আফগানিস্তানের প্রতিটি পাহাড় পর্বত আর বিস্তির্ণ অঞ্চল যেন সাক্ষি হয়ে ছিলো আমেরিকার রকেট আর বুলেট বৃষ্টির। ১৯ বছরের সেই তপ্ত বুলেটে শান্তির পরশ লাগলো আজ। এ যেন তপ্ত ১৯ বসন্তের পর শান্তির বৃষ্টির ছটা।
কাতারের রাজধানী দোহার শেরাটন হোটেলে তালেবানের সাথে এই শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে আমেরিকা। আজ বাংলাদেশ সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে ঐতিহাসিক এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমেরিকার পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন জালমাই খালিলজাদ তালেবানের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মোল্লা আবদুল গণী বেরাদর।
এটি বিশ্ব জিহাদের ঐতিহাসিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। মূলত এই চুক্তি স্বাক্ষর জিহাদের পথে থাকা আফগান তালেবানেরই ঐতিহাসিক বিজয়!
বিশ্লেষকরা বলেন, অবশেষে বিশ্বের সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হার মানলো আফগান তালেবানের কাছে। যেমনভাবে তালেবানের কাছে হার মেনেছিলো রাশিয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আজ কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান ও আমেরিকার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে তালেবানের সাথে ন্যাটো তথা মার্কিন সেনাদের দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধের পর কার্যত আফগান তালেবানের কাছে পরাজয় বরন করলো বিশ্বের সুপার পাওয়ার আমেরিকা।
অপরদিকে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তালেবান ও আফগান নেতাদের বৈঠক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তারা যুদ্ধোত্তর আফগানিস্তানের কাঠামোগত উন্নয়ন এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং প্রশাসনের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রেও তালেবান তাদের নীতিতে অটল থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আফগান সরকারের কাছে তালেবান কোন নতি স্বীকার করবে না তা বিনা বাক্যব্যয়ে বলে দেওয়া যায়।
আজ থেকে প্রায় ১৯ বছর আগে আমেরিকান সার্ভিস সদস্যরা আমেরিকার টুইন টাওয়ারে ১/১১-এর হামলার জন্য আল কায়েদা এবং তালেবানকে দায়ী করে তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে আফগানিস্তানে হামলা করেছিলো। কিন্তু গত দুই দশক ধরে মার্কিনীদের কঠোর প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে তালেবান সদস্যরা। যে কারণেই আফগানিস্তানে মার্কিন সেনারা বারবার নাকানি-চুবানী খেয়েছে তালেবানের কাছে। এবং তাঁর ধারাবাহিকতায় গত দুই বছর ধরে পরিচালিত হওয়া শান্তি আলোচনার কার্যত একটি সমাধানে পৌছে গেলো আমেরিকা-তালেবান।
স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে আমেরিকার সেনারা বিনা শর্তে আমেরিকা ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন এবং আফগানিস্তানের ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা তালেবানের থাকবে বলে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে লেখা রয়েছে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণী, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও, কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মাদ বিন আবদুর রহমান আল সানিসহ প্রমুখ বিশ্ব নেতারা।
পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের বিভিন্ন নেতারাও চুক্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলো বিশ্বের প্রভাবশালী প্রায় ১৫০ সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তালেবানের সাথে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিতে কাতারের ভূমিকা অত্যন্ত মূলবান। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সত্যিকার শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তির শর্তগুলো মানার পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাতার মধ্যস্থতা ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে।
এই চুক্তি বিষয়ে গত শুক্রবার গভীর রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি বিবৃতিতে আফগানদের শান্তির সুযোগ এবং তাদের দেশের জন্য "একটি নতুন ভবিষ্যত" তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে এই সুযোগকে কাজে লাগানোর আহবান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার টুইটে বলেছিলেন, "আমি যখন ক্ষমতায় এসেছি, আমি আমেরিকান জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমি আমাদের সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে শুরু করব এবং এই যুদ্ধ শেষ করার চেষ্টা করব। আমরা এই প্রতিশ্রুতিতে যথেষ্ট কার্যকর করছি," ট্রাম্প বলেছিলেন।
ওয়াশিংটন কর্তৃক ঘোষিত "সহিংসতা হ্রাস" (আরআইভি) চুক্তির এক সপ্তাহ পরে এই চুক্তি এসেছে।
আফগানিস্তানের সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা বশির সাফি আল জাজিরাকে বলেছেন, "রাষ্ট্রপতি গাণি একটি অন্তর্ভুক্ত প্রশাসনের চাপে থাকলেও তিনি আরও একটি এনইউজি ফর্ম্যাটের জন্য প্রস্তুত নন। গানি বিভক্ত নেতৃত্ব চান না।
এই চুক্তিতে কী তালেবানরা কি জিতেছে?
তালেবানরা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিল, এবং আফগানিস্তানে থাকা বিদেশী সেনাদের একটি "দখলদার" শক্তি বলে অভিহিত করেছে এবং প্রায় দুই দশকের যুদ্ধের জন্য তাদেরকেই দোষারোপ করেছে।
দোহায় মার্কিন কর্মকর্তা এবং তালেবান প্রতিনিধিদের মধ্যে ২০৮ সাল থেকে চলমান এই দীর্ঘ আলোচনায়, আমেরিকা তালেবানদের কাছ থেকে গ্যারান্টি চেয়েছিল যে বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের পরিবর্তে আফগান মাটি ব্যবহার করে মার্কিনীদের কোন ক্ষতি কেউ করতে পারবে না এই গ্যারান্টি দিতে হবে।
তবে তালেবান সদস্যরা এই চুক্তিকে একটি বিজয় বলে মনে করছেন তবে বিশ্লেষকরা বলেছেন আফগান সরকারসহ সব পক্ষই এখানে আপস করতে হয়েছে তালেবানের কাছে।
রাষ্ট্রপতি গনির প্রাক্তন উপ-উপদেষ্টা এবং আফগানিস্তানে ন্যাটো-র সিনিয়র উপদেষ্টা মোহাম্মদ শফিক হামদাম দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে সব পক্ষের সমঝোতার গুরুত্বকে পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন।
আল জাজিরা অবলম্বনে, হাছিব আর রহমান।