রেজাউল হক ডালিম
শিরোনামটা একটু লম্বাই হয়ে গেলো। কারণ- লেখাটাও একটু লম্বা। আর যেসব পয়েন্ট ধরে লিখবো ভাবছি তার সবক’টির খানিক টাচ দিতে চাইলাম শিরোনামে। শিরোনমটা একটু তীর্যকও। এ ক্ষেত্রে আবেগকে দায়ী করবো না কোনোভাবেই; বরং আবেগের লাগামটা ছেড়ে দিয়েছি ইচ্ছাকৃতভাবেই। ছেড়ে দেয়াটাকেই সঙ্গত মনে করেছি। গত ১০ জুলাই, বুধবার থেকে আমাদের দেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একটা বিষয়কে ভিত্তি করে ত্যানা-ছেঁড়া দেখে অনবরত টগবগ করছি। তাই পরের গোলামির মাঝেও একটু সময় বের করে কিছু একটা লিখতে বসলাম।
কাউকে না কাউকে তো এ বিষয়ে কথা বলতেই হবে। সামান্য করে হলেও আস্ফালনকারীদের মুখে প্রতিবাদের কালি ছিটিয়ে দিতে হবে। আমি এক ক্ষুদ্রই না হয় এই প্রয়াসটুকু চালালাম। সংবাদমাধ্যমগুলোর একটা নিউজ নজর কাড়লো। খবরের বিষয় হচ্ছে- ‘সরকারি খরচে মক্কায় যাচ্ছেন ৫৫ আলেম’। এটা হচ্ছে মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল এ খবরের যে শিরোনাম দিলো- তা পড়ে শুধু ক্ষুব্ধই হলাম না, সাংবাদিকতা যে ‘ন্যাক্কারজনক’ পর্যায়ে চলে গেছে সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠলো। মনে হলো- ‘রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম’ কথাটা বর্তমানে চরম অসত্য।
- অনেক সংবাদমাধ্যম শিরোনাম করেছে এভাবে- ‘সরকারি খরচে হজ্জে যাচ্ছেন হেফাজতের শীর্ষ ৫৫ আলেম’। প্রথমত: দু’টি বিষয়। ১) শিরোনামে মিথ্যাচার। ২) শিরোনামে বিভ্রান্তি। এই দুই বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে- এমন শিরোনামকারী সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক/সম্পাদক যদি তাদের পাঠক সংখ্যা কিংবা রেটিং পয়েন্ট বাড়ানোর জন্য উপরেলিখিত খবরের এমন ধরনের ‘বিশ্রি চমকপ্রদ’ শিরোনাম দিয়ে থাকেন তবে তাদের ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই- তথাকথিত এমন সাংবাদিক বা সম্পাদক তাদের সংবাদমাধ্যমের সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য নিজের জন্মাদাতা পিতা- মাতার ব্যাপারেও এমন ‘বিশ্রি চমকপ্রদ’ শিরোনাম দিয়ে নিউজ প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করবেন না।
নিশ্চয় সাংবাদিকতার নীতিমালা তাদের খুব নখদর্পণে। কিন্তু আমি ১০০ ভাগের চাইতে বেশি নিশ্চিত- তাদের মাঝে নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। থাকলে এমন শিরোনাম কোনো সাংবাদিক/সম্পাদক দিতে পারতেন না। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে তারা এমন শিরোনাম দিয়ে থাকেন তবে এবার কথা হবে ‘শিরোনামে মিথ্যাচার ও শিরোনামে বিভ্রান্তি’ বিষয়টাকে সামনে রেখে।
শিরোনামে মিথ্যাচার : ‘হাজিদের ধর্মীয় পরামর্শক হিসেবে সরকারি খরচে সৌদি আরব যাচ্ছেন দেশের ৫৫ জন শীর্ষ আলেম। সৌদি আরবে বাংলাদেশি হজ্জযাত্রীদের হজ পালনে ধর্মীয় পরামর্শ দিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ওলামা মাশায়েখ টিমের সদস্যও তারা। রাষ্ট্রীয় খরচে যাওয়া এই হজ্জযাত্রীদের প্যাকেজের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হবে এই আলেমদের। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শিব্বির আহমদ উছমানি স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়’।
এটা হচ্ছে মূল খবর। এ বিষয়ে কথিত সাংবাদিক আর বুদ্ধিজীবিদের অসুস্থ্য মানসিকতা পরখ করে কিছু লেখার অভিপ্রায় জাগার পর একটু খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে কথা হলো একাধিক ক্বওমি আলেমের সঙ্গে। যারা ক্বওমিবিষয়ক নীতি-নির্ধরণী পর্যায়ের এবং অনেক সময় সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন।
আলেমরা যাচ্ছেন পরামর্শক হিসেবে, হাজি হিসেবে নয়। তবে এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার, তাদের সফরের যে খরচটা হবে সেটা ব্যয় হবে ‘বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক হজ্জযাত্রীদের প্যাকেজের’ খরচের খাত থেকে। কিন্তু এই আলেমদের পেছনে উক্ত খাত খরচ করার মানে এই না যে- তারা সরকারি খরচে হাজি হচ্ছেন। অথচ কী নির্লজ্জভাবে কথিত সাংবাদিক/সম্পাদকরা খবরের শিরোনামে এইসব আলেমদের ‘সরকারি খরচের হাজি’ বানিয়ে দিলেন।
বিশেষভাবে উলেখ্য একটা বিষয় হচ্ছে - এই তালিকায় যে সকল আলেম আছেন তাদের বেশিরভাগই এর আগে একাধিকবার হজ্জ করে ফেলেছেন। সুতরাং তারা কোনোভাবেই সরকারি খরচে হাজি হওয়ার জন্য লালায়িত নন।
এবার আসি ‘শিরোনামে বিভ্রান্তি’ বিষয়ে। শিরোনামে লক্ষ্যণীয় যে শব্দটি ছিলো- ’হেফাজত’। মানুষের মানসিকতা কী পর্যায়ের অসুস্থ্য আর কুটিল হলে পরে সম্পূর্ণ প্যাঁচ-ঘোচহীন একটা বিষয়কে জটিল করে তুলতে পারে! অর্ধশতাধিক আলেমের হাজিদের পরামর্শক হিসেবে যাওয়ার সঙ্গে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের কী সম্পর্ক থাকতে পারে তা সুস্থ্য বিবেকসম্পন্নদের বোধগম্য নয়। কিন্তু যাদের বুক-পেটভর্তি কুটবুদ্ধির বহর, তাদের এ বিষয়ে ছিলো বেশ চিন্তার খোরাক! এবং এটাই তারা বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন। সেই তালিকায় আছেন কিছু সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, জামায়াতি আর কিছু ফেসবুক ব্যবহাকারী ‘মফিজ’। আরও আছেন- যারা সত্যিকার অর্থে লালায়িত সরকারি খরচে হজ্জে যাওয়ার জন্য।
আচ্ছা ওই সাংবাদিকদের প্রতি আমার একটা প্রশ্ন- যারা শিরোনামে ‘হেফাজত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। আপনার বাসা/বাড়ির পার্শ্ববর্তী স্কুলে যেসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পড়ান তারা হয়তো মতাদর্শের দিক থেকে আওয়ামী লীগ হতে পারেন, বিএনপি হতে পারেন, জামায়াত-শিবির হতে পারেন, জাতীয় পার্টি হতে পারেন এমনকি জাসদ-বাসদও হতে পারেন। এই স্কুলের শিক্ষা বিষয়ক কোনো রিপোর্ট করতে গেলে কি আপনি শিরোনাম দিবেন- ‘সরকারি বেতনে অমুক দলের তমুন নেতা পাঠদান করছেন?’।
নিশ্চয় তখন সাংবাদিকতার নীতিমালা আওড়াবেন। তাহলে এই বিষয়টাতে এমন জঘণ্যভাবে জলঘোলা করার পেছনে মূল কারণটা কী- একটু নিরপেক্ষ আর সরল জনগণের সামনে খোলাসা করবেন? আর এই এই পরামর্শক টিমে শুধু কি ক্বওমির আলেম আছেন? আলিয়া মাদরাসার আলেমও তো আছেন, তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও তো এমন একটা শিরোনাম দরকার ছিলো- ‘সরকারি খরচে হজ্জে যাচ্ছেন তালামিয/জামায়াত কিংবা অমুক সংগঠনের শীর্ষ ... জন নেতা’। এমনটা করলেন না কেন?’।
ঠিক একইভাবেই ক্বওমি মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতির সময় কথিত সাংবাদিকসহ কয়েকটি কুচক্রী মহলের গাত্রদাহ শুরু হয়। তারা আধাজল খেয়ে মেতে উঠেন হিংসাত্মক, অযৌক্তিক, হাস্যকার আর খল সমালোচনায়। সেটা প্রশমিত হতে না হতেই ক্বওমির আলেমদের সরকারি খরচে সৌদি যাওয়ার খবর- তাদের সেই পুরনো জ্বালাপোড়াটা উস্কে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
অবশ্য যারা মননে- মগজে উচ্চপর্যায়েরর হিংসা-বিদ্বেষ আর ধর্ম-ক্বওমিবিরোধীতা লালন করেন তাদের বক্তব্য ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যায়ে আমাদের দেশের ফেসবুক ব্যবহাকারীদের ব্যাপারে যৎসামান্য বলতে চাই। তাদের (একাংশকে) আগেই অবশ্য আমি ‘মফিজ’ উপাধিতে আখ্যায়িত করেছি। আমাদের সমাজে আক্কেল- জ্ঞানহীন কাউকে বুঝাতে ‘মফিজ’ সম্বোধন করা হয়। যারা অ- চন্দ্রবিন্দু কিছুই বুঝার ক্ষমতা রাখে না তাদেরও দেখলাম ফেসবুকে এ বিষয়ে কী নিদারুণ পাণ্ডিত্য! কী ক্ষুরধার স্ট্যাটাসের বাহার!! আহারে- ওই ৫৫ আলেমকে বাদ দিয়ে যদি তাদেরই পাঠানো হতো মক্কায়!!
লেখক: ডেপুটি নিউজ এডিটর, দৈনিক প্রভাত বেলা