
বিশ্বের মুসলমানদের জীবনযাত্রার মান-উন্নয়নে সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে ৫৬ টি মুসলিম দেশের ৪৫০ জন প্রতিনিধিদের অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী কেএল সামিট সম্মেলন ২০১৯ এর আজ প্রথম দিন শেষ হলো।
৫৬টি মুসলিম দেশের ৪৫০ জন প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া কেএল সামিটে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শীর্ষ সম্মেলনের চেয়ারম্যান এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, মালয়েশিয়ার রাজা আল-সুলতান আবদুল্লাহ তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এবং কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি।
তবে সৌদি আরব এই সম্মেলন বয়কট করেছে। জেদ্দায় ভিত্তিক ৫৫ সদস্যের ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি’র ব্যানারের বাইরে এ সম্মেলন হওয়ায় সৌদি আরব এ সম্মেলন বয়কট করছে বলে জানা গেছে। গতকার বুধবার ওআইসি এক বিবৃতিতে বলেছে, এ জাতীয় বৈঠকগুলি কেবল ব্লককে দুর্বল করে না, এটি ইসলামকেও দুর্বল করে দেয়।
এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এর এ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল কিন্ত রিয়াদের চাপের মুখে পাক প্রধানমন্ত্রী কুয়ালালামপুর সামিট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ভয়েস অব আামেরিকা এ খবর দিয়েছে।
মালয়েশিয়ার রাজা আল-সুলতান আবদুল্লাহ বলেন, আমার কাছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এবং আমাদের সম্প্রদায়ের উন্নতি-এই দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে ঐক্য অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে আমাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা প্রসারিত করার।
ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, সম্মেলনের উদ্দেশ্য ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা। একদিকে আমরা দেখছি মুসলিম দেশ ধ্বংস হচ্ছে, নাগরিকরা তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে, অমুসলিম দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে, আমরা দেখছি, মুসলমানরা সহিংস কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিরীহ পুরুষ, মহিলা, শিশু, অসুস্থ এবং অক্ষমদের হত্যা করছে। এসব থেকে উত্তরণে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে আমরা খুঁজে পেতে পারি যে, আমাদের কী কী ভুল হয়েছে।
[caption id="attachment_61073" align="alignnone" width="570"]
কুয়ালালামপুর সামিটে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ[/caption]
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, আমরা আলোচনা করে সমাধান পেতে পারি। যদি কমপক্ষে ইসলামি বিশ্বকে জাগ্রত করার জন্য এই বিপর্যয়গুলোর অবসান না-ও করা হয়, অন্তত উম্মাহর সমস্যা এবং তার কারণগুলো স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মাহাথির আরো বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিল (ইউএনএসসি) পুরোনো এবং মুসলিম দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করছে না বলে মন্তব্য করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান। তিনি বলেন, বর্তমান ব্যবস্থা কেবলমাত্র ভেটো শক্তিধারী পাঁচটি দেশ-চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত স্থায়ী সদস্যদের পক্ষে রয়েছে।
মাহাথিরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, মুসলিম উম্মাহর শান্তি-সমৃদ্ধিতে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
[caption id="attachment_61074" align="alignnone" width="570"]
কুয়ালালামপুর সামিটে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান[/caption]
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তায়েব এরদোগান বলেন, বিশ্বব্যাপী সমস্যার এমন একটি সমাধান খুঁজে পাওয়া উচিত, যা স্বার্থভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে মানুষ এবং বিবেককে কেন্দ্র করে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা যে সকল প্ল্যাটফর্মে অংশ নিয়েছি বা দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, সেখানে আমরা মানবতা ও মুসলমানদের দ্বারা উত্থাপিত সমস্যাগুলো উপস্থাপন করেছি। আমরা ঘোষণা করছি যে, ন্যায়বিচার ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যবস্থার একটি নতুন কাঠামো প্রয়োজন।
এরদোগান বলেন, আমরা যদি এখনো ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো কিছু করতে না পারি, আমরা যদি এখনো আমাদের সম্পদ শোষণ করা বন্ধ করতে না পারি, যদি এখনো আমরা বলতে না পারি যে, মুসলিম বিশ্বে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বন্ধ করো- তাহলে এটা চলতেই থাকবে।
মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সংকট ও দুর্দশায় এ পর্যন্ত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পূনর্গঠনের আহ্বান জানিয়ে এরদোগান বলেন, এ সংস্থার স্থায়ী এ পাঁচটি দেশ বিশ্বের ১৭০ কোটি মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এসব দেশের চেয়ে বিশ্ব অনেক বড়।
[caption id="attachment_61075" align="alignnone" width="570"]
কুয়ালালামপুর সামিটে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি[/caption]
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, মুসলিম বিশ্বকে অবশ্যই মার্কিন অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পথ বের করতে হবে। এজন্য মুসলিম দেশগুলোর আন্তঃব্যাংকিং সম্পর্ক বাড়াতে হবে এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের বিকল্প খুঁজতে হবে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানিয়ে বলেন, এগুলোর মাধ্যমেই মার্কিন সরকার তাদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তার করছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করেই আমেরিকা অন্যের ওপর তাদের অবৈধ দাবি চাপিয়ে দিচ্ছে। মার্কিন ডলার এবং আমেরিকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এই আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুসলিম বিশ্বকে অবশ্যই উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, উত্তর আফ্রিকা থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলো মারাত্মক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। তারা ইহুদিবাদী ইসরাইল ও আমেরিকার সৃষ্ট উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের শিকার। তিনি বলেন- সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক লেবানন, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ হয়েছে তা অভ্যন্তরীণ চরমপন্থা এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের মিশ্রিত ফল। তিনি বলেন, মুসলিম উম্মাহর সামনে যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে তা যদি ঠিকমতো কাজে লাগানো যায় তাহলে মুসলিম বিশ্বের উন্নতি অবশ্যই আসবে।
[caption id="attachment_61078" align="alignnone" width="570"]
কুয়ালালামপুর সামিট[/caption]
চার দিনব্যাপী কুয়ালালামপুর সামিটে মুসলিম দেশগুলোকে রাজনীতি, অর্থনীতি, সুশাসন, উদ্যোক্তা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং শিক্ষার আওতায় আনতে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলোকে রাজনীতি, অর্থনীতি, সুশাসন, উদ্যোক্তা, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং শিক্ষার আওতায় আনতে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলোচনার কথা জানান সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশী আলেম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র সহকারী মহাসচিব, ইউকে জমিয়তের সভাপতি ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারস্-এর সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা শোয়াইব আহমদ।
তিনি আরো জানান, আজ সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৬ টা পর্যন্ত সম্মেলন চলে। উম্মাহ'র সংকট নিরসন, সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উপায় এবং সম্ভাবনার পথ নির্ধারনে এ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে বলে মনে করেন মাওলানা শোয়াইব আহমেদ।
/এসএস