তাসমিয়া ইসলাম
আমি সবে ক্লাস সিক্সে পড়ি। নতুন স্কুল, নতুন বই আর নতুন বন্ধু বান্ধব। মনের ভেতরে এক অন্য রকম ভালো লাগা। সকাল হলেই সেজেগুজে স্কুলে যাই। স্কুলে না জেতে চাইলে বা কোনোকিছু নিয়ে আরম্বর করলে মায়ের বকা। কি যে ভালো লাগতো বলে বুঝাতে পারবো না।
রীতিমতো স্কুলে যাচ্ছি, আসছি। স্কুলে গিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে বিভিন্ন খেলায় মেতে উঠছি বিরতির সময়। দ্রুত টিপিন খেয়ে আড্ডা দিচ্ছি কখনও। এভাবে তিন মাস চলে গেল।
একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে কাছে ডাকলেন। দশ টাকার একটি কচকচে নোট হাতে দিয়ে বললেন, বেলা বড়, টিফিনে কিছু খেয়ে নিস মা। সেই দিনটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। বন্ধবীদের সঙ্গে হই-হুল্লোড় করতে করতে স্কুলে গেলাম। প্রতিদিনের মত ক্লাস করছি। হঠাৎ কেন জানি বাড়ির কথা খুব মনে পড়ল। কিছুতেই ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। খুব খারাপ লাগছিল। আনমনে বসে আছি। কখন ছুটি হবে আর আমি বাড়ি যাবো। নাকি ছুটি নিয়েই বাড়ি চলে আসবো -ভাবছি।
বেলা ১১ টা বাজে। আমার স্পষ্ট মনে আছে। ক্লাস শেষ হলে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি আমার পাশের বাড়ির এক বড় ভাই সাইকেল চালিয়ে আসছে। আমি ভাবছি, হয়তো অন্য কোনও কাজে এসেছে। আমার ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। লোকটি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, বাড়ি চলো। আমি অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলাম -কেনো? স্কুল তো ছুটি হয়নি।
আমার বারংবার প্রশ্নে ছেলেটি বলতে বাধ্য হল। তার উত্তর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম আজীবনের জন্য। আজও স্তব্ধ হয়ে আছি। আমার মাথার ওপর থেকে মেঘ সরে গেলো আর সূর্য তার সবটুকু তীব্রতা বর্ষণ করল।
ভাইটি কথা মুখের ভেতর রেখে বলল, তোমার বাবা মারা গেছে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। সুস্থ মানুষটি -আমার বাবা স্কুলে আসার সময় আমাকে দশ টাকার কচকচে একটা দিলে টিফিন খেতে? আমার তো এখনও টিফিনের সময়ও হয়নি। বুকের ভেতর বসে কেউ যেন হৃদয়ে ধারালো ছুড়ি দিয়ে অনবরত আঘাত করছে। আমি বরাবরই খুব কাঁদতে পারি। কিছু হলেই চোখে পানি টলমল করে। আমি হু হু করে কাঁদতে লাগলাম।
সার-ম্যাডাম সবাই মিলে আমায় বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। পায়ে শক্তি পাচ্ছিলাম না। খুব কষ্ট করে বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারলাম। বাবা আমার ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছেন। শিওরে বসে আছেন, মা বোন। বড় ভাইয়া এখনো আসেননি।
আমি তাকিয়ে আছি বাবার দিকে। আমাকে দেখে বাবা আজ আর দেখে মিষ্টি করে হাসেন না। মা বলে কাছে ডাকেন না। কি কি পড়লাম তাও জানতে চান না। নিশ্চুপ শুয়ে আছেন তিনি। বাবার নিথর দেহ দেখে কষ্টে আমার বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল।
বাড়িতে সবাই আসলো। গ্রামের লোকেরা জড়ো হল। বাবাকে গোসল করিয়ে খাটলায় করে উঠোনে রাখা হয়ে হলো। ছোট্ট আমি তো তখন আর অতো কিছু বুঝি না। আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি খেলতে শুরু করলাম। আমাদের উঠোনের এক পাশে ছোট্ট একটি মুরগীর ঘর। ওই ঘরের ওপর বাবার পরুয়া পাঞ্জাবী লুঙ্গি গেঞ্জি পড়ে আছে।
ছোট্ট আমি একটু পর পর খেলার ফাকে বাবার পড়ে থাকা জামাগুলোকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই। বাবার গায়ের গন্ধ নিই। আমার এই দৃশ্য দেখে আমার ফুপি, চাচা, সবাই খুব কান্না করল। আমি আজও কিছু ভুলিনি। ভুলতে পারবো না কোনোদিন। আজও খুব মনে পড়ে বাবাকে।
লেখিকা: কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী
আইএ