
একটি বইয়ে জনৈক লেখকের দারুণ একটি উক্তি পড়েছিলাম—
‘মানুষের জীবনে এমন দু’টি ব্যাপার রয়েছে, যার সঠিক মুহূর্ত কেউ বলতে পারে না। একটি হলো ব্যক্তি জীবনের সাথে, আর তা হলো নিদ্রা এবং দ্বিতীয়টির সম্পর্ক জাতীয় জীবনের সাথে, আর তা হলো তার অধঃপতন। আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি, অমুক ব্যক্তিটি ঠিক কখন নিদ্রাচ্ছন্ন হলো বা ঘুমিয়ে পড়ল এবং অমুক জাতির পতন ঠিক কোন দিন বা কোন তারিখ থেকে শুরু হলো। মানুষ কেবল তখনই তা জানতে পারে, যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা জাতি অসাড় হয়ে পড়ে’।
অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই এটি সত্য ও বাস্তব। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর জীবনে পতনের সূচনা অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর জীবনের তুলনায় অনেক বেশী সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান। আসল কথা হলো, ইসলামের নেতৃত্বের বিষয়টি বড়ই নাযুক ও স্পর্শকাতর। যে ব্যক্তি বা দল এ আসনে বা পদে অধিষ্ঠিত হন, তার জন্য ব্যক্তিগত উপদেশ-পরামর্শ, তাক্ওয়া ও ন্যায়পরায়ণতা ছাড়াও জিহাদ ও ইজতিহাদের যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। এ শব্দ দু’টি খুবই সরল ও হালকা ধরণের হলেও এর অর্থ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
জিহাদ বলতে বোঝায়: প্রিয়তম ও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য বা কাম্য বস্তু হাসিলের উদ্দেশ্যে নিজের চূড়ান্ত শক্তি-সামর্থ্য ও উপায়-উপকরণ ব্যয় করা। একজন মুসলমানের সব চেয়ে বড় মাকসূদ বা লক্ষ্য হলো- আল্লাহর ফরমাঁবরদারী ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভ এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব ও বিধি-বিধানের সামনে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। এজন্য প্রয়োজন এমন প্রতিটি আক্বীদা-বিশ্বাস, প্রশিক্ষণ, নৈতিক চরিত্র, ইচ্ছা-অভিসন্ধি ও কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ জিহাদের, যা এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
জিহাদ ভেতর বাইরের ঐ সমস্ত উপাস্য ও মিথ্যা মা’বুদগুলোর বিরুদ্ধে, যা আল্লাহর আনুগত্য ও ইসলামের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দেখা দেয়। এসব লক্ষ্য যখন অর্জিত হবে তখন একজন মুসলমানের জন্য জরুরী হলো, সে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর বিধানসমূহকে চারপাশের পৃথিবী এবং সব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা-তদবীর ও প্রয়াস চালাবে। এটি তার ধর্মীয় দায়িত্ব ও আল্লাহর সৃষ্টিকূলের কল্যাণ কামনার স্বাভাবিক চাহিদা।
কিন্তু দুর্ভাগ্য দুনিয়াবাসীর, খোলাফায়ে রাশেদীনের পর পৃথিবীর নেতৃত্বের মর্যাদামন্ডিত আসনে এমন সব লোক জেঁকে বসে, যারা এর যোগ্যও নয় এবং প্রকৃত প্রস্তুতিও গ্রহণ করেনি। খোলাফায়ে রাশেদীনের ন্যায় ও স্বয়ং আপন যুগের অনেক মুসলমানের মতো তারা উচ্চতর ধর্মীয় ও নৈতিক প্রশিক্ষণ লাভ করেনি। তাদের ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চরিত্রের মান এতটা সমুন্নত ছিল না, যা মুসলিম মিল্লাতের একজন নেতার মর্যাদার উপযোগী। তাদের মস্তিষ্ক ও স্বভাব-প্রকৃতি আরবের প্রাচীন প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেনি।
তাদের মাঝে না ছিল জিহাদের রূহ, না ছিল ইজতিহাদের শক্তি, যা দুনিয়ার ইমামত ও বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বের জন্য অপহিার্য। খলীফা-ই রাশেদ হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. (মৃত. ১৭১ হি) ব্যতিত উমাইয়া ও আব্বাসী খলীফাদের সকলের অবস্থা ছিল এরূপই। ফলে উপর্যুপরি নানাবিধ ফেতনা ও মুসীবত দেখা দেয়।
‘বদলে যাও বদলে দাও’ বই থেকে
লেখক: হাবিবুর রহমান মিছবাহ