
বিল্লাল হোসেন, যশোর: যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক তরিকুল ইসলাম শিপনের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ফারজানা খাতুন (৩২) । দাম্পত্য জীবনে তাদের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। নাম রাফি (৬)। গর্ভে থাকা কন্যা সন্তান সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভুমিষ্ট হওয়ার কথা ছিলো। সেজন্যে ফারজানাকে নিয়ে ৩০ জুন দুপুরে সাতমাইল বাজার থেকে হিউম্যানহলার রিজার্ভ করে যশোর শহরের একতা হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন শিপন। এসময় তার শিশু সন্তানও সাথে ছিলো। সেদিনের যাত্রায় তাদেরকে পরিবারের লোকজন হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছিলেন। কিন্তু যশোর শহরের বাবলাতলা ব্রিজের আগে বটতলায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় মারা যান ফারজানা। তার স্বামী ও সন্তান গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
২৬ জুন যশোরের চৌগাছা উপজেলার সলুয়া বাজারে ট্রাকের ধাক্কায় মাস্টার্স পরীক্ষার্থী শারমিন সুলতানা তমা (২৫) নিহত হন। ঘটনার সময় তিনি যশোর এমএম কলেজ থেকে এমবিএ ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র পরীক্ষা দিয়ে স্বামী স্বরূপদাহ ইউনিয়নের মাশিলার মাসুদুর রহমান মাসুদের সাথে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছেলেন।
২০ জুন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার খইতলা নামক স্থানে বাসচাপায় ধলিগাতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ফার্স্ট ও সেকেন্ড বয় নিহত হয়। নিহতরা হলো- উপজেলার ধলিগাতি গ্রামের খাইরুল বাশারের ছেলে আশিকুর রহমান (১৫) ও জামলা গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে আল-আমিন (১৪)। নিহত দুইজনই ওই বিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র ছিল। ক্লাসে আশিকুরের রোল নম্বর ছিল ১ ও আল আমিনের রোল নম্বর ছিল ২। ফারাজানার মৃত্যুতে আশার পরিবর্তে স্বজনদের মন ছেয়ে যায় দূরাশায়। আবার মেধাবী আশিকুর এবং আল আমিনের মতো অনেকের স্বপ্ন সড়কে মিশে যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত এভাবেই কতো মানুষের স্বপ্ন সড়কে মিশে যাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের অনেকেই সমাজের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকে। দুর্ঘটনার মধ্যেই একটি পরিবারে নেমে আসে কান্না। দিনে দিনে সড়ক ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ঝুঁকি নিয়ে মানুষ চলাচল করছে।হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে যশোরের বিভিন্ন রাস্তায় ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। সচেতন মহল দাবি করেছেন যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক, খুলনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক, যশোর-মাগুরা মহাসড়ক, যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ও যশোর-সাতক্ষীরা অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, অতিরিক্ত গতি ওভারটেকিং, অপ্রশস্ত রাস্তা,ওভার লোডিং, আইন অমান্য, প্রযুক্তির ব্যবহার, জনসংখ্যার চাপ ও অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা,ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ ও লাইসেন্স বিহীন চালক, সড়কের ওপর অবৈধ হাটবাজার, অবৈধ স্থাপনা, যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুড়ি, রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা, মাদক গ্রহণ, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, প্রভৃতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।
গত ২৮ মার্চ যশোর -খুলনা মহাসড়কের সদর উপজেলার চাউলিয়া গোপালপুর এলাকায় বেপরোয়া গতির ট্রাকের ধাক্কায় লেগুনার যাত্রী মা -মেয়ে সহ ৪ জন নিহত হয়েছিলেন। নিহতরা হলেন লেগুনার চালক যশোর সদরের জঙ্গলবাঁধাল গ্রামের সুলতান মোল্লার ছেলে শামীম হোসেন (২২), মণিরামপুর উপজেলার ভোজগাতি গ্রামের রিশিকান্ত দাসের স্ত্রী শিউলী দাস(২৮), তার মেয়ে মেয়ে সাধনা দাস(৮) ও গাবুখালী গ্রামের সুবাশ বৈরাগীর ছেলে সুব্রত বৈরাগী (২৫)। এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ১৫ জন।
২০ মার্চ যশোরের শার্শায় পিকআপের চাপায় স্কুল ছাত্রী মেফতাহুল জান্নাত নিপার (১১) ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ডান হাতটিও ভেঙ্গে যায়। আহত নিপা বুরুজবাগান পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ট শ্রেণির ছাত্রী ও বুরুজবাগান গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে। পা হারানো মেধাবী এই শিক্ষার্থীর স্বপ্ন এখন অনেকটাই বাঁধার মধ্যে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার প্রতিবাদে নানা দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে জণগন। প্রশাসনের পক্ষে দাবিগুলো মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরেই তা ভুলে যান সবাই। ফলে দাবি পূরণের আশ্বাসগুলো বাস্তবায়ন হয় না।
এই বিষয়ে কথা হলে নিরাপদ সড়ক চাই যশোর জেলা কমিটির উপদেষ্টা অ্যাড. আবু মুরাদ জানান, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। ইচ্ছামতো সড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের মাথা ব্যাথা নেই। সড়কের গা ঘেষেই টোং দোকান, সবজির বাজার বসানো, সড়কের পাশে কাঠের গুড়ি ফেলা রাখা, রাস্তার উপরে যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, চালকের অদক্ষতা, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। মানুষের রক্তে ভিজে যাচ্ছে সড়ক। তিনি বলেন সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শুধু আইন করলেই হবেনা। পাশাপাশি সেই আইন প্রয়োগ করতে হবে। এই সংক্রান্ত সভা সেমিনার থেকে অর্জন করা জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, বৈধ অবৈধ যানবাহন গোটা সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়া ফিটনেস বিহীন যানবাহন ও চালকদের লাইসেন্স না থাকার বিষয়টি তো আছেই। ভ্রাম্যমান আদালত নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু আদালত উঠে গেলে আবার যা তাই অবস্থা বিরাজ করে।
বাংলাদেশ রোড ট্যান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) যশোর সার্কেলের সহকারী পরিচালক কাজী মোহাম্মদ মোরসালিন জানান, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১৫শ ৪২ জন পেশাদার চালককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আরো ২৫ শ চালককে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন মহাসড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে নিয়মিত । গত বুধবারও ২০টি বাস চালককে মামলা দিয়ে ১৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
/এসএস