নেত্রকোনা জেলার মদন থানার উচিতপুরের মর্মান্তিক ট্রলারডুবির ঘটনায় নিহত ১৭ জনের মধ্যে একজন ছিলেন এ অঞ্চলের স্বপ্নবাজ আলেম মাওলানা মাহফুজুর রহমান।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় কেবল তিনিই নন উজাড় হয়ে গেছে তার পরিবার। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার সিরতা ইউনিয়নের চর কোনাপাড়ার প্রশিদ্ধ মারকাযুস সুন্নাহ হাফিজিয়া মাদরাসার পরিচালক।
তিনি নিজ উদ্যোগে তাঁর পরিবার ও পরিচিতদের অনেকেসহ ঈদ পরবর্তি একটু ঘোরাঘুরির জন্য প্রায় ৪৬ জনসহ ট্রলারে করে হাওর দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো - এই আনন্দযাত্রা এমন বিষাদ আর শোকের ছায়া নিয়ে আসবে।
বলা যায় - এই একটি ঘটনায় তাঁর পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। এভাবে একই পরিবারের ৮জনের মৃত্যুবরণ করার শোক সইতে পারা বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন সবাই।
মাওলানা মাহফুজ এ অঞ্চলের একজন প্রশিদ্ধ আলেম ও হাফেজ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রচারবিমূখ হাফেজে কুরআন গড়ার কারিগর। একজন প্রকৃত স্বপ্নবাজ আলেম। ময়মনসিংহের চরাঞ্চলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহে মেয়ে হাফেজা তৈরীর পেছনে তার অবদান ছিল সর্বাগ্রে। সারা বাংলাদেশেই তাঁর হাতে গড়া কয়েকশ হাফেজা রয়েছে।
ময়মনসিংহের সাহিত্য সংগঠন শিকড় সাহিত্য মাহফিলের অন্যতম সাথী ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সাথে পরিচিত মুজীব রাহমান তার বিষয়ে বলেন -
... গত বছরখানেক আগে ২০১৯ সালের রমজানে হাফেজ মাহফুজের সাথে আমার পরিচয় হয়। খুবই মিষ্টভাষী, মেধাবী, প্রতিভাবান ও স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে নিজ হাতে গড়ে তুলে ছিলেন দুটি মানসম্মত হিফজ খানা। একটি বালকদের আরেকটি বালিকাদের জন্য। তার হাতে গড়া মেয়ে হাফেজাই ছিল প্রায়ই দুইশত। তিনি অভিনব এক সিস্টেমে মেয়েদের হাফেজা বানাতেন।
মাহফুজ ভাইকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম। এভাবে কি হাফেজা হওয়া সম্ভব? তিনি খানিকটা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন। মুজীব ভাই, অবশ্যই সম্ভব। শুধু মুখে বলেই নয়, আমি প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছি। আপনার মত প্রথমে অনেকেই আমাকে এমন প্রশ্ন করত। বিরোধিতাও করত অনেকে। এখন তারাও এমন পরিকল্পনার চেষ্টা করছে।
মাহফুজ ভাই সেদিন আরো বলেছিলেন, সারা বাংলাদেশ থেকেই অসংখ্য মানুষ যোগাযোগ করে তাদের মেয়েদেরকে ভর্তি করার জন্য। আমি সাফ না করে দেই। আমার এখানে আবাসিক ব্যবস্থা নেই।
তিনি বলেছিলেন, পুরোনো সিস্টেমের বাহিরে কিছু করতে গেলেই বাধা আসে। তবে একবার নিজের কাজকে প্রমান করতে পারলে আর কোন সমস্যা নেই। তিনি সেদিন খুব আফসোস করে বলেছিলেন, সারাদেশেই মানুষ এখন মেয়েদেরকে হাফেজা বানাতে চাচ্ছে কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ অভিভাবকরা পাচ্ছে না।কী পরিমাণ চাহিদা অভিভাবকদের এ চরাঞ্চলের দিকে লক্ষ করলেই বুঝা যায়। চরের আমার এ ছোট্ট প্রতিষ্ঠানেই দেড় শতাধিক ছাত্রী আসে কুরআনের হাফেজা হতে। তাহলে বুঝেন মেয়েদের হাফেজা বানাতে অভিভাবকরা কতটা আগ্রহী?
তিনি একজন হাফেজ হলেও আমার কাছে একজন চিন্তাশীল মানুষও মনে হয়েছে তাঁকে। হিফজ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার নিজস্ব একটি অলিখিত সিলেবাস ছিল।ছিল কুরআনের আলোকে প্রতিটি ঘরে পৌছে দেয়ার নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও।
প্রসঙ্গত : নেত্রকোনা জেলার মদন থানার উচিতপুরে ট্রলার ডুবে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ প্রায় ১৭ জন নিহত হয়। নিহত ১৭ জনের ১৩ জনের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার সিরতা ইউনিয়নের চর কোনাপাড়ায় যাদের মধ্যে ৮ জন মাওলানা মাহফুজের পরিবারের। এবং গৌরিপুর উপজেলার রয়েছে ৪ জন। প্রায় সবাই-ই মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষক।
নিহতরা হলেন- ‘মাদরাসায়ে মারকাজুস সুন্নাহ’র মুহতামিম হাফেজ মাওলানা মাহফুজুর রহমান (৪৫), তার দুই ছেলে হাফেজ মাহবুবুর রহমান আসিফ (১৫) ও মাহমুদুর রহমান (১২), ভাগ্নে রেজাউল করিম (১৫), ভাতিজা জোবায়ের (২০) ও জোনায়েদ (১৭), ভাতিজি লুবনা (১৩) ও জুলফা (৭), চরখরিচা গ্রামের কৃষক ইসা মিয়া (৪০) ও তার ছেলে শামীম (১০), কোনাপাড়া গ্রামের মাদরাসা শিক্ষক আজাহারুল ইসলাম (৩৮), হামিদুল (৩৫), সাইফুল ইসলাম রতন (৩০) ও জহিরুল ইসলাম (৩৫), চরগোবিন্দপুরের তালেব মেম্বারের ছেলে শহিদুল (৪০) এবং গৌরীপুর উপজেলার ধোপাজাঙ্গালিয়া গ্রামের আবুল কালামের ছেলে শফিকুর রহমান (৪০) ও তার ছেলে সামাআন (১০)।
আরও পড়ুন :
ঘুরতে আসা মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ নেত্রকোনায় ট্রলারডুবি : ১৭ জন নিহত
নেত্রকোনায় ট্রলার ডুবির ঘটনায় আল্লামা বাবুনগরীর শোক প্রকাশ
নেত্রকোনায় ট্রলার ডুবির ঘটনায় মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীমের শোক প্রকাশ
এইচআরআর/পাবলিক ভয়েস