শাহনূর শাহীন, পাবলিক ভয়েস: প্রায় এক মাসের আক্ষেপ। ৬ এপ্রিল থেকে ৭ মে। দিন গণনায় ৩২দিন পর মসজিদ উন্মুক্ত হলো। দীর্ঘ দিনের আক্ষেপ ঘুচিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (৭ মে) প্রথম দলবেঁধে বাধাহীনভাবে মসজিদে প্রবেশ করতে পেরেছে মুসুল্লিরা।
মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবরোধে গত ১৭ মার্চ সারাদেশে সব ধরণের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করে সরকার। মিছিল, মিটিং, সমাবেশ, ধর্মীয় সভা, ওয়াজ মাহফিলসহ সব ধরণের জনসমাগম নিষেধ করা হয়। বন্ধ ঘোষণা করা হয় স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মাদরাসাসহ যাবতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এরপর গত ২৬ মার্চ সারাদেশে সব ধরণের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, কার্যালয়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরইমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউনের আওতায় যেতে থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল-এলাকা।
ধারাবাহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় মুসুল্লিদের কলজে আঘাত করার মতো সংবাদ আসে গত ৬ এপ্রিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ওইদিনই মসজিদে প্রবেশ সীমিত করে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার।
দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামাদের পরামর্শ নিয়ে মহামারী রোধে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে করণীয় নির্দেশনা অনুসারে মসজিদে প্রবেশ সীমিত করে সরকার। যদিও পরবর্তীতে দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় আলেম ওলামারা মসজিদে মুসুল্লি সংখ্যা নির্ধারণের প্রতিবাদ জানিয়ে মসজিদ খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ সরকারকে কঠোর হুমকিও দিয়েছিলেন।
এরইমধ্যে বিজিএমই এর অনুরোধে সরকার প্রথমে সীমিত পরিসরে গার্মেন্টস খুলে দেয়। কিন্তু বাস্তবে পুরোপুরিভাবে গার্মেন্টস খুলে দেয় মালিকপক্ষ। এমনকি অন্যান্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান, কল-কারাখানাও খুলে দেয় মালিক পক্ষ।
এরপর গত ৪ মে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর বিভাগের সাথে কনফারেন্সকালে শপিংমল, দোকানপাট খুলে দেওয়ার আগাম ঘোষণা দিলে শিথিলতা চলে আসে সার্বিক চলাচলে।
[caption id="attachment_76572" align="alignnone" width="570"] খাদেমুল ইসলাম মসজিদে জামাতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মুসুল্লিরা, শনির আখড়া।[/caption]
পরবর্তীতে জনপ্রশাসনের জারি করা প্রজ্ঞাপনে যদিও বলা হয় ঈদের আগ পর্যন্ত ছুটি বহাল থাকবে, দোকাটপাট খোলা থাকবে কিন্তু কেউ স্থানান্তর হতে পারবে না। যারা ঢাকায় আছেন তারা গ্রামে যেতে পারবেন না, গ্রাম থেকেও কেউ ঢাকায় আসতে পারবে না। দোকাট-পাট শপিংমল খোলা হবে স্থানীয়ভাবে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। জনগণ, ভোক্তা, মালিক সবাই নিজেদেরে মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় লকডাউন প্রত্যাহারের। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে যে যেভাবে পারছে যাচ্ছে-আসছে। এরপরই মসজিদ খুলে দেওয়ার দাবি আরো জোরালো হতে থাকে। সর্বশেষ গতকাল বুধবার প্রথমে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ শর্ত সাপেক্ষে মসজিদ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলায় হয় ৬ দফা শর্তে মসজিদে মুসুল্লিরা প্রবেশ করতে পারবে এবং জুমাহসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে জামাতে নামাজ পড়তে পারবে। এই নির্দেশনা আজ বৃহস্পতিবার জোহর থেকে কার্যকরের কথা বলা হয়েছে; কার্যত মসজিদ উন্মুক্ত হয়েছে আরো আগেই।
আজ বৃহস্পতিবার বিভিন্ন মসজিদে সরেজমিনে কথা হয় মুসুল্লিদের সাথে। শহরের মসজিদগুলোতে আজকে মুসুল্লিদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকারমসহ সব মসজিদেই ছিলো মুসুল্লিদের হাঁফছাড়া অনুভূতির দৃশ্য লক্ষ্যণীয়।
রাজধানীর শনিরআখড়ায় কথা হয় কয়েকজন মুসুল্লির সাথে। শনিরআখড়া বাজার মসজিদের মুসুল্লি মিনারুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় এক মাস পরেই আজকে মসজিদে এসেছেন জামাতে নামাজ পড়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করে সেজদা দেওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার মতে, মসজিদগুলো সতর্কতার সাথে সব সময় উন্মুক্ত রাখা উচিত।
কেননা, প্রথমত- মসজিদে যারা আসে তার প্রত্যেকেই সচেতনতার সাথে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে অযু করে প্রবেশ করেন। দ্বিতীয়ত, যারাই মসজিদে আসেন তারা আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রাণ খুলে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাআলা হয়তো এই প্রার্থনার উসিলায় আমাদের থেকে করোনাভাইরাস নামক আজাব উঠিয়ে নিতে পারেন’।
বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদের মুসুল্লি সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগে থেকেই মসজিদগুলো খোলা রাখা উচিত ছিলো।
এই প্রতিবেদকের কাছে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘হাফ বেলার জন্য বাজার খোলা রাখা যেতে পারে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই বাজার-সদাই করে সেখানে দিনের কিছু সময়ের জন্য মসজিদ খোলা রাখতে অসুবিধা কোথায়?’। ‘মুসুল্লিরা তো অন্তত পক্ষে অন্য সবার চেয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। তাদেরকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাঁধা দেওয়াটা মোটেও ঠিক নয়’ বলেন সাইফুল ইসলাম।
এদিকে, গার্মেন্টস এবং শপিংমল খুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকেও বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গার্মেন্টস এবং শপিংমল খুলে দেওয়ায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। কারণ এসব এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত লোকজনের চলাচল বেশি।
বিশেষ করে বাজারে বা দোকান-পাটে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকজনের চলাচল হয়। সেক্ষেত্রে কে সুস্থ কে অসুস্থ এটা নির্ণয় করা প্রায় নিশ্চিতভাবে অসম্ভব। অথচ এখন প্রতিদিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা রেকর্ড হারে বাড়তেছে। সুতরাং এই মূহুর্তে এভাবে বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়াটা চরম ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
সরেজমিনে মসজিদ থেকে ছবি ও তথ্য পাঠিয়েছেন মাহিন মুহসিন