মুহাম্মদ মাহবুবুল হক
প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত দেশের মানুষ। সর্বগ্রাসী বন্যায় দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত। বন্যাকবলিত এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা অবর্ণনীয় দু:খ-কষ্টে দিন যাপন করছেন। রাতে ঘুম নেই, দিনে চুলোয় আগুন নেই, অনাহারে -অর্ধাহারে চলছে দিনপাত। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক যে সম্বল- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যদি বিপন্ন হয় তখন চারদিক অন্ধকার ও হতাশাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ভিটেমাটি পানির নিচে, গবাদিপশু খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে, ফসলি জমি তলিয়ে গেছে, রাস্তা-ঘাট ডুবে গেছে-এমন পরিস্থিতিতে বাঁচা-মরার শঙ্কায় ভূগছেন মানুষজন। কোনো কোনো অঞ্চলের বন্যার্ত মানুষরা এমন দুর্ভোগ ও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঘর-বাড়ির ছাদে ও টিনের চালে অবস্থান করে কোরনা রকম বেঁচে আছেন। আগ্রাসী বন্যায় সহায়- সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। খাবার সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব ও পানিবাহিত রোগের ছড়াছড়ি দেখা দিয়েছে। এককথায় বন্যাদুর্গত মানুষের জীবনের চাকা থেমে গেছে।
সুতরাং মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের তাগিদেই এখন বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো অবশকর্তব্য। বন্যার্ত মানুষের জন্য খাবার, পানি, চিকিৎসাসহ জরুরী জীবনোপায়ের ব্যবস্থা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। মানবতা ও বিবেকের তাগিদে বিপদগ্রস্থদের কল্যাণে এগিয়ে আসা উচিত। বন্যাগ্রস্থ মানুষের করুণ ও দুর্বিষহ জীবনের চিত্র সংবাদ মাধ্যমে দেখে বড় কষ্ট লাগে। বন্যার কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ভয়াবহ বন্যায় গত ১৪ দিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় অন্তত ১০১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার গত বুধবার জানান, ১০ জুলাই থেকে দুর্গত এলাকায় বিভিন্ন কারণে (ডায়রিয়া, সাপে কাটা, পানি ডোবা ইত্যাদি) ১০১ জন মারা গেছেন। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে জামালপুর জেলায়। সেখানে ২৯ জন মারা গেছে। এছাড়া গাইবান্ধা জেলায় ১৫ জন, নেত্রকোনায় ১৩ জন এবং টাঙ্গাইল ও সুনামগঞ্জ জেলায় পাঁচ জন করে মারা যাওয়ার কথা জানা গেছে। দেশের প্রায় ২৮টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াভহ।
বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতির প্রতিরোধে কার্যকর কোন ভূমিকা নেই সরকারের। প্রতি বছর বন্যায় তলিয়ে যায় অনেক অঞ্চল। বানভাসী মানুষকে রক্ষা ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার কোন বিকল্প ভূমিকা নেই পানি উন্নয়ন বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। যেহেতু প্রত্যেক বছরই নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়, তাই এসব এলাকায় বন্যা প্রতিহতকরণ বাঁধ-বেড়ীবাঁধ নির্মাণ, ভরাট নদী পর্যাপ্ত খনন করে নাব্যতা বজায় রাখা সহ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও দীর্ঘ পরিকল্পনার আলোকে বন্যা পরিস্থিতি কমাতে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জরুরীভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব।
বন্যাঞ্চলে সরকারি পর্যাপ্ত ত্রাণ ও পৌঁছে দেয়া হচ্ছে না। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের ও অভাব রয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর খবরে বলা হয়েছে, ‘গত শুক্রবার সর্বশেষ বন্যা পরিস্থিতি বিষয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বলছে, বন্যায় আক্রান্ত সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুরসহ কয়েকটি জেলায় খাদ্য ও নিরাপদ পানির সংকট তৈরি হয়েছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। সংস্থাটির হিসাবে, এ পর্যন্ত ২১ জেলার ৪০ লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে বন্যায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৩টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ১ লাখ ৯ হাজার হেক্টর ফসলের জমি তলিয়ে গেছে’।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ও বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বন্যার কারণে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তি পোহাচ্ছে -এসব অঞ্চলের লোকজন। হাওরাঞ্চলের চারদিকে পানি আর পানি। রাস্তা-ঘাট ডুবন্ত। যাতায়াতের ভরসা ছোট ছোট নৌকা। চতুর্দিকে পানি থাকায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে চোর-ডাকাতের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। রাতে ডাকাতদল গ্রামে হানা দেয়ার চেষ্টা করে। গ্রামবাসী রাত জেগে পাহারা দেয়। বন্যার্ত মানুষের ভয় ও আতঙ্কে এভাবেই কাটছে দিন-রজনী।
হাওরাঞ্চলে চোর- ডাকাত প্রতিরোধে স্পীটবোর্ডের মাধ্যমে উপজেলা পুলিশের টহল জোরদার করা জরুরী। স্থানীয় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা একান্ত কাম্য। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী বন্যা আক্রান্ত। বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলের মানুষের জীবনমান স্বাভাবিক রাখতে ও তাঁদের সাহায্য- সহযোগীতায় সরকারের ত্রাণ তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে, পর্যাপ্ত ত্রাণ যথাযথভাবে অসহায় বন্যার্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সমাজের বিত্তশালীরা অসহায় ও দরিদ্র বানভাসির পাশে দাঁড়াতে হবে। সামর্থ্যানুযায়ী সবাই বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসলে তাঁদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
মানবতার ধর্ম ইসলাম মানুষের সেবা ও সহযোগিতার কথা বলে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, কেয়ামতের দিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে কেয়ামতের দিন পানি পান করানো হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে কেয়ামতের দিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে’। (আবু দাউদ)।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবনে কোন মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট ও পেরেশানি দূর করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে তাঁকে দুঃখ-কষ্ট ও হতাশাকে মুক্তি দিবেন’। এ হাদিসের শেষাংশেই উল্লেখ আছে, যে লোক যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর কোনো ভাইয়ের সাহায্য করবে, আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে সাহায্য করবেন। (আবু দাউদ, তিরমিজি)।
ইসলাম মানবতার সেবায় পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সহমর্মিতায় উৎসাহ দিয়েছে। অসহায় ও নিরীহ মানুষের কল্যাণে দুনিয়াতে সেবা করলে পরকালীন জীবনে আল্লাহ তাঁদের পুরস্কৃত করবেন,সাহায্য করবেন। মনে রাখতে হবে, পানিবন্দী বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোও ইবাদত। তাই ধর্মীয় ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বন্যার্ত মানুষের সেবা ও সহযোগিতায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট