আব্দুল্লাহ আল মুবিন: শীতের সকাল। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সবুজ প্রকৃতি। মুসল্লিরা ফজরের নামাজ পড়ে চাদর জড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরছেন। সূর্য মামার রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। চিক চিক করে রোদেলা সকাল পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে।
ঠিক তখনই ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে মসজিদের মক্তবের ছাত্র-ছাত্রীরা, তোমাদের মক্তব শুরু হচ্ছে, তোমরা মক্তবে চলে এসো! আমরা চোখ মুখে পানি দিয়ে টুপি পাঞ্জাবী পরে দল বেঁধে ছুটছি মসজিদের দিকে।
হাঁটছি গ্রামের আকাবাঁকা গলিপথে। ঠান্ডা আমাদের কাবু করতে পারে না। পৌঁছে গেছি মক্তবে। এবার পড়ার সূচনা হবে। বোর্ডে চক দিয়ে আরবি হরফ লিখছেন হুজুর। লিখেই বলছেন করে আলিফ, বা, তা, ছা। আমরা হুজুরের সাথে সমস্বরে উচ্চারণ করছি।
এভাবে ধারাবাহিক প্রতিটি হরফ হুজুর আমাদের হৃদয়ে গেথে দিতেন। ধাপে ধাপে ইসলামের মৌলিক ক্রিয়াকলাপ গুলোও হাতেকলমে আয়ত্ব করাতেন। ৯টায় মক্তব শেষে প্রভাতের নির্মল সমীরণে গা দুলিয়ে ছেলেমেয়েদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে বাড়ি ফিরতাম।
চির চেনা সকাল বেলার সেই মক্তব শিক্ষার কথা এখনও মনে পড়ে। স্মৃতির পাতায় এখনও অপকটে দাগকাটে সেই সকাল বেলার মধুর সূরে আওয়াজ করে কোরআন তেলাওয়াত করার ইতিহাস। এখনো হঠাত মাঝে মাঝে হাড়িয়ে যাই স্মৃতির বর্ণিল অরণ্যে, ফেলে আসা জীবনের সারল্যপূর্ণ নৈপুণ্যে। অসংখ্য মকতবে পাখির মতো নিষ্পাপ শিশুদের কুজন-কলরবে মুখরিত হতো সবুজ শ্যামল বাংলার প্রতিটি রোদরাঙা শিশির ভেজা সকাল।
প্রতিটি পাড়া মহল্লায় থাকা কোরআন শিক্ষার মক্তব থেকে সকাল সন্ধ্যায় ভেসে আসতো আলিফ, বা, তা, সা আর কোরআন পাঠের মিষ্টি মধুর সুর। কচি কচি বাচ্চার মুখ থেকে পবিত্র কোরআন পাঠের সেই মিষ্টি মধুর সুরে মুখরিত থাকতো মক্তবগুলো। প্রভাতের আলো ফোটার সাথে সাথে মিনার থেকে ভেসে আসা সেই মধুর সূর এখনো স্মৃতির পাতায় অপকটে দাগকাটে।
শুধু ইসলামপুর নয়, শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার ভোরে মসজিদের মাইকে এমন ঘোষণা আমি শুনেছি বাংলার নানা প্রান্তে। আমাদের পূর্বপুরুষরাও মক্তবেই পড়েছেন। যখন এসব অঞ্চলের মানুষ শিক্ষার খবর জানত না, তখনও মক্তব ছিল। মসজিদের দরিদ্র মুয়াজ্জিন কিংবা বৃদ্ধ ইমাম কখনও কমিটির উদ্যোগে, আবার কখনও নিজের আগ্রহে মক্তব শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলার নিরক্ষরতার হার হ্রাস করে আসছেন।
বঙ্গের ভাগ্যে যখন দারিদ্র্যের অভিশাপ চিরন্তন। মানুষ দুই মুঠো খাবার জোগানোর সন্ধানে মরিয়া। বিস্তার লাভ করেছে শিশুশ্রম, তখন বাংলার ঐতিহ্যের অবৈতনিক মক্তব শিশুদের শিক্ষার আলো দিয়েছে। সমাজের বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে শিক্ষা ও সভ্যতাবিষয়ক নিঃস্বার্থ কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনটির নাম মক্তব।
নানা কারণে আজ মসজিদ ভিত্তিক মক্তবের কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে। আগের মত এখন আর কঁচিকাঁচা শিশুদের কোরআন শিক্ষার জন্য মক্তবে যেতে দেখা যায় না। কালিমা আর আলিফ, বা, তার শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেনা জনপদ। শুনা যায় না সেই সুমধুর কন্ঠ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে কোরআন শিক্ষার মক্তব। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক অভিভাবক প্রতীযোগিতা করে আরবী শিক্ষাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। অভিভাবকদের এই অবহেলার কারণে মসজিদের ইমাম সাহেবরা এখন মক্তবে কোরআন পড়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
ইদানীং স্কুলগুলোতে মর্নিং শিফট চালু হওয়ায় অনেকেই মক্তবের এই ন্যূনতম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটি তাদের দ্বীন শেখার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর প্রভাবে তৈরি হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞানশূন্য একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। আর স্কুলে যে পদ্ধতিতে এবং যে সিলেবাসে তা পড়ানো হয়, এতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয় না। এ জন্য পরিবর্তিত জীবনব্যবস্থা, সমাজ, সমাজের নেতৃত্ব, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সবাই কমবেশি দায়ী।
লেখক: দাওরা হাদিসের শিক্ষার্থী , ফরিদাবাদ মাদরাসা
আই.এ/