সাকিব মুস্তানসির; সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক।
গার্মেন্টস সেক্টরে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। দেশের বড় বড় অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ইতোমধ্যে তা বাস্তবায়ন করছে। গতমাস হতে তারা তাঁদের শ্রমিকদের বর্ধিতহারে বেতনও দিচ্ছেন। বড় সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এখনো নতুন স্কেল কার্যকর করেনি আর কিছু প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করতে অক্ষমতা জানিয়েছে। তাই ধরেই নেয়া যায় আগামী বেশ কয়েকমাস শ্রমিকদের বড় একটা অংশ রাস্তায় আন্দোলনে কাটাবে ।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আন্দোলনরত একদল শ্রমিকের সাথে কথা বলে জেনে ছিলাম তারা একটা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন যেই প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় বিদেশী অর্থলগ্নি আছে। এবং কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ সুনাম ছিল যথা সময়ে বেতন ভাতা পরিশোধ করে দিতেন অথচ নতুন মজুরি নীতিমালা পাশ হলে শ্রমিকদের তারা জানিয়ে দিয়েছেন যে নতুন স্কেলে বেতন দিতে তারা অপারগ! যারা চায় যারা নতুন স্কেলে বেতন চায় তারা নতুন কাজ খুঁজে নিক তাঁদের আপত্তি থাকবে না! ঘটনাটা আশুলিয়ার।
শ্রমিক আন্দোলন বাংলাদেশে বেশ পুরাতন। এই দেশে বরাবরই সবচেয়ে নিগৃহীত রয়ে যায় শ্রমিকরা । দীর্ঘদিন তাঁদের লড়াই করতে হয়েছে একটা শ্রমিকবান্ধব নীতিমালা, মানসম্মত ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও সম্মানজনক বেতন কাঠামোর জন্য। রানা প্লাজায় ধ্বসে গিয়ে আর তাজরিনের আগুনে পুরে পুরে বারবার তাঁরা শ্রমের মূল্য চুকিয়েছে জীবনের দামে । বিদেশী বেনিয়াদের সীমাহীন অর্থলিপ্সার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়েছে শ্রমিকরা ।দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে শ্রমিকরা এবং রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছে একটা নিদৃষ্ট কার্যকরী নীতিমালা প্রনয়নের জন্য তবে যা হয়েছে মোটেও সমাধানের পর্যায়ে নয়! তবুও ভালো যে, একটা নীতিমালা আছে ! একটা বেতন কাঠামো আছে যদিও বাস্তবে জীবনধারণের জন্য এই কাঠামো কতটা বাস্তব সম্মত এই তর্ক আরো কিছুদিন চলবে হয়তো !
শ্রমিকের মজুরির মূল্যে দেশ কি পাচ্ছে কি হারাচ্ছে -
সস্তাশ্রমকে পুঁজি বানিয়ে এদেশে ঝেঁকে বসেছে আধুনিক যুগের নব্য ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘বায়াররা’ ! ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা, অধর্নৈতিক অসমতা ও দুনীতিপরায়ণ নেতৃত্বকে হাত করে তাঁদের ইচ্ছেমত স্বল্পতর বিনিয়োগ করে উন্নততর প্রোডাক্ট হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের দেশে। নিজেদের দেশে নিয়ে যে মূল্যে প্রোডাক্ট সেল হয় এর ১০ ভাগের একভাগ মূল্যও যদি বাংলাদেশ পেতো তবে রেমিটেন্সের হার বর্তমান থেকে কয়েকগুণ হতো এতে কোন সন্দেহ নেই।
বিনিময়ে বাংলাদেশ কি পাচ্ছে ?
- শ্রমিকের স্বল্প বেতন।
- একদল মধ্যসত্ত্বভোগী (বায়ারদের বাইরে অধিকাংশ অর্থ এরাই কুক্ষিগত করছে)।
- ওজন স্থর নীচে নেমে আসছে ।
- ফসলী জমি অনুর্বর হচ্ছে ।
- পানি স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে ।
- প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস ফুরুচ্ছে হুহু করে অথচ এই শক্তি কে কাজে লাগিয়ে দেশের স্থায়ী কোন উন্নয়ন হচ্ছে না ।
- বাতাসে বাড়ছে শীশার মাত্রা ।
- বনাঞ্চল ক্রমশ ছোট হয়ে কার্বনডাইঅক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে ।
- মাত্রাতিরিক্ত ক্যামিকেল ইউজের ফলশ্রুতিতে মরনঘাতি ক্যানসার বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়াবহ মাত্রায়।
- ক্যামিকেল ও ডাস্টের প্রভাবে হার্টের সমস্যা, চর্মরোগ ও পুরুষ/মহিলারা প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে ক্রমশ ।
বাস্তবে যতটা বলা হয় ততটা কি আসলেই হয় ?
আমরা বরাবরই আলোচনা শুনি, রিপোর্ট পড়ি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে টেক্সটাইল খাত থেকে অথচ এই রেমিটেন্স আনার জন্য আমাদের কি পরিমাণ বিনিয়োগ বাহিরে চলে যায় তার হিসাব কোনোদিন প্রকাশ হয় না ! কত টাকা ব্যায় করে কত টাকা আয় করছি এই হিসেবটা যদি কোনো দিন করতে বসতাম তাহলে দেখতে পেতাম শ্রমিকদের পাওয়া স্বল্প বেতন ছাড়া আমাদের দেশ খুব বেশি কিছু পাচ্ছে না । রেমিটেন্সের নামে যা আসে তার অধিকাংশই বিনিয়োগ হয়ে আবার ফিরে যায় বেনিয়াদের হাতেই!!
শ্রমিকদের বাঁচাতে হবে:
শ্রমিকের হাতেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বললে ভুল হবে না। দেশ বাঁচাতে আপনার শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। শ্রমিক আন্দোলন শূণ্যে নামিয়ে আনতে প্রয়োজন অনেকগুলো সমস্যার সমাধান ! বেতন বাড়িয়ে কোনো দিন শ্রমিকের চাহিদা মেটানো যাবে না কেননা বেতন যে হারে বাড়ছে এর দ্বিগুন হারে বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয় ! আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে কথা বললে দেখবেন সকলেরই একই অভিযোগ ; এই বেতন দিয়ে ব্যায়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না !! অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা যখন একজন শ্রমিক পূরণ করতে পারবেন না তখন সে আন্দোলনের পথ বেছে নিবে এটাইতো স্বাভাবিক !! শুধুমাত্র টেক্সটাইল শ্রমিকরা নয় বরং সকলেই একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে ? সবাই `লিভিং-কস্ট' ম্যানেজ করতে গায়ের ঘাম ঝড়াচ্ছে না ? তারমানে সমস্যাটা শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতনে না, অনেকেরই আছে। তাই সমাধানটা মূল জায়গায় করা দরকার।
বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে ঢাকাবাসীদের মূল খরচ তিনটি। প্রথমত: বাড়িভাড়া। যা তার বেতনের প্রায় ৫০-৬০% পর্যন্ত হয় অধিকাংশ সময়।দ্বিতীয়ত, খাবার খরচ, উচ্চদ্রব্যমূল্যের কারণে বাজারে যেতে কেঁপে উঠেন বাড়ির কর্তা আর তৃতীয়ত যাতায়াত ভাড়া, দিনে দিনে তা উর্ধ্বমূখী।পাশপাশি শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে !
সমাধান কোন পথে ?
শ্রমিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেতন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। বেতন বৃদ্ধির সাথে জীবনযাত্রার মানউন্নয়ন ও লিভিং কষ্ট কমিয়ে আনতে হবে আন্দোলনরত গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা শুনে দেখবেন, তারা বলে, “আমরা যে বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। বাড়িভাড়া, খাবার খরচ আগে থেকে বেড়েছে, কিন্তু সে অনুপাতে বেতন বাড়ে নাই।” এখন বেতন বাড়ানোর চেয়ে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিৎ খরচ কমিয়ে আনতে তাহলেই উভয় কূল রক্ষা পাবে।
শ্রমিকদের এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার। ঢাকা কেন্দ্রিক টেক্সটাইলের বিশাল অহেতুক গেদারিং গড়ে তুলে যে প্রচণ্ড প্রেশার সৃষ্টি করা হয়েছে এটাকে এখন নিয়ন্ত্রণ করা প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিৎ নীতি নির্ধারকদের। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় পাঁচ হাজারের অধিক ছোট বড় টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে ! অথচ এই প্রতিষ্ঠাঙ্গুলোকে যদি দেশের ৬৩ টি জেলায় ছড়িয়ে দেয়া যেতো তবে শ্রমিকরা তাঁদের জেলায় বা পাশের জেলার প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেতো ফলে তার লিভিং কমে যেতো অর্ধেক ! অধিকাংশ শ্রমিক নিজেদের বাসস্থানে থেকেই কাজের সুযোগ পেতো ফলে তার বাড়ী ভাড়া বেঁচে যেতো। নিজের গ্রামের বাড়িতে থাকার ফলে তার খাবার খরচ কমে যাবে, কারণ গ্রামে চাষবাস থেকে অনেক খাদ্য আসে। নিজ জেলা শহরে কাছের কোন কারখানায় যেতে বাসে যাতায়াত খরচ কমে যাবে এবং -গ্রামীন অর্থনীতিও অনেক সমৃদ্ধ হবে।
ঢাকাকে রি-সেন্ট্রালাইজড করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি দেশোময় ছড়িয়ে দেয়া তবে সব চেয়ে বেশি লাভবান হবে ঢাকার লোকজন। কেননা, প্রতিষ্ঠান সরে যাওয়ার ফলে ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে প্রায় ১ কোটি লোক চলে যাবে। ফলে সাপ্লাই-ডিমান্ড থিউরী অনুসারে ঢাকা শহরের বাড়িভাড়া হ্রাস পাবে। যানজট সমস্যা কমে যাবে।ঢাকা জেলার পাশাপাশি অন্যসব জেলাগুলোর জীবন যাত্রার মান, অর্থনীতি উন্নত হবে।