পরীক্ষা দেয়নি এমন কাউকে বেফাক থেকে নম্বরপত্র দেয়ার অনুমতি কিংবা নম্বরপত্র প্রদান করার কোন নজীর আমার জানা মতে নেই।
(তাকমীল মারহালায় পরীক্ষার জন্য মিশকাতের মার্কশিট বাধ্যতামূলক করায় প্রথম বছর হিসাবে অসংখ্য মাদরাসার কয়েক হাজার শিক্ষার্থী নতুন নিয়মে আটকে যায়। এই নিয়মের আওতায় একটি বোর্ডেরও প্রায় সব মাদরাসা আল হাইয়াতুল উলয়ার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে যায়।
বোর্ডের অধীনে ফজীলত মারহালায় পরীক্ষা দেয়নি এমন অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই লাগাতার আবেদন আসতে থাকে যে, প্রথম বছরের সিদ্ধান্ত হিসাবে যেন তাকমীল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করা হয়। এত বিপুলপরিমাণের মাদরাসা ও তাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি লক্ষ্য করে বোর্ড কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তমতেই তাদেরকে নিজস্ব মাদরাসার মিশকাত জামাতের বার্ষিক পরীক্ষার মার্কশিটের মাধ্যমে তাকমীল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এতে শতাধিক মাদরাসা বোর্ড বহির্ভুত প্রতিষ্ঠানের মার্কশিট দেখিয়ে তাকমীল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এ বিষয়ে যেসব পরীক্ষার্থী সরাসরি বোর্ডে যোগাযোগ করেছে তাদেরকে বোর্ড থেকেও এধরণের পরামর্শই দেওয়া হয়েছে।
এ সুযোগটি শুধু তাদের জন্যই দেওয়া হয়েছে যারা মিশকাত জামাত এমন মাদরাসায় পড়েছে, যে মাদরাসা কোনো বোর্ডের আওতাধীন। আর যারা মিশকাত জামাত পড়েইনি, বা মিশকাতে অকৃতকার্য হয়েছে কিংবা কওমী মাদরাসা বহির্ভূত ছাত্র, তাদেরকে এই সুযোগ কোনোভাবেই প্রদান করা হয়নি। এ সুযোগ থাকার কারণেই ‘শুধুমাত্র প্রথম বছরের বিবেচনায়’ হাইআর স্থায়ীকমিটির সিদ্ধান্তক্রমেই বেফাক ও অন্যান্য বোর্ডের ইলহাকভুক্ত মাদরাসাকে এই সুযোগ দেওয়া হয়।)
এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মাদরাসার জন্য ব্যতিক্রম কিছু করার আদেশ আমার পক্ষ থেকে ছিল না এবং বেফাক থেকেও কাউকে জাল মার্কশিট দেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমি সব সময়ই তৎকালীন নাজেমে ইমতিহানকে ‘নিয়ম-কানুন মোতাবেক’ কাগজপত্র দাখিল করার কথা বলেছি। বেফাকেও আমার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কখনোই কোনো অন্যায় ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেইনি। অথচ আমার নির্দেশনার ক্ষেত্রে কিছু অংশ বাদ দিয়ে উক্ত নির্দেশনাকে বিতর্কিত করার হীন প্রয়াস চালানো হয়েছে।
আর এটা স্পষ্ট যে, প্রচারিত সেসব ফোনালাপ বিভিন্ন সময়ের খন্ডিত অংশ, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ফাঁস করা হয়েছে এবং বিভিন্ন খন্ডিত অংশকে জোড়াতালি, এডিট ও সুপার ইম্পোজ করা হয়েছে। আল হাইয়াতুল উলয়াতে পরীক্ষা দিতে না পারা পরীক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে বহুবার, কয়েক সপ্তাহ যাবত আলোচনা করা হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই কেবল খন্ডিত কিছু বক্তব্য সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। বিষয়টির পূর্ণ আলোচনা শুধু নাযেমে ইমতিহানের সাথেই নয়, বরং দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন জামিয়া প্রধানের সাথেও হয়েছে। তৎকালীন দায়িত্বশীল ও বোর্ড কর্মকর্তাদের কারও কাছেই তা গোপন ছিল না। সবগুলো আলোচনা সামনে আসলে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হবে, ইনশা’আল্লাহ।
এ বিষয়টি নিয়েও সংশ্লিষ্টদের আচরণ অর্থাৎ দাপ্তরিক নির্দেশনার ফোন রেকর্ড করা ও প্রকাশ করা শরীয়ত, গঠনতন্ত্র ও আইনের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। বিশেষ করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থে তার ক্ষুদ্র ও খন্ডিতাংশ প্রকাশ করা এবং এর অপব্যাখ্যা করে কাউকে হেয় ও অপরাধী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা একটি জঘন্যতম নৈতিক অপরাধ।
কালিমাতুল ইখতিতাম : (শেষ কথা)
আমার শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি গত কয়েক মাসের সমালোচনার ঝড় আমাকে মর্মাহত করেছে। করোনাকালীন অত্যন্ত অসুস্থতার সময়েও কোনো এক অজানা কারণে ফেসবুকের মতো প্রকাশ্য প্লাটফর্মে দলবদ্ধভাবে অশোভন ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। আর এর সবকিছুই হয়েছে আপনাদের চোখের সামনে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নীরব ভূমিকা আমাকে হতাশ করেছে, প্রচন্ড আঘাত দিয়েছে। যেসব অপবাদ, নিন্দা আর সমালোচনার বাক্যবাণে আমাকে জর্জরিত করা হয়েছে তার যদি কোনো সত্যতা থাকে তবে আল্লাহ যেন আমাকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন। আর যদি অসত্য হয়ে থাকে তবে আল্লাহর ইনসাফের হাওয়ালা করে দিলাম। আল্লাহ তাআলা-ই সর্বোত্তম বিচারক।
দুঃখজনক এ পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর শূন্যতা। হুজুরের শূন্যতা আমার জীবনে অপূরণীয় থেকে যাবে। আমার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময়ের প্রোপাগান্ডা, তোহমত ও অপপ্রচার এবং শায়খের বিদায় ও সার্বিক পরিস্থিতিতে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।
দায়িত্ব গ্রহণের পর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ আর মুরুব্বীদের দু’আর বরকতে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মাদরাসা সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যয় কমিয়ে আয় ও উন্নতির উর্ধ্বগতি, শক্তশিালী ফান্ড গঠন, নিজস্ব ভূমি ও ভবন সম্প্রসারণসহ নানামুখী কল্যাণমূলক কাজের জন্য আমি মহান আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করি। পাশাপাশি দুআ করি, বেফাককে এগিয়ে নিতে যারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন আল্লাহ পাক সকলকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
আমি আশাবাদ ব্যক্ত করছি, বেফাক যে উন্নতির পথে চলা শুরু করেছে, তার গতি দিন দিন আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং আকাবির আসলাফদের রেখে যাওয়া জাতীয় এই আমানতের সঠিক ও উত্তম ব্যবহার হবে ইনশা-আল্লাহ। আগামীতে যারাই এই বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদে আসবেন তারা দল, মত নির্বিশেষে বেফাককে তার আপন গতিতে সামনে নিয়ে যাবেন এবং এই আমানতকে সঠিক ও সর্বোত্তম পন্থায় জাতির নিকট পৌঁছে দিবেন। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মতো এই বৃহৎ প্লাটফর্মকে কেন্দ্র করে আর যেন কোনো ইখতিলাফ কিংবা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি না হয় সেজন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট আল্লাহর ওয়াস্তে অনুরোধ করছি।
পরিশেষে আমি সকলের কাছে আমার জন্য, আমার প্রাণপ্রিয় শায়খ আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব রহ. এর জন্য দুআ কামনা করে স্বাগত বক্তব্য শেষ করছি।
আসসালামু আলাইইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।