এম শামসুদদোহা তালুকদার
ক্রসফায়ার বা বন্ধুক যুদ্ধ এমন একটা আইটেম, যা কখনো সরকারের একার, আবার কখনো জনগনের মতামতের প্রতিফলনে ঘটে থাকে। এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। আসলে জনগন অপরাধের বিচার চায় দ্রুত। বিশেষ করে ধর্ষণ ও খুনের বিচারটা বিলম্বিত প্রক্রিয়ায় পড়ে গেলে বিচারহীনতা দেখা দেয়। ধর্ষক ও খুনী কিছুদিন জেল খেটে বের হয়ে আসে। এমন নজির থাকায় জনগন আজ এমন অপরাধীদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুদন্ড চায়।
আসলে বিচারপ্রথা এমন একটি ব্যবস্থা- কে চাইলো বা না চাইলো, সেটা বড় কথা না। বড় কথা হলো ন্যায় বিচার হতে হবে। আইনের গতি নিজস্ব গতিতে চলবে। এটাই ন্যায় বিচারের মূলনীতি। দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা জিরোতে। অথচ সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার বলে বেড়ায়, এ ধরনের অপরাধীদের ক্ষেত্রে তারা জিরো টলারেন্স। যা জনগনের মনোভাবের সাথে বিপরীত। বিলম্বিত বিচার ন্যায় বিচারকে বধ করে। প্রাচীন একটা বাণী আছে, ‘বিলম্বিত বিচার মানে বিচারহীনতা’।
রিফাত হত্যার সিনারিও একদম বিশ্বজিৎ হত্যার ন্যায়। হত্যাকাণ্ডের সেই ভিডিও রেকর্ড দেখে যেন বরগুনার একদঙ্গল কম বয়সী জানোয়ার জনাকীর্ণ রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করেছে রিফাত শরীফকে। প্রকাশ্য দিবালোকে শতশত মানুষের সামনে এভাবেই বিশ্বজিৎকে খুন করা হয়েছিল।
বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারের খবর নাই। সরকারী ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত আসামীরা এখন হাওয়া বাতাস খাচ্ছে। দোল খাচ্ছে। অথচ ন্যায় বিচার হলে তাদের জায়গা হতো জেলখানার আলো বাতাসহীন ফাঁসির সেলে। দেশের জনগন দেখছে বিশ্বজিৎ এর খুনীরা পার পেয়েছে, অনুরূপ রিফাতের খুনীরাও অধরা থাকবে, তাই ক্রসফায়ারের দাবী করেছিলো দেশের জনগনের বড় অংশ। সরকার এখানে মেজরিটির দাবীটা মেনেছে। মেজরিটির মনোভাব সরকার মেনে নেয়ার মানসিকতা আছে, সেটা আবার কেউ বিশ্বাস করে না। সরকারও বিশ্বাস করেনা। মেজরিটিরা গদি উল্টাতে বদ্ধপরিকর, বিষয়টা ভেবে গভর্নমেন্ট এ্যান্ড এসোসিয়েটস্ জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এটা বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য একটি কলঙ্কিত দৃষ্টান্ত। যুগে যুগে এ কলঙ্কের দায়ভার নিতে হবে আওয়ামী লীগকে। না নিলে নাই।
বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হলে অনুরূপ হত্যাকান্ড ঘটতো না। আর বিনা বিচারে খুনী নয়নের বুকটা ঝাঁজরা হতো না। পায়রা নদীর তীরে শর্ট প্যান্ট পরা রক্তাক্ত নিথর দেখতে হতো না। জেমস বন্ডের ফ্যান নয়ন বন্ডের লাশের ছবি দেখেও কতক মানুষ এখনো বিশ্বাস করেছে না। এটা নয়ন তো? অথচ তারা কেউই নয়নকে চিনতো না। নয়ন খুন করতে যাবার আগে কেন সদ্য তোলা ছবি রেখে যায়নি? তাহলে লাশের ছবির সাথে মিলতো ! আগে তোলা নয়নের ছবির সাথে কলাপাতার উপরে শুয়ে থাকা নয়নের চেহারার আদৌ মিল নাই বলে সন্দেহ জনতার।
মানবিকতা আজ তলানীতে। ভাবুন তো, কতটা ক্রুদ্ধ হলে নিকটাত্মীয়রাও আজ নয়নকে দাফন করতে অস্বীকার করে! নয়নের মাও কম যায় নাই। নিজ গর্ভের সন্তানের লাশকে তিনি অগত্যা পুঁতে ফেলতে বলেছেন। এ সব ঘটনা যারা জেনেছে, তারা আগামীতে শিক্ষা নিবে আশা করি। জগত থেকে দুটি যুবকের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর নতীযা দু’রকমের। রিফাতের বেলায় সহানুভূতি। নয়নের বেলায় জুতার বারি।
একটি সমাজ সুসভ্য হতে রাষ্ট্রের মাঝে যে উপাদান থাকা দরকার, তা এখন পলাতক। তাই মানুষ এখন ক্রসফায়ারে উল্লসিত হয়। জনগন ক্রসফায়ারের দাবী তুলে, আর সরকার বাস্তবায়ন করে। এটা একটা জাতীয় অসুস্থতা। এর থেকে জাতি কবে আরোগ্য লাভ করবে, তা আল্লাহ তায়ালা জানেন। আমরা জানি না। আসুন, এদেশে ন্যায় বিচার পূনঃপ্রবর্তনের জন্য আল্লাহর নিকট মুনাজাত ধরি।
লেখক: এক্টিভিস্ট ও বিশ্লেষক