মাসখানেক আগে বিখ্যাত মার্কেট রিসার্চ ও ডাটা এনালাইজিং কর্পোরেশন আইডিসি’র বেশ কিছু পুরোনো ফাইল ঘাটছিলাম।
ব্যাপক তথ্যবহুল ডকুমেন্টগুলোর মধ্যে এই দুটি ইনফরমেশনও ছিলো –
আমেরিকায় হওয়া ঋণ বিষয়ক একটি গবেষণায় দেখা যায় ১৮-৩৪ বছর বয়সী আমেরিকানদের মধ্যে ৪০% মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভালো লাইফস্টাইল’ দেখাতে গিয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন।
অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখলাম, আমেরিকার ৭৯% স্মার্টফোন ব্যবহারকারীই ঘুম থেকে উঠেই ১৫ মিনিটের মধ্যে অন্তত একবার কোনো না কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ঢু’ মারেন!
এখন কথা হলো, পোস্টের শিরোনামের সাথে এসব তথ্যের সম্পর্ক কি? হ্যা আছে, এক বিশেষ কৌশল এর ফাঁদে পড়েই মানুষ আজ নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। হয়ে ওঠছে ঋণগ্রস্ত, হচ্ছে নেশায় আসক্ত!
কি এই স্ট্র্যাটেজি! যার প্রভাবে এত ভয়াবহ। হ্যাঁ, সাইকোলজি ও মার্কেটিং-এ বহুল প্রচলিত অভিনব এ কৌশলের নাম ‘FOMO’– Fear Of Missing Out বা ‘আফসোসের ভয়’। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টা আপনার নিকট পরিষ্কার হবে।
ইউনিভার্সিটি এডমিশন টেস্ট এর প্রাক্কালে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে বড় করে লেখা থাকে – ‘আসন সীমিত’, এই দেখে অভিভাবকদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়, কখন না জানি আসন ফিলআপ হয়ে যায়! আজই যদি ভর্তি না হই তাহলে বোধয় ঐ নামকরা কোচিংটায় হয়ত আমার সন্তানকে ভর্তি করাতে পারবো না আর পাবলিকেও হয়ত চান্স হবে না।
আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক, UC Browser এর নাম বললেই প্রথমেই অনেকের মনে পড়ে এর উত্তাপ ছড়ানো নিউজ নোটিফিকেশন গুলোর ‘অমুককে একা পেয়ে এ কি করলেন তমুক’।
এমন নিউজ চোখে পড়লে সবার মধ্যেই কম বেশি কৌতুহল জাগ্রত হয় আর অবচেতন মন নিউজে ক্লিক করে পুরো কাহিনী জানতে চায়। আর, না পড়লে মনের মধ্যে সারাদিন একটা আফসোস কাজ করে, রাতে ঘুম হয় না! যদিও অমুক যদি তমুক এর সানডে মানডে কোলোজও করে দেয় তাতে আপনার কিছু যায় আসে না- এসব না ভেবে আপনি যে আফসোস করতে থাকেন এ অনুভুতির নামই FOMO (ফোমো)।
মার্কেটিং এর ভাষায়, – ‘FOMO’ হলো কোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিসকে গুরুতর প্রয়োজনীয় হিসেবে দেখানোর কৌশল। এই ফোমো স্ট্র্যাটেজিকে পুঁজি করে হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিজনেস।
For Your Kind Consideration, এই যে আপনি ফেসবুক চালাচ্ছেন এটাও কিন্তু ফোমো সম্পর্কিত। মানুষ কৌতুহলী, আর এই কৌতুহলটাকেই পুঁজি করে চলছে ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
ফেসবুকে আপনি যতই স্ক্রোল করবেন– ততই নতুন নতুন কনটেন্ট আপনার সামনে আসবে। ছবি, স্ট্যাটাস, ভিডিও – আরও কত কি! – আর এই নতুন কনটেন্টের সম্ভাবনাই ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের ফেসবুকে বসিয়ে রাখে। বের হতে মন চায় না, কারণ অবচেতন মন ভাবে, ‘বের হলেই হয়তো নতুন কিছু মিস করে ফেলবো’
আবার ম্যাসেঞ্জারেও সেম বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়, প্রিয় মানুষটার অপেক্ষায় এখানে এসে আপনি দেখলেন সে অনলাইনে নেই তবু আপনি এই ভেবে এখনো এখানে পড়ে আছেন এই ভেবে যে, ‘এখনি হয়ত সে অনলাইনে আসবে’।
প্রেমের ইস্যু যখন সামনে এসেছেই, তাই বলছি - প্রেম, ড্রাগ, সেলিব্রিটি সবই চলে এই ফোমো মার্কেটিং এর ওপর। কথায় আছে , ‘নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারে স্বর্গ সুখ আমার বিশ্বাস’- এই প্রবাদটার ন্যায় একজন সিঙ্গেল ভাবে ‘আজ যদি একটা GF/BF থাকতো তাহলে আমার এই অসুস্থতায় নিশ্চয়ই সে খোজখবর নিতো’।
আবার একজন সিনেমার হিরো নতুন মুভি মুক্তির সময় সর্বদা মিডিয়ার সামনে বলে থাকে, ‘আমি এর আগে এমন গল্পের মুভিতে কখনো কাজ করিনি/এই গল্পটা অনেক ইউনিক/অনেক টুইস্ট আছে/দর্শকেরা না আসলে মিস করবেন etc...’ {এসব বলার কারণটা আলাদাভাবে বলতে হবে? }
দক্ষিণ এশিয়ার ইউটিউবাররা এ কৌশলটিকে ভয়াবহ আকারে নিয়ে গেছে, তাদের কনটেন্ট এ Thumbnail এ এমন সব Picture ব্যবহার করে যে উৎসুক জনতা ক্লিক না করে থাকতে পারে না। আবার ভিডিও শুরু হতে না হতেই বলে ‘ভিডিওটির শেষ পর্যন্ত দেখুন, নয়ত কিছুই বুঝবেন না’।
লটারির টিকিটের বিষয়টাকে এখানে না আনলেই নয়, বিভিন্ন লোভনীয় অফার সমৃদ্ধ লটারির একটি প্রাইজের বিপরীতে প্রায় লাখ লাখ টিকিট বিক্রয় হয়। Probability অনুযায়ী ভাগ্যবান বিজেতা হবার সুযোগ লাখে মাত্র একবার, তা জেনেও মানুষ রাতারাতি ধনী হবার জন্য এসব কেনে। কারণ সে মনে করে ভাগ্যে হয়ত এবারই সুযোগটা আছে। টিকিটটা না কিনলে মিস হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দৈনন্দিন জীবনটাকে ফোমো যেকোনো দিন বিভীষিকায় রুপান্তরিত করতে পারে। কখনো ভেবে দেখেছি কি..? ফোমোর প্রভাবে দৈনিক কি পরিমাণ সময় আমরা Social Media’র পেছনে নষ্ট করছি?
হাজারো চটকদার পোস্টার বা বিজ্ঞাপনে আমরা খুব সহজেই ডুবে যাই, আর আমরা উপমহাদেশের মানুষগুলো খুব সহজ সরল, তাই যে কেউ খুব সহজেই বোকা বনে যাই। এ কারণেই আমরা ঘনঘন ‘সেলিব্রিটি ডিনার, সীমিত সময়ের জন্য হাজার টাকা ছাড়, ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা, টিভি ফ্রি, এসি ফ্রি, অফার শুধু আজকের জন্যই!’ ইত্যাদির.. অফার পাই।
এসব ফাঁদ পদে পদে আসবে, এসবে পা না দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। খুব আহামরি প্রয়োজন না পড়লে FOMO’র বিপরীতে আমি যে নীতি অনুসরণ করি, তা হলো ‘না’ স্ট্র্যাটেজি।
এই মূহুর্তে ওয়ারেন বাফেট এর একটি উক্তি মনে পড়ছে, তিনি বলেছিলেন – ‘সাধারণ আর অসাধারণ সফলদের মধ্যে পার্থক্য হলো, অসাধারণ সফলদের ‘না’ বলার ক্ষমতা অসাধারণ’।
ফয়সাল আরেফিন
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
/এসএস