উবায়দুর রহমান খান নদভী
লেখক-সম্পাদক, গবেষক আলেম ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ
পাবলিক ভয়েস : আপনি যদি কোরআন-সুন্নাহ ও সীরাত মুতালাআ করেন, তা হলে পলিটিক্স খুঁজে পাবেন না। যার অর্থ রাজনীতি। আপনি পাবেন কালেমার দাওয়াত, কিতাবুল্লাহর তিলাওয়াত, তালীম, তাযকিয়া, তরবিয়ত ও জিহাদ। এসব কি রাজনীতি নয়? নাগরিক তৈরি, পরিবার ও সমাজ গঠন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আমিরকে মানা, সংগঠিত থাকা, এ সবই তো সফল রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। মানুষের চিন্তা-চেতনা, ইবাদত-বন্দেগী, আর্থ-সামাজিক লেনদেন ও পারস্পরিক মানবিক নৈতিক সম্পর্ক এবং আত্মশুদ্ধিসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কার ইত্যাদি সবই ওপরে বর্ণিত কর্মসূচির মধ্যে শতভাগ নিহিত আছে।
নগর-সভ্যতা বা নাগরিক রাষ্ট্র যখন বৃহৎ ভূগোল নিয়ে বিশ্বময় একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে, ইসলামে তখনও এটিকে দুনিয়াদারী বলে গণ্য করা হয় না। যদিও দুনিয়াদাররা তাদের পরিভাষায় একে পরাশক্তি, সাম্রাজ্য কিংবা বৃহৎ বাদশাহী আখ্যায়িত করে। যুগে যুগে যেসব মামলাকাত, সালতানাত, হুকুমাত ইত্যাদি নাম গ্রহণ করে একধরনের রাজকীয় ধারণা নির্মাণ করেছে। কিন্তু আসলে ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ’ নামের বৈশ্বিক রাষ্ট্রব্যবস্থাটি মসজিদে নববীর সামগ্রিক কর্মসূচিরই একটি ফলিত বাস্তবায়ন মাত্র।
শরীয়তে যাকে ইমামতে সুগরা ও ইমমাতে কুবরা বলা হয়। এ খিলাফত-পদ্ধতির রাজনীতি যখন একটি জনপদের সবচেয়ে বড় বুযুর্গ ও আহলে ইলমগণ ইমারতের আওতায় জামাতবদ্ধ হয়ে সুচিন্তিতভাবে পরিচালনা করেন, সাথে শক্তি ও অর্থনীতি যোগ হয়, নানা শ্রেণি ও পেশার সমমনা বিশেষজ্ঞরা এতে সন্নিহিত হন তখন ইমাম বা আমীর একটি মুসলিম জনপদকে দীনের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখার ওপর চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করার নামই খিলাফত।
পশ্চিমা ধারণার ফলে, দীর্ঘদিন খেলাফত না থাকার ফলে, জনগণ পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে, অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ও অল্প শিক্ষিত আলেমগণ প্রচলিত রাজনীতিতে আসার ফলে মুসলিম সমাজেও দীন, সিয়াসত ও ইমারতের ধারণা ধূলিধূসরিত হয়ে যায়।
দীর্ঘ ১৩ শ বছর মোটামুটি একটি কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলায় মুসলিমবিশ্ব পরিচালিত হয়। কখনও নিষ্কলুষ খিলাফত (খিলাফতে রাশেদা) কখনও কোনো শাসকবংশ, কখনও কোনো নতুন শাসকগোষ্ঠী কেন্দ্রীয়ভাবে মুসলমানদের পরিচালনা করে। কেন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়লে আঞ্চলিকভাবে কেন্দ্রকে স্বীকার করেও অনেক সৎ ও যোগ্য শাসক খেলাফতে রাশেদার আলোকে বিশাল বিশাল রাজ্য পরিচালনা করেন। কোরআন-সুন্নাহর মূলনীতির ওপর এসব আমীর বা শাসক ব্যক্তিগত রুচি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে বর্ণিল চরিত্রের থাকলেও তাদের বিচার ও প্রশাসন ছিল শতভাগ ফিকাহ ও ফতোয়ার আলোকে পরিচালিত। শত শত আঞ্চলিক শাসকের নাম মুসলমানের ইতিহাসে এমন পাওয়া যাবে, যাদের প্রত্যেকেরই শাসনব্যবস্থা আধুনিক পশ্চিমা রাষ্ট্রব্যবস্থার সবগুলো থেকে হাজার গুণ সফল ও উত্তম।
ন্যায়বিচার, সুশাসন ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে এসব শাসক আরও হাজার বছর বিশ্ববাসীর নমস্ব ও পাঠ্য।
এ ধারাবাহিকতা ধ্বংস করে পশ্চিমা কিছু নাস্তিক্যবাদী ধারণা। যেমন, আব্রাহাম লিঙ্কনের মার্কিন গণতন্ত্র, ইউরোপের ওয়েস্ট মিনিস্টার পদ্ধতি, কার্লমার্ক্সের সমাজতন্ত্র ইত্যাদি। বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে ব্রিটিশরা মুসলিম শাসনব্যবস্থা শুধু ভেঙে চুরমার করেনি; বরং শত বছরের কৌশল ও কূটনীতির মাধ্যমে এ অঞ্চলের উলামায়ে কেরামের মন থেকে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজসেবার রূপরেখাটি পর্যন্ত মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর কঠিন ও অচিন্তনীয় নির্মম নৃশংস নির্যাতনের মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম ও ইসলামপন্থী বিপ্লবীদের ধ্বংস করে দেয়। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ৫০ হাজার আলেমকে হত্যা করে। যার মধ্যে ১৪ হাজার আলেম, হাফেয, পীর ও মুজাহিদকে গাছে ফাঁসি দিয়ে মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখে।
পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন আগামীকাল এই সময় পর্যন্ত