কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর দায়িত্বশীলদের অনেকের ফোনালাপ ফাঁস ও বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে সরগরম ফেসবুক অঙ্গন। গত প্রায় ১৫ দিন ধরেই কওমী অঙ্গনের ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্টরা এ বিষয়ে ধারাবাহিক ভাবে কথা বলে আসছে।
এই পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনার মধ্যেই আজ (১৪ জুলাই) বেফাক অফিসে খাস কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো বেফাকের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীলকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে দেয়া।
বেফাক থেকে তিনজন বরখাস্ত : দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত চলবে
আল্লামা আ. কুদ্দুসের সভাপতিত্বে হাইআর বৈঠক : চামড়া সিন্ডিকেট বন্ধের দাবি
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে উত্তাল প্রতিক্রিয়া। বেশিরভাগ কওমী ছাত্র-ছাত্রীরাই এ বিষয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন এবং তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ফেসবুকে।
বিশেষ করে বেফাক মহাসচিব আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস এবং মাওলানা আব্দুল কুদ্দুসের বোন জামাই মাওলানা নুরুল আমিন, আল্লামা শফিপুত্র আনাস মাদানীসহ একাধিক ব্যক্তিদের উপরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।
এমনকি কেউ কেউ "কওমী ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ" নামের একটি সংগঠনের নামে প্রতিবাদি মানববন্ধনের হুঁশিয়ারি দিয়ে একটি পোস্টারও ছড়াচ্ছেন। তবে এই সংগঠনে কারা কিভাবে রয়েছে তা জানা যায়নি।
এই পোস্টার পোস্ট করা তরুণ আলেম মাওলানা মুহিউদ্দীন কাসেমী পাবলিক ভয়েসকে বলেন - আমি জানি না এটা কারা করছে তবে আমি এই দাবির সাথে একমত। এবং বেফাকে যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত তারা অবশ্যই এই বোর্ডে থাকা উচিত না বলে আমি মনে করি। এজন্যই আমি এই পোস্টটি আমার আইডিতে দিয়েছি।
একই পোস্টার পোস্ট করেছেন ফেসবুকের পরিচিত মুখ সালাউদ্দিন মাসউদ। এছাড়াও তিনি একটি পোস্টে লিখেছেন - গডফাদারদেরকে বাঁচাতে খুনি মাস্তানকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। এভাবেই খুনের নির্দেশদাতারা নিরাপদে পার পেয়ে যায়। অন্যরা এ কাজগুলো করলে মেনে নেওয়া যায় তবে লেবাসধারী পীর, শাইখুল হাদিস ধরনের লোকেরা যখন এ কাজগুলো করে, তখন ডঃ জাফর ইকবালের ঐ কথাটা ........ গল গল করে...... ঐ কথাটা বলতে হয় ....... থাক আর বললাম না। পদলোভী স্বার্থান্বেষী এই মহল কওমি অঙ্গনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেই ছাড়লো।
তিনি কেন এই ছবি পোস্ট করেছেন তা জানতে তাঁর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ইসলামী লেখক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত মাহমুদুল হক জালীস এক জায়গায় মন্তব্য করে লিখেন, "এতো কিছুর পরও পদত্যাগ করতে পারছে না। আর হুজুর হুজুর করে করে জাতি ধ্বংস করতে চাই না। ছাত্ররা সজাগ থাকলে দালালেরা সামনে আর এসব করতে পারবে না।"
এ বিষয়েও মাওলানা মুহিউদ্দীন কাসেমী তাঁর আইডিতে লেখেন - "নিজের তদন্ত নিজে করার উদ্ভট সিদ্ধান্তের কথা শুনতে পাচ্ছি। সত্য নাকি? এই ঘটনা সত্য হলে শুধু বাংলাদেশে না, পুরো পৃথিবীতে বিরল রেকর্ড হবে। গিনেস বুকে নাম উঠবে! কারণ, নিজের তদন্ত নিজে করার ঘটনা বিশ্বে এই প্রথম। পৃথিবীর একটা নিয়ম হল, শাস্তি পায় দুর্বলরা। শক্তিমান ও শক্তিশালীদের বিচার হয় না। এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় খুব কম।"
মুহিউদ্দিন কাসেমীর পোস্টে আবদাল হোসেন নামে একজন কমেন্ট করে লিখেছেন - "যদি বেফাক এবং হাইয়াতুল থেকে সমস্ত দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় তাহলে আমাদেরও একটা সিদ্ধান্ত আছে সেটা হল আমার পরিবার অথবা কোন আত্নীয় স্বজন কাউকে বেফাক অথবা হাইয়াতে পরিক্ষা দিতে দেব না এটা আমাদের সিদ্ধান্ত। ইনশাআল্লাহ"
এছাড়াও মাসিক যুবকন্ঠের সম্পাদক নেয়ামতুল্লাহ আমিন তার ফেসবুক আইডিতে উসামা মুহাম্মদ নামে একটি অপরিচিত ফেসবুক আইডির বরাত দিয়ে লিখেছেন - আজ মহাসচিবকে পদত্যাগ করতে বলা হলেও তিনি করেননি! আজকের বৈঠকে মহাসচিবকে পদত্যাগ করতে বলা হলে তিনি নাকচ করে দেন এবং তার সাথে ভেটো দেন আনাস বিন শফী এবং সাজিদুর রহমান সাহেব। মহাসচিব বললেন: আমি এভাবে পদত্যাগ করবোনা, আমি এখান থেকে কয়েকজনকে নিয়ে গিয়ে হাটহাজারী হুজুরের সাথে কথা বলবো। পরে এভাবে বিষয়টি ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আমরা তরুণ প্রজন্ম দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে আবারো ঘোষণা করছি "আব্বা কইছে কিংবা হাটহাজারী হুজুর কইছে" এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত আমরা শুনতে ও মানতে প্রস্তত নই। আমাদের দাবী, যা হবে স্বাধীন মতামত পেশ করা যায় এমন শুরার মাধ্যমে হবে কোন সিন্ডিকেটের সুযোগ দেয়া হবেনা। সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট খেলা আজ আমাদের এতো অধঃপতনে নিয়ে এসেছে। আমরা আর কোন অজুহাতে কালক্ষেপন চাইনা। পরিস্থিতি ঘোলাটে না করে তিনি দ্রুত পদত্যাগ করবেন বলে আশা করি।
তবে মানববন্ধনের ঘোষণা ও এইসব ফেসবুক প্রতিবাদের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন অনেকে। জুবায়ের বিন আরমান নামে একজন লিখেছেন -
শুরুতেই বলে রাখি, বিতর্কের প্রয়োজন নেই। যার খুশি আন্দোলন করুন। তবে আমার মতে এসব আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটা কওমীর চিরচেনা পথ নয়। যেখানে বড়রা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সেখানে কারা জানি এসব উসকে দিচ্ছে? আজ যদি কওমী ছাত্ররা এই পথ অবলম্বন করে কাল তারা শিক্ষকদেরে পেটাতেও দ্বিধা করবে না।
যারা আমাদেরে মানতে চান, তাদের বলবো থামো প্রিয় ভাইয়েরা? এসবে সাপোর্ট দিও না। যথাসম্ভব দূরে থাকো। শয়তান তাদেরে দিয়ে সেই কাজ করাবে যে কাজ উসমান রাযি. যুগে দুষ্কৃতকারীরা করেছিলো। জানি তারা সেরকম খারাপ নয় এবং যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তিনিও উসমান রাযি. এর মতো পবিত্র নন। তবুও রক্তের দারপ্রান্তে তারা পৌছে যাবে! এটা ধ্বংসের পথ। আমরা এই পথ থেকে মুক্ত।
আমরা দোয়া করি, অপরাধীকে সরিয়ে দেওয়া হোক। (না সরালে তারাই দায়ী থাকবেন। আমাদের কিছুই যায় আসে না)। আমরা চাই কাওমী অক্ষুণ্ণ থাকুক, বেফাক অক্ষুণ্ণ থাকুক।
ফয়েজ আহমদ নামে একজন লিখেছেন-
... কওমী অংগন এ সামান্য ঘটনায় এতোটাও বিপাকে পরেনি যে রিতিমতো মানববন্ধন করতে হবে। নিন্দুকেরা তালিয়া বাজাচ্ছে মনে রাখবেন।
প্রসঙ্গত : বাংলাদেশে কওমী মাদরাসা শিক্ষার সর্ববৃহত বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফের সাথে বিভিন্ন সময়ে কওমী মাদরাসার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের সাথের বেশকিছু ফোনালাপ প্রকাশ পেয়েছে ফেসবুকে। যা নিয়ে উত্তাল হয়ে আছে ফেসবুকের কওমী অঙ্গন। এমনকি সার্বিক এই বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আজ ১৪ জুলাই বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার কেন্দ্রীয় কার্যালয় এক জরুরি বৈঠক করা হয়েছে। যে বৈঠকে বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু ইউসুফ এবং বেফাকের পরিদর্শক মাওলানা ত্বহা এবং পরীক্ষা বিভাগের সঙ্গে কর্মরত ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল গণীকে বেফাকের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আরও সংবাদ পড়ুন :
বেফাকের ফোনালাপ ফাঁস ও মার্কশীট দুর্নীতি : ফেঁসে যেতে পারে শতাধিক মাদরাসা
মাদরাসা খুলতে সরকারের সাথে যোগাযোগে হাইআর সাব-কমিটিতে আছেন যারা