মতামত: বর্তমানে ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ একটা বড় নাম। একক হিসেবে বর্তমানে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী নাম। চলমান জোটবদ্ধার উল্টো স্রোতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিনের পথচলায় নিজেদের একটা শক্ত প্লাটফর্মে দাড় করিয়েছে দলটির নীতি নির্ধারকরা। অন্যান্য ইসলামি দলগুলো যখন ক্রমাগত ভঙ্গুরতা, দলীয় কোন্দল, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা, চেয়ার লিপ্সা পাশাপাশি নীতিগত মিলনেই এমন দলের সাথে কৌশলগত জোটবদ্ধতার কারণে সরকারের কোপানলে পড়ে অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে; বিভিন্ন বড় দলের ক্রিড়নকে পরিণত হয়েছে এবং রাজনীতির গলি খুপচিতে ঘুরপাক খাচ্ছে সেখানে ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ' একাই একক প্রচেষ্টা, নীতিগত কঠোরতা, কর্মীদের নেতৃত্বের প্রতি নিবিড় আস্থা সর্বপরি সরকারের কৌশলগত আনুকূল্য কাজে লাগিয়ে এগিয়েছে অনেকটা পথ। অলিগলি পেছনে ফেলে পা ফেলেছে রাজনীতির মহাসড়কে। ইসলামী আন্দোলনের মহাসড়কে পথচলা শুরু হয়েছে মাত্র! এবার এই পথ ধরে সামনে এগিয়ে চলার পালা ।
বিগত দশ বছর ছিল ইসলামী আন্দোলনের জন্য কিশোর থেকে যুবক হয়ে উঠার মতো। উপযুক্ত পরিবেশ, নিয়মিত পরিচর্যা ও পরিমিত জল সিঞ্চনে আগাছার ভ্রুকুটি পেরিয়ে ইসলামী আন্দোলনের এখন ‘মহীরুহ’ হয়ে উঠার সময়।
দলটি যত বড় হয়ে উঠছে স্বাভাবিকভাবেই তত বেশি আলোচনায় আসছে। আলোচনার পাশাপশি নানাবিধ সমালোচনারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সম্মুখিত হতে হচ্ছে বিভিন্ন প্রীতিকর- অপ্রীতিকর প্রশ্নের। সবচেয়ে বেশি যে সমালোচনাটা হচ্ছে সেটা হলো বর্তমান সরকারী দলের সাথে ঐক্যবদ্ধতা ও আনুকূল্য নিয়ে!
সরকার কি আসলেই কিছুটা ফ্রী প্লেস দিচ্ছে ইসলামী আন্দোলনকে ? এর সহজ উত্তর হলো, দিচ্ছে। সরকার নিজেদের স্বার্থেই দিচ্ছে । কেন ?
বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ। ক্ষমতার জন্য যে কোন সময় হুমকি হওয়ার সক্ষমতা রাখে। প্রভাবশালী এই প্রতিপক্ষকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করতে সকল পন্থাই অবলম্বন করেছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপির সবচেয়ে বড় মিত্র জামায়াতে ইসলামির সাথে সরকারের আদর্শিক বেশ দুরত্ব ও শত্রুতা আছে। সাথে যোগ হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধকেন্দ্রীক জামায়াতে ইসলামের বিতর্কিত অবস্থান। জামাতকে নিশ্চিহ্ন করতে সকল পথ স্বাচ্ছন্দে আবলম্বন করবে তারা এটা স্বাভাবিক ছিল। জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা গেলে বিএনপিকে ২৫%- ৩৫% দুর্বল করে ফেলা যায় এটাও একটা বড় কারণ জামাতের প্রতি খড়গহস্ত হওয়ার। মোটামুটি রাজনীতিতে প্রভাব রাখার মতো দল ছিল জাতীয় পার্টি। ভোটের বাজারে তাঁদের ৫-১৫ ভাগ ভোট আছে। সরকার নানা ফাঁদে ফেলে এঁদের পকেটে রেখেছে অনেক দিন ধরেই। গণতান্ত্রিক একটা দেশ যাঁদের সরকার চালাতে বাহিরের বিভিন্ন বড় রাষ্ট্রের সহায়তা নিয়মিত গ্রহণ করতে হয় তারা দীর্ঘদিন এমন একটা রাষ্ট্র চালাতে পারে না যেখানে কোন ভিন্নমত নেই ! সরকারের টিকে থাকতে প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত কিছু বিরোধিতার। কিছু মিছিল মিটিং আন্দোলনের । এমন একটা দলের যারা সরকারের জন্য কখনোই দৃশ্যমান হুমকি হবে না আবার বিরোধী দলকেও কখনো শক্তিশালী করবে না বরং বিরোধী পক্ষের ভোট নষ্ট করে উল্টো সরকারের জন্যই লাভবান প্রজেক্ট বলে বিবেচিত হবে। জাতীয় পার্টিকে সরকার এই সুযোগ দিতে পারে না। জাতীয় পার্টি সরকারের জন্য এককভাবে হুমকি না হলেও পল্টি মেরে বিপক্ষের সাথে মিশে গেলে সরকার রীতিমতো বিপদে পড়ে যাবে। সরকারের সামনে একমাত্র অবলম্বন ছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ !
সরকার ইসলামী আন্দোলনকে কেন বেছে নিল ?
- নিজেদের নীতিতে অটল থাকা।
- দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ইসলামী আন্দোলন জোটবদ্ধতায় বিশ্বাস করে না ফলে সমমনা বা বিরোধী পক্ষের কারও সাথে ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
- একটা দর্শনযোগ্য সরকার বিরোধী আন্দোলন, মিটিল-মিটিং-লোকসমাগম করার মতো যোগ্যতা আছে।
- ভোটের বাজারে বড় কোন ফ্যাক্টর নয় আবার আশু বড় কোন ফ্যাক্টর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
- ইসলামী আন্দোলনের সাথে সমমনা অন্যান্য ইসলামী দলের মাঝে সীমাহীন দূরত্ব।
ইসলামী আন্দোলনের করণীয় কি ছিল?
ইসলামী আন্দোলন এখন যেভাবে যা করছে তাই করণীয় ছিল। ইসলামী আন্দোলন বিগত ১০ বছর কাজে লাগিয়ে জেলা উপজেলা থানা পর্যায়ে নিজেদের শক্তিশালী কমিটি দাড় করাতে পেরেছে। নিজেদের নীতিতে অটল থেকে এককভাবে নির্বাচন করেছে এবং ২৯৯ আসনে প্রার্থীতা দিতে পেরেছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পেরেছে। সরকার কেন সুযোগ দিলো এটা এখানে প্রশ্ন আসতে পারে না। ইসলামী আন্দোলনের একটা মিশন ভিশন আছে। একটা টার্গেট আছে। আর দলটি সেই টার্গেট পানেই এগিয়ে চলছে নিরলসভাবে। এখানে পথ চলতে কে সহযোগী হলো আর কে বিরোধী হলো এই প্রশ্নের দায় দলটি কেন নিবে? দল অভিষ্ট লক্ষে এগিয়ে চলেছে কিনা এটা আলোচনার বিষয় হতে পারে। ইসলামী আন্দোলন নীতিগতভাবে সরকারের সাথে ঐক্যমত্যে বা সরকারের নির্দেশনায় পথ চলছে এটা সম্ভবত দলের বড় শত্রুও বিশ্বাস করবে না তবে একক পথ চলায় ও সরকারের সুবিধা গ্রহণ করায় নানাদিক দিয়েই সরকার লাভবান হয়েছে, হচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
কেন ইসলামী আন্দোলনের এতো বিরোধিতা !
ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি দলের প্রতি অন্ধ অনুগত কর্মীবাহিনী । দলের নেতৃত্বের প্রতি যাঁদের অগাধ অস্থা। নেতাদের প্রতিটি বাক্যের প্রতি অটলায়মান স্থির বিশ্বাস । এই আনুগত্যটাই দলটার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও হয়ে যেতে পারে! নিজের দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে কর্মীদের অনিয়ন্ত্রিত মারমুখী আচরণ, পূর্বাপর সম্মানী ও মুরুব্বী আলেমদের কটুবাক্যে জর্জরিত করা, দলের আলোচকদের ও সমালোচকদের শত্রুজ্ঞান করে হামলে পড়া সহ নানাবিধ উপায়ে সমমনাদের শত্রুতে পরিণত করেছে। যারা হতে পারতো ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সহযোগী এরাই কর্মীদের আচরণে বিরক্ত ব্যথিত হয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে । সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে এতসব ঘটেছ মাঝারী সারির অনেক নামী নেতৃবৃন্দের ছত্রছায়ায় অনেক সময় এঁদের নিয়ন্ত্রণে এঁদের উস্কানিতে!! ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিরোধীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হচ্ছে দলটি নীতিতে অটল থাকার কথা বলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রকারান্তরে দেশের উপর চেপে বসা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে নানাবিধ সহযোগীতা করে যাচ্ছে ফলে সরকারের সাথে সদ্ভাব নেই, সরকারের কর্মকাণ্ডে যাঁদের হৃদয় ক্ষত হয়েছে, বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চায় এমন প্রতিটা লোকের বিরাগভাজনে পরিণত হয়েছে।
সামনের করণীয় কি হতে পারে?
ইসলামী আন্দোলনের মূল ভিত্তি পীর মুরিদী ! মুরিদদের বাইরে সমুদ্রসম জনসমর্থন পেতে দলকে পীর-মুরিদী থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে দ্রুততম সময়ে। একজন লোক পীর হিসেবে গ্রহণীয় না হয়েও দলের নেতা হিসেবে গ্রহণীয় হতে পারেন। সরকারের আনুকূল্য সবসময় স্থায়ী হবে না ধরে নিয়ে পরবর্তী প্রতিকূল পরিবেশ সামাল দেয়ার জন্য নিজেদের বলয় শক্তিশালী করার পাশাপাশি সমমনাদের সাথে সুসম্পর্ক ও শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। কর্মী বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করার পাশাপাশি আচরণে সহনশীলতার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কেননা দিন শেষে দলের মুল্যায়ন হয় কর্মীদের দেখেই। সর্বোপরি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা করতে হবে তা হলো দলের উপর কারো ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক সহযোগী হওয়ার যে অভিযোগ তা গুরুত্ব দিয়ে এ থেকে বেরিয়ে আসা নইলে দলের কর্মী সদস্যদের বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের কাছে দলটির ভাবমূর্তি অনুজ্জ্বল থেকে যাবে। দল সম্পর্কে ভুল বার্তা প্রতিষ্ঠিত হবে যা পরবর্তিতে দলটির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সুস্পষ্ট প্রভাব বিস্তার করবে।
বাংলাদেশে বিশাল সম্ভাবনা পরে রয়েছে ইসলামি আন্দোলনরত দলগুলোর জন্য। ধর্মপ্রিয় সাধারণ মানুষ চলমান শক্তি চথুষ্টয়কে দেখে দেখে ক্লান্ত । তারা পরিবর্তন চায়। ইসলামি দলগুলোর ঐক্যমত্ব চায়। সমৃদ্ধ আগামী নির্মানের পথে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশে হয়ে উঠুক আলোকবর্তিকা।
সাকিব মুস্তানসির
লেখক, বিশ্লেষক