
বেতন বৈষম্যের প্রতিবাদে বিষপানে আত্মহত্যা চেষ্টা করেছেন ‘সময়’ টেলিভিশনের সাংবাদিক মোঃ সাইফুর রহমান শাকিল। শনিবার রাতে নিজ কর্মস্থল ‘সময়’ টেলিভিশন কার্যালয়েই বিষপান করেন সাইফুর। আত্মহত্যার আগে ‘সময়’ কর্তৃপক্ষকে দায়ি করে ফেসবুকে লম্বা স্টাটাস দেন সাইফুর।
বিষপানের পর আহত অবস্থায় সাইফুরকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডে পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এর আগে তাকে স্টোমাক ওয়াশ করানো হয়েছে। আপাতত শঙ্কামুক্ত আছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
মোঃ সাইফুর রহমান শাকিল চিত্র সাংবাদিক ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি সময় টেলিভিশনে কাজ করছিলেন। সহকর্মীদের বেতন বাড়লেও তার বেতন বাড়ানো হচ্ছিলো না বলে তিনি ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন। ‘সময়’ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে বেতন বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েও না রাখার অভিযোগ তোলেন সাইফুর। নিজের করা ফেসবুক পোস্টে টিভি কার্যালয়ের সামনেই নিজের মৃত্যুর ঘোষণা দেন সাইফুর। ফেসবুকে দেয়া তার স্টাটাসটি তুলে ধরা হলো:
২০১১ সাল থেকে সময়ের সাথে পথচলা শুরু। আজকের দিনটি পর্যন্ত একাগ্রতা, সততা ও ভালোবাসা দিয়ে কাজ করেছি। কখনো কাজের প্রতি, দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করিনি। কখনো বলিনি আমার কর্মঘণ্টা শেষ, এখন আমি আর কাজে যেতে পারবো না। কখনো কাজে গিয়ে বলিনি আমার রিপ্লেস পাঠাতে। তবুও বছর শেষে শূন্য হাত পরপর দুই বার।
যখন সময়ে যোগ দিয়েছিলাম, তার কয়েক মাস পর আরো দুটি চ্যানেলে ভালো বেতনে অফার পেয়েছিলাম। আমাদের ব্যাচের অনেকেই চলে গিয়েছিল সময় ছেড়ে। আমি যায়নি। কারণ সময়ের প্রতি ভালোবাসা। সময়ের শুরুটা আমাদের হাত দিয়ে।নিচতলা থেকে দশ তলা সিড়ি ডিঙ্গিয়ে হেঁটে হেঁটে উঠেছি। প্রতিটি সিঁড়ির সাথে জড়িয়ে আছে গভীরতা, পরম মমতা।
ধরেই নিলাম কাজের কোয়ালিটির বিচারে হয়ত আমার ফলাফলটা খুব বেশি ভালো নয়, কিন্তু বছর শেষে যে শ্রমটুকু দিয়েছি তার মূল্যায়ন তো করতে পারতো সময় টিভির মালিক পক্ষ? কিন্তু পরপর দুই বছর করেনি। এবার আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জো ভাই (আহমেদ জুবায়ের) আশ্বাস দিয়েছিলেন আমাদের দেখবেন।কথা দিয়ে কথা রাখেননি জো ভাই।
এই অপমান কর্মজীবনকে বিষাক্ত করে তোলে।কাজের প্রতি তৈরি হয় অনীহা।আর জীবন হয়ে উঠে গ্লানির। তাই মৃত্যু দিয়ে সময় টিভির মালিক পক্ষের অন্যায় নীতির প্রতিবাদ করে যেতে চাই। হয়ত অনেকে ভাববেন চাকরীটা ছেড়ে দিলেই তো হয়। হ্যাঁ, হয়। আমার হাত পা আছে, অল্প সল্প মেধা আছে, তা দিয়ে হয়ত জীবন চালাতে ঠেকায় পড়ব না। আমিও অনেকক্ষণ ধরে কী করবো ভাবছিলাম।চাকরীটা ছেড়ে দিলে সময় টিভির কিচ্ছু যায় আসে না। তাই বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সাথে আলাপ করলাম, তারা বললো শ্রম আদালতে যেতে। কিন্তু আদালতের প্রতি বিশ্বাস নেই আমার।
জানি মৃত্যু কোন সমাধান নয়, কিন্তু অপমান বোধ থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে। গতবারও এমন হয়েছিল, অপমানে সহকর্মীদের সামনে মুখ দেখাতে আর নিজেকে স্বাভাবিক করতে অনেক সময় লেগেছে। এবারও সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমিসহ কয়েকজনের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে মালিকপক্ষ। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মৃত্যু দিয়ে এমন জগণ্য বৈষম্যের প্রতিবাদ করে যাই।হয়ত আমার মৃত্যু দিয়ে রচিত হবে আমার সহকর্মীদের সুদিন।
জানি, আমার মৃত্যুতে সময় টিভি লাভবান হবে। অন্তত মাসে ৩০ হাজার টাকার সাশ্রয় হবে। যেহেতু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেছি সুতরাং চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নেই, চাকরী হারানোর ভয়টাও নেই। শুধু মালিকপক্ষের কাছে অনুরোধ আমার মৃত্যুর পর সময় টিভি থেকে আমার সামান্য জমানো অর্থ যা পাবো তা যেন আমার স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়। কেননা, আমার দুটি সন্তান। সদ্য জন্ম নেয়া ছেলেটির মুখে যেন দুধটুকু তুলে দিতে পারে।
আমি পারতাম নীরবে বিদায় নিতে। মৃত্যুকে বরণ করতে। কিন্তু আমি চাই আমার মৃত্যুটা সবাইকে জানিয়ে হোক। কারণ, আমাকে তিল তিল করে সময় টিভির মালিক পক্ষ মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে।তাই আজ রাতটি আমার শেষ দিন। আজ অথবা আগামীকাল সময় টিভির সামনে আমি মৃত্যুকে বরণ করে নিবো।
ভালো থাকবেন সবাই। আমাকে ক্ষমা করবেন। আর যারা আমাকে ভালোবাসেন তাদের কাছে অনুরোধ আমার মৃত্যুর পর একটি বার প্রতিবাদ করবেন সময় টিভির এমন বৈষম্যমূলক আচরণের। আর সরকারের প্রতি অনুরোধ আমরা মিডিয়া কর্মীরা চরম নির্যাতনের শিকার হই বারবার। আমাদের দিকে মানবিক দৃষ্টিটা রাখুন।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ( সাঃ)
মোঃ সাইফুর রহমান শাকিল
চিত্র সাংবাদিক, সময় টেলিভিশন
নাসির ট্রেড সেন্টার, ঢাকা।
৬ জুলাই ২০১৯ ইং।
(বানান লেখকের নিজস্ব)
/এসএস/পাবলিক ভয়েস