-জিয়া আল হায়দার
চীন এবং ইতালিতে করোনার তাণ্ডবে কেয়ামত দেখেও বাংলাদেশের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার সবগুলো সচিবালয় মুজিব বর্ষ পালনে সর্বব্যস্ত ছিল। এমন একটা অপ্রস্তুত অবস্থায় দেশে করোনা এলে জনমনে ভীষণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধিতে জনগণ হয়ে পড়ে দিশেহারা।তার উপর সরকারের অপ্রস্তুতি, সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থাপনা, করোনা টেস্ট কিট ও পরীক্ষা কেলেঙ্কারি মিলে তৈরি করে চরম মাত্রার অস্বস্তি। ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাত মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির লালসায় নিজেই হয়ে পড়ে মুমূর্ষ। ফলে মানুষজন জরুরী একটু অক্সিজেনের আশায় হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে।
রাস্তায়, হাসপাতালের বারান্দায় হুইল চেয়ারে স্ত্রীর সামনে স্বামীর, ডাক্তার কন্যার সামনে পিতার নির্মম মৃত্যু অবলোকন করে দেশবাসী। একদিকে এসব নজিরবিহীন ভোগান্তি, অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তাহীন অপরিকল্পিত লকডাউনে মানুষ যখন কর্মহীন এবং গৃহবন্দী, এমন সময় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তার সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দলীয় যেটুকু সামর্থ্য তা নিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন :
করোনা বিপর্যয়ে কর্মীদের জনকল্যাণে কাজ করার নির্দেশ আইএবি আমীরের
করোনাকালে ‘এক কোটি মানুষকে’ ত্রাণ দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন
বরিশালে চরমোনাই পীর ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ তিন ভাইয়ের খাদ্রসামগ্রী বিতরণ
ইসলামপন্থী রাজনীতির বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে 'খিদমাতুল খালক' বা সৃষ্টির সেবা। ইসলামী আন্দোলন ইসলামপন্থী রাজনীতির এই অনন্য দৃষ্টান্ত চোখে পড়ার মতো করে সামনে নিয়ে এসেছে করোনাকালে। করোনা মহামারীকে সরকারি দলের জনপ্রতিনিধিরা আখের গোছানোর মোক্ষম সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। লকডাউনে কর্মহীন সিরাজগঞ্জের এক শ্রমিকের কন্যা শিশু আফরোজা গলায় ফাঁস দিয়ে জীবনের বিনিময়ে ক্ষুধার জ্বালা মিটিয়েছে। ঠিক সে সময় চেয়ারম্যান মেম্বারদের পুকুর থেকে সরকারি ত্রাণের চাল উদ্ধার হচ্ছিল, মাটির নিচ থেকে ত্রাণের তেল উদ্ধার হচ্ছিল। একে একে স্থানীয় নেতাদের ত্রাণ কেলেঙ্কারিতে খাদ্যাভাবে মানুষের যখন মরণ দশা এমন সময় অন্যহীন মানুষের পাশে অকৃত্রিম মমতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে চরমোনাই পীরের অনুসারী আধ্যাত্মিকতাবাদী দলটি।
এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনের অঙ্গ সংগঠন ইশা ছাত্র আন্দোলন ক্যাম্পাসের কুকুরগুলোকে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করেছে। দলের ছাত্র শাখাকে দেখা গেছে হাটু পানিতে নেমে বন্যাকবলিত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতেও স্বেচ্ছাশ্রম দিতে দেখা গেছে তাদের। মিডিয়াগুলো ইসলামপন্থীদের এ সকল মানবিক কার্যক্রমকে বরাবরের মতই এড়িয়ে গেছে রহস্যজনক কারণে। তবে অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়লে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের এই কার্যক্রম ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
করোনাকালে ইসলামী আন্দোলন সবচেয়ে বড় যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে তা হচ্ছে, করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের লাশ দাফনের ব্যবস্থাপনা। সরকার যেখানে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত, লাশ দাফন সংক্রান্ত সরকারের কোন প্রস্তুতিই ছিল না, এমন একটা ক্রাইসিস মুহূর্তে ইসলামী আন্দোলন দক্ষতার সাথে সাড়ে চার শতাধিক করোনায় ইন্তেকাল করা লাশ সম্মানের সহিত দাফন করেছে বলে জাতীয় দৈনিকে দলীয় সূত্র দাবি করেছে। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজ ছিল, যা আন্দোলনের কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আঞ্জাম দিয়েছে।
করোনায় মৃতদের লাশ দাফনে ইসলামী আন্দোলন : চাঁদপুরেই সংখ্যা ১৫
করোনাকালীন ইশা ছাত্র আন্দোলনের কর্মতৎপরতা (ভিডিও)
করোনা মহামারিতে এ পর্যন্ত ৩০০ পরিবারকে সহায়তা প্রদান করেছে যুব আন্দোলন
ত্রাণের চাল চুরি এখন সবচেয়ে বড় মহামারী : ইসলামী যুব আন্দোলন
আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কেউ যখন লাশের পাশে আসছিল না, এমনকি নিজের রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত দূরে দূরে থাকছে, তখন মহামারীর মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ইসলামী আন্দোলনের তৃণমূল কর্মীদের এই সাহসী ও মানবিক কার্যক্রম বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পরবর্তীতে তাদের দেখাদেখি আরো কিছু সংস্থা এ কাজে এগিয়ে এসেছে। কাজেই ভবিষ্যতে করোনার কথা লিখতে গেলে ইসলামী আন্দোলনের নির্ভীক মানবতাপ্রেমী কর্মীদের এই দুঃসাহসী চ্যালেঞ্জিং অবদানকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সহিত তুলে ধরতে হবে।
ভুরি ভুরি অভিযোগ করলেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে তাদেরকে দেখা যায়নি। এমনকি ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি করোনা ইস্যুতে না পেরেছে শক্ত করে রাজনীতি করতে; না পেরেছে মানবিক সহায়তা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। অথচ তাদের যে জনগণ এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য তারা হাজার কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ করতে পারত চালচুলোহীন জনগণের মাঝে।
জেলা এবং থানা পর্যায়ে তারা করোনার জন্য ইমার্জেন্সি টিম গঠন করেছে। সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে যখন স্বাস্থ্যখাত, ত্রাণ বিতরণ, সচেতনতা সৃষ্টি, এবং সরকারের সিদ্ধান্ত গুলো ব্যাপক বিশৃঙ্খল ও সমন্বয়হীন হিসেবে সমালোচিত হচ্ছিল; তখন জাতীয় পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ইসলামী আন্দোলন সাড়ে চার শতাধিক লাশ দাফন করেছে কোন ধরনের সমন্বয়হীনতা ও বিশৃংখলার অভিযোগ ছাড়া। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে দারুণ ভাবে তারা এই মহা কর্মজজ্ঞ এখনো পর্যন্ত সম্পন্ন করে যাচ্ছে ।
মানুষের বিপদে তারা ধর্ম, দল,মতের ঊর্ধ্বে উঠে অসম্প্রদায়িক আচরণের দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পেরেছে। এজন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক লাশও সৎকারের ব্যবস্থা করেছে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা। মাঠে ময়দানে রাজনীতির তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগের পরিবারভুক্তদের লাশ দাফনেও এগিয়ে এসেছে তারা। এটা দল হিসেবে ইসলামী আন্দোলনকে উদার, মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক হিসেবে আলাদা পরিচিতি দান করেছে।
এটা ঠিক, ইসলামী আন্দোলন এই করোনাকালে রাজনৈতিক ফোকাসটা অন্যদের চেয়ে কম দিয়েছে। তারা কথা বলেছে কিন্তু করোনার রাজনীতিটাকে তারা খুব শক্তভাবে নেয়নি। এমনকি দলের আমীর ও নায়েবে আমির এবং তার অন্যান্য ভাইয়েরা করোনার এ সময় ঢাকার কোনো কর্মসূচিতে উপস্থিত হননি, এমন অভিযোগও উঠেছে। উল্টো দলের মহাসচিবের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় ফোরামের সকল নেতা ওয়াটার ওয়েজে আমিরের বাসভবনে গিয়ে মিটিংয়ে মিলিত হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের এমন রাজনৈতিক দায়িত্বহীনতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ সরগরম আলোচনা হতে দেখা গেছে।
তাদের কর্মকান্ডে যেটা প্রতিফলিত হয়েছে তা হল, দেশ ও মানুষ থাকলে রাজনীতি করার সময় পাওয়া যাবে। সরকারের ব্যর্থতা গুলো পরবর্তীতে তুলে ধরা যাবে। সারা বিশ্ব যখন মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে একটি মহামারী মোকাবেলা করছে তখন সময়টা যতটা না রাজনীতির; তার চেয়ে বেশি মানবতার। তারা বোধোয় মনে করেছেন, আপাতত জরুরী প্রয়োজন হচ্ছে কর্মহীন মানুষের খাদ্য সংস্থান করা, রাস্তায় পড়ে থাকা লাশগুলোকে সম্মানের সহিত বিদায় জানানো, এবং জনগণের উদ্বিগ্নতা ও আতঙ্ক দূর করে মানুষের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে না দেয়া।
কাজেই বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে করোনাকালে ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক ভূমিকার কঠিন সমালোচনা থাকলেও সামাজিক ও মানবিক ভূমিকার অকৃপণ প্রশংসা করতেই হয়। করোনাসময়ে ইসলামী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সফলতা অর্জন করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি, যা তাদের আগামী রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
রাজনীতি যদি হয় সার্বিকভাবে জনকল্যাণের। তাহলে আমি বলব, ইসলামী আন্দোলন করোনায় রাজপথের হুমকি-ধমকি এবং সরকারের কঠোর সমালোচনার পরিবর্তে সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের হৃদয়ে একটি স্থায়ী রেখাপাত অঙ্কন করতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে প্রশাসন, নিরপেক্ষ বিশ্লেষক এবং সরকার সংশ্লিষ্টরা ইসলামী আন্দোলনের এই দায়িত্বশীল ভূমিকা কে আগামী দিনগুলোতে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করবে নিশ্চয়ই।
চীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমে বিকল্প প্রভাব বিস্তারকারী ব্লক এ পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনকে একটি উদীয়মান গৌন্যশক্তি হিসেবে বিশ্লেষকরা বিবেচনা করছেন। সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে চীন দূতাবাসের সাথে ইসলামী আন্দোলনের এই যোগাযোগ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অভূতপূর্ব শুভ সূচনার মাইলফলক। করোনায় মানবিক কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে অর্জিত জনগণের ভালোবাসা ও প্রশাসনের সাথে সমন্বয় এবং চীনের সাথে যোগাযোগ এই তিনটি বিষয়কে যদি তারা পরবর্তীতে ধরে রাখতে পারে এবং অতীতের মত গঠনমূলক রাজনীতি চর্চা করে এগিয়ে যেতে পারে সেই সাথে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া পীর পরিবারের ভাতৃগণ ঢাকার রাজনীতিতে আরো বেশি সক্রিয় হন; তাহলে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে ইসলামী আন্দোলন প্রতিনিধিত্বের জায়গা দখল করতে সক্ষম হবে বলে আমার ধারণা।
জাতির এই ক্রান্তিকালে রাজনীতি ও দলীয় বিভেদ ভুলে প্রশাসনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার করোনায় লাশ দাফনকারীদের তালিকা করে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের এই ঝুঁকিপূর্ণ দুঃসাহসী কাজের জন্য সংবর্ধনা দিতে পারে। এটা করলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বিপর্যয় মুহূর্তে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিক আবেদনে গঠনমূলক সাড়া দিতে অনুপ্রাণিত হবে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, জাতীয় টেলিভিশন বিতার্কিক, রাষ্ট্রচিন্তক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে পাবলিক ভয়েসের সংবাদ পরিবেশনা :
শ্রীনগরে বন্যা দুর্গত মানুষের মাঝে যুব আন্দোলন সভাপতির ত্রাণ বিতরণ
‘ভাগ চেয়ে’ ইসলামী আন্দোলনের ত্রাণ বিতরণে প্রভাবশালীর বাধা
অসচ্ছল ও গরীবদের মাঝে ‘ইসলামী আন্দোলন ভোলা দক্ষিণের’ ত্রাণ বিতরণ
পীর সাহেব চরমোনাইর পক্ষে উপকূলীয় অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ
ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে বললেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর
ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে বললেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর
মিরপুরে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে পীর সাহেব চরমোনাই’র ত্রাণ
রাজধানীতে ইশা ছাত্র আন্দোলনের ইফতার ও ঈদসামগ্রী বিতরণ
উখিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের ইফতার সামগ্রী বিতরণ
দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ত্রাণ কমিটি গঠনে লুটপাট আরও বাড়বে : আতাউর
১৮ ভাড়াটিয়ার ভাড়া মওকুফ করলেন রাঙামাটির আইএবি নেতা, দিচ্ছেন ত্রাণ
চাঁদপুরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কর্তৃক করোনায় মৃতদের জানাযা-দাফন নিয়ে বিশেষ একটি লাইভ দেখুন :