এম শামসুদদোহা তালুকদার
দেশে এখন গুজবের হাট বসেছে সপ্তাহের সবকটা দিনই। এ মাসে গুজবকে কেন্দ্র করে অন্তত এক ডজনেরও বেশী আদম সন্তান মারা গেছেন, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আলাদা দুর্বৃত্তদলের হাতে। এমন মর্মান্তিক ঘটনার শিকার অধিকাংশই সহজ সরল অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ। কয়েকজন নারীও এ তালিকায় আছেন।
‘ছেলেধরা পেয়ে গেছি’ বলে কয়েকজনে চিৎকার মারলেই হলো, একদল দাঁতাল শুয়োর এসে নিরীহ একটি মানব শরীরের উপর উপর্যুপুরি মারপিট করতে থাকে তাঁর প্রাণবায়ুটা বের হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু না। মারা যাবার পরে ছিন্নভিন্ন দেহের উপর উঠে পদাঘাত ও লাঠির বারি মারতে মারতে নিজে ক্লান্ত হবার পর শুয়োরগুলা ক্ষান্ত হয়।
রাজধানীর বাড্ডায় রেনু বেগমের কী অপরাধ ছিলো? তাঁকে তো দেখতে নিম্নশ্রেণি কারোর মতো ছিল না। তিনি ছিলেন সুশ্রী ও সুশিক্ষিতা। জানোয়ারদের দ্বারা আক্রান্ত হবার সময়ও তিনি সুন্দর করে কথা বলেছেন। তাঁর সুন্দর করে বলা সত্য কথা শোনেনি বাংলার হায়েনারা। তাঁর আহাজারি কারো হ্রদয় স্পর্শ করেনি।
তিনি স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর থেকে দু’সন্তান নিয়ে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজে মেধাবী ও উচ্চ শিক্ষিতা। দুসন্তানকে সুশিক্ষিত করার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল তাঁর মাঝে।
রেনু নিজ বাসার কাছে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন মেয়ে তুবাকে এ সময়ে ভর্তি করা যাবে কিনা সে তথ্য নিতে। এক পর্যায়ে তিনি প্রধাণ শিক্ষকের রুম অবধি গিয়েছিলেন। ছেলেরা ডামাডোলের কারণে শিক্ষকরা তাকে রুমে তালা দিয়ে আটকে রেখেছিলেন। কিন্তু স্কুলের সামনে তরকারি বিক্রেতা হৃদয় গংরা তালা ভেঙে শিক্ষকদের সামনে থেকে রেনুকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে গণপিটুনি দেয়। মুষ্টিমেয় কয়েকটা খুনী রেনুর জীবনলীলা সাঙ্গ করে। অধিকাংশই এ সময়ে ছিল সবাক দর্শক অথবা এনজয় করনেওয়ালা।
রেনুর ভাইর স্টাটাস পড়লে আপনাকে কাঁদতে হবে। রেনুকে মারার ভিডিও তুলেছে অনেকেই। বাহ্। তিনি ভিডিও যারা করেছে ও দেখেছে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
রেনু এক দঙ্গল মানুষের জেরার মুখে খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। এটাই ছিল তাঁর দূর্বলতা। তাই তাঁকে মেরে ফেলার যুক্তি খুঁজে পেয়েছে বাড্ডার ঐসব খুনীরা। যে ছেলেটি সবচেয়ে বেশী নৃশংসতা চালিয়েছে, তাকে দেখলে ইনোসেন্ট মনে হলেও তার মাঝে বাস করে এক ভয়ংকর খুনী। ওখানে অন্তত কয়েক দশক খুনী ছিলো। অন্যরা ছিল সহযোগী। ভাবা যায়! এত কম বয়সী ছেলেদের অন্তরে একেকজন খুনী বাস করে।
দুদিন আগে দেশের সব কয়টি গণমাধ্যমে চুয়াডাঙ্গার এক মাদ্রাসার হেফজ করতে আসা এগারো বছরের একটি তালেবের এলেমের লাশ পাওয়া গেছে নিখোঁজের পরদিন ইটভাটায় পাশে। আবীর নামে হতভাগ্য ছেলেটিকে জবাই করে মাথাটি নিয়ে গিয়েছিল খুনীরা। গতকাল তার মস্তক একটু পুকুরে পাওয়া গেছে। সর্বশেষ দুটো ঘটনার চিত্র তুলে ধরলাম।
গুজব হলো, পদ্মা সেতু নির্মাণের এ পর্যায়ে ‘কল্লা' লাগবে। বর্তমান সভ্য জগতে এমনটা কেউ বিশ্বাস করবে? অথচ বাঙালীরা ঠিকই বিশ্বাস করছে। তাহলে এ দুজনের মস্তক কী সেজন্য কাটা হয়েছে? আমার উত্তর- একদম নয়। খুনীরা দুটো কারণে মাথা আলাদা করে লুকিয়ে ফেলে
১. মৃত্যূর পর মানুষের বডি গুরুত্বপূর্ণ। মানব কঙ্কাল চড়া দামে বিক্রী হয়। কারণ ওগুলো গবেষণার কাজে লাগে। মাথার কঙ্কাল একই কাজে দরকার।
২. আলামত বিনষ্ট করা। অর্থাৎ নিহতের পরিচয় লুকিয়ে রাখা। এছাড়া, খুনীরা তাদের উদ্দেশ্য যাতে কেউ না বুঝতে পারে, সেজন্য তাদের দোসরদের দ্বারা গুজব ছড়িয়ে নিজেরা নিরাপদ থাকার প্রচেষ্টা করা। যেহেতু গুজবের লাগি কল্লা কাটার সিজন চলছে, সেহেতু ভিন্ন কোন কারণ খুঁজতে কেউ যাবে না। সবাই বলবে এটা ছেলে ধরাদের কাজ।
সর্বশেষ, চুয়াডাঙ্গার মাদরাসার ছাত্রটির সাথে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে মর্মে ময়না তদন্ত রিপোর্টে এসেছে। এখানে কল্লা কাটা গুজবের কি আছে? অথচ তারা সেদিকে ঘটনার মোটিভ ডাইভার্ট করতে চেয়েছিল।
মূলত: ছেলেধরা কান্ড ঘটছে ভিন্ন উদ্দেশ্যে। পদ্মার উদ্দেশ্যে না। সেটা গুজব বলে চালালে গনপিটুনি দিতে সুবিধা হয়। কিছুক্ষেত্রে গনপিটুনি দেয়া হয় শত্রুতার জন্য। নারায়নগঞ্জে স্কুল পড়ুয়া নিজ মেয়েকে দেখতে উপহার নিয়ে গিয়েছিলো এক পিতা। তিনি স্কুলের পাশে মেয়ের সাথে দেখা করতে ঘোরাঘুরি করছিলেন। তিনি গনপিটুনিতে মারা গেছেন তার সাবেক স্ত্রীর বর্তমান স্বামীর ইন্ধনে। মেয়েটি মায়ের সাথে থাকতো।
ছেলেধরা বা বাচ্চা অপহরণ, গনপিটুনি, মস্তক দ্বিখন্ডিত করে হত্যার ঘটনা এসবই ভিন্ন ভিন্ন কারণে ঘটছে। এর সাথে পদ্মা সেতুতে রক্ত বা মাথা লাগবে এমন প্রচারণার কোন ভিত্তি নেই। তবুও বাঙ্গালরা মানুষ মারছে লোকজন জড়ো করে। এ নৃশংসতা এখন এক্সিডেন্ট পর্যায়ে আর নেই। এটা এখন চরম অবক্ষয়গত ‘ম্যানিয়া’ পর্যায়ে চলে গেছে।সমাজ থেকে মনুষ্যত্বতা নির্বাসিত হয়েছে। চারদিকে যেন খুনীদের জন্য পসরা বিছানো।
সরকারের ভূমিকার প্রতি আস্থা নেই বিন্দুমাত্র। এর কারণ একটাই, সরকারকে এখন আর কেউ আইনের রক্ষক মনে করে না। কারণ তারা তো পৃথিবীর সেরা আইনভঙ্গ করা সরকার। মানুষ এখন জানে খুন করলে তার কিছুই হবে না। তাই খুনের উৎসব চলছে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে। সরকারের কাছে কেউ অপরাধীকে তুলে দিতে চায় না কারণ তাহলে আর বিচার হবে না।
এ দেশে বিচারহীনতাই যেন সরকারের ভূষণ। তারা ক্ষমতার রোশনাই উপভোগ করবে কিন্তু সুশাসন দিবে না, তথা জনগনকে ভোট দেয়ার স্বাধীনতা দিবে না। তা এখন হাইজ্যাকড্।
বিচারহীন সরকার মূলত বিচিহীন খাসীর মতো। শুধু তেলচর্বি থাকবে, কিন্তু ‘সেই কাজ'টা করার ক্ষমতা নাই’।
লেখক, অনলাইন এক্টিভিস্ট, বিশ্লেষক