মাওলানা ফয়সাল আহমদ জালালাবাদী
হযরত ওমর ফারুক (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। তার শাসনামলে সর্বক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্টা করেছিলেন তিনি। অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি বন্ধে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইতিহাসে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অনুকরণীয় হয়ে আছেন আজও। উন্নত রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ ছিলো অবিস্মরণীয়।
খেলাফতে ইসলামীর সুষ্ঠ পরিচালনা এবং তাঁর গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক শাসন-কাঠামোর বাস্তব রুপ দাড় করানোর জন্য উপযুক্ত এবং আদর্শবাদী কর্মচারী নিয়োগ করাই ছিলো হযরত ওমর (রা.) নিকট সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা যোগ্য শাসনকর্তা এবং দেশের আইন-কানুন উন্নত ও সুষ্ঠ হওয়া সত্তেও প্রত্যেক কর্মচারী সৎ ও কর্মনিষ্ঠ না হলে দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও সমৃদ্ধি কিছুতেই সম্ভব নয়। হযরত ওমর (রা.) এর নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি অর্পিত কাজ সম্পাদনে অধিক যোগ্য হতো। ঐ কাজে এর চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি খুজে পাওয়া যেত না। এক কথায় কর্মচারী নিয়োগে হযরত রা.এর পদ্ধতি ছিলো অত্যন্ত নিপুন।
তিনি অতিসহজেই মানুষের প্রতিভার পরিচয় লাভ করতে পারতেন। খলীফা অনেক সময় বিভিন্ন জেলার কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলার জনসাধারণের নিকট থেকে রায় নিয়ে তাদের মতামতে নির্বাচিত যোগ্যতম ও বিশ্বাসী ব্যক্তিকে প্রেরণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় নির্দেশ জারি করতেন। জনসাধারণ কর্তৃক মনোনিত ব্যক্তিকেই ঐ জেলায় নিয়োগ দিতেন। তিনি দুর্নীতি দমনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১. আমলাদের বেতন নির্ধারণ
সে যুগে অনেকেই রাষ্ট্রের সেবা করে বেতন-ভাতা গ্রহণ করতে অপছন্দ করতেন; এমন কি অনেকে বেতন গ্রহণ করাকে তাকওয়া-পরহেজগারির পরিপন্থী মনে করতেন। কিন্তু জনসাধারণের নিকট থেকে হাদিয়া-উপঢৌকন গ্রহণ করাকে আবার বহু মানুষ দূষণীয় মনে করতেন না। এটা দেশ বা প্রতিষ্ঠানের শাসন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতো। হযরত ওমর রা.অত্যান্ত দৃঢ়তার সাথে এই ভুল ধারণার নিরসন করে প্রত্যেক কর্মচারীর জন্য নির্দিষ্ট বেতন নির্ধারিত করে দেন।
২. কর্মচারীর শপথ গ্রহণ
যে কোন জেলার জন্য কর্মচারী নিয়োগ প্রদান করে প্রেরণের সময় হযরত ওমর রা.একদল সাহবায়ে কেরামের সম্মুখে তার হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিতেন।সমবেত সাহাবীগণ উক্ত কর্মচারীর যোগ্যতা,দায়িত্ব ও ক্ষমতার সাক্ষী হতেন। অতঃপর তার নিকট থেকে শপথ গ্রহণ করতেন।
৩. কর্মচারীদের সম্পত্তির তালিকা প্রস্তুত
যে কোন কর্মচারী নিয়োগকালে তার স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির বিস্তারিত তালিকা প্রস্তুত করে তা খলীফার দফতরে সযত্নে সংরক্ষণ করা হতো। কোন কর্মচারীর সম্পত্তিতে অস্বভাবিক উন্নতি দেখা দিলে তৎক্ষণাত তার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। এক সময় বিশিষ্ট কর্মচারীর সম্পত্তিতে প্রাচুর্য দেখা দিলে খালেদ বিন ছাআক নামক জনৈক কবি তার কবিতা দ্বারা এ দিকে খলীফার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। হযরত ওমর রা. ঐ সমস্ত কর্মচারীর সম্পত্তির হিসাব নিয়ে প্রত্যেকের অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বায়তুল মালে অন্তর্ভুক্ত করেন।
৪. কর্মচারীদের শাস্তির ব্যবস্থা
হযরত ওমর (রা.) হজের সময় বিরাট সভা আহ্বান করে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতেন, কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ থাকলে বলতে পারো। লোকেরা সামান্য অভিযোগ পর্যন্ত তাঁর নিকট পেশ করতো। হযরত ওমর রা.সুক্ষ্ম বিবেচনা করে তার প্রতিকার করতেন। প্রয়োজনে তিনি শাস্তি প্রদান করতেন।
৫. তদন্ত বিভাগ প্রতিষ্ঠা
সময় সময় কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তা তদন্তের জন্য হযরত ওমর একটি নতুন পদের সৃষ্টি করেন।মুহম্মদ বিন মাসলামা রা.কে এই পদে নিযুক্ত করেন।কোথাও হতে কোন অভিযোগ আসলে ওমর রা.তাঁকে সেখানে প্রেরণ করতেন।তিনি সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ করে হযরত ওমর রা.এর নিকট রিপোর্ট পেশ করতেন।কোন কোন ঘটনার তদারকির জন্য একাধিক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন প্রেরণ করতেন।কোন কোন ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খলীফার দরবারে তলব করা হতো।
৬. তাকওয়া-পরহেযগার হলেই পদ দেয়া ওমরি আদর্শের পরিপন্থী!
হযরত আম্মার বিন ইয়াসির রা.অনেক মর্যাদাবান সাহাবি ছিলেন। তাকওয়া-পরহেযগারীতে তাঁর কোন তুলনা ছিল না;কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞান তাঁর মোটেই ছিলো না। তাঁর জনপ্রিয়তা এবংঅন্যান্য কয়েকটি কারণে হযরত ওমর রা.তাঁকে একবার কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে যখন দেখা গেল যে, তাঁর দ্বারা শাসনকার্য মোটেই চলে না, তখন হযরত ওমর রা. তাঁকে অপসারিত করে হযরত আম্মার রা.এর সমর্থকদেরকে দেখিয়ে দিলেন যে, তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করার উপযোগী নন।আমাদের মাদরাসা অঙ্গনে বিষয়টি আজ উপক্ষিত হচ্ছে।অস্থিরতাও বাড়ছে।
আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতি সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। কোন অবস্থাতেই দুর্নীতি দমন হচ্ছে না।এমন কি আজ কওমি অঙ্গনে কতিপয় দরবারি পদলোভী দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। শত বছরের ঐতিহ্য-অবদানসহ মান-সম্মান ভুলণ্ঠিত হচ্ছে।
আসুন! পরিবার,সমাজ,প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে কুরআন-হাদিসের আলোকে পরিচালিত ওমরি শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ ও কায়েম করি। তবেই অন্যায়, জুলুম, স্বজনপ্রীতি, সেচ্ছাচারিতা, খেয়ানত এবং দুর্নীতি বন্ধ হবে। ফিরে পাবো আমরা ন্যায়-ইনসাফ ও শান্তিপূর্ণ শৃঙ্খল পরিবেশ। ইনশাআল্লাহ।
লেখক : মুহাদ্দিস, দারুল উলুম মাদানী নগর ঢাকা