অভিনব এ নতুন কৌশলে টাকা চুরির ঘটনা নতুন করে চিন্তার ছাপ ফেলেছে দেশের ব্যাংকারদের মধ্যে। কারণ, এর আগে যতবারই এটিএম থেকে টাকা চুরি হয়েছে, প্রতিবারই গ্রাহকের কার্ডের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড তৈরি করেছিলেন জড়িত ব্যক্তিরা। প্রতিবারই গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এবার ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা।
পাবলিক ভয়েস: অভিনব পদ্ধতিতে এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরির এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বুথ থেকে ব্যাগ ভর্তি টাকা তুলে নিয়েছে অথচ ব্যাংকের সার্ভারে নেই কোনো তথ্য।
টাকা তোলার কিংবা কত টাকা তোলা হয়েছে, কোন একাউন্ট থেকে তোলা হয়েছে, সর্বশেষ কত টাকা একাউন্টে অবশিষ্ট আছে তার কিছুই নেই। এমন অদ্ভুত ধরণের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ডাচ বাংলা ব্যাংকের বাড্ডা শাখার দুটি এটিএম বুথ থেকে।
সাধারণত এটিএম বুথ থেকে প্রতিবার টাকা উত্তোলনের সময় কয়েক ধরনের তথ্য ব্যাংকের সার্ভারে জমা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের হিসাব নম্বর, টাকা উত্তোলনের সময়, উত্তোলনের পৃথক নম্বর, টাকার পরিমাণ ও অবশিষ্ট টাকার তথ্য।
টাকা উত্তোলনের সময় গ্রাহক নিজেও এসব তথ্যসংবলিত রসিদ পেয়ে থাকেন। ব্যাংকগুলো এসব তথ্য এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে। কারণ, এটিএমে টাকা উত্তোলনসংক্রান্ত অনেক অভিযোগ আসে, যাতে অভিযোগগুলো যাচাই করা যায়।
কিন্তু এই ঘটনায় কোনো তথ্যই ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। পুরো এটিএম বুথের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা চুরির কাণ্ড ঘটিয়েছে। এমনকি গ্রাহক কিংবা কোনো হিসাব থেকেই টাকা কমেনি। কেবল মাত্র হিসেব ছাড়া ব্যাংক থেকে নগদ টাকা কমে গেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ব্যাংকটির বাড্ডা বুথের পৃথক দুটি এটিএম বুথে। বুথ থেকে দুই বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন কার্ড ব্যবহার করে একাধিকবার টাকা উত্তোলন করেছেন।
বুথ থেকে একজন বের হয়ে আবারও টাকা তোলেন। এমনকি এসবই ঘটে বুথের নিরাপত্তাকর্মীর সামনে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, টাকা উত্তোলনের সময় মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করেছেন তাঁরা, চোখে ছিল সানগ্লাস, মাথায় ছিলো হুড টুপি। কিন্তু টাকা উত্তোলনের কোনো তথ্যই জমা হয়নি ব্যাংকের সার্ভারে।
জানা গেছে, গত শনিবার সকালে বাড্ডার এটিএম বুথের টাকার হিসাব মেলানোর সময় তিন লাখ টাকা কম হয়। ওই এটিএমের দায়িত্বে ছিলেন ওরনেট গ্রুপের নিরাপত্তাকর্মী। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দুই বিদেশি কর্তৃক টাকা উত্তোলনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
এরপর সব এটিএম বুথে নিরাপত্তা বাড়ায় ডাচ্–বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শনিবার রাতেই আবারো টাকা চুরির মিশনে নামে ওই চক্র। এসময় খিলগাঁওয়ের তালতলা এলাকায় ডাচ্–বাংলার এটিএমে টাকা চুরি করতে গেলে দুই বিদেশির একজন ধরা পড়েন। পরে আরো পাঁচজন বিদেশিকে আটক করে পুলিশ।
ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, আমরা এখনো জানতে পারিনি কীভাবে তারা টাকা উত্তোলন করলো। কারণ, কোনো গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা কমে যায়নি। কিন্তু বুথের টাকা কমে গেছে।
তিনি জানান, তারা কোনো গ্রাহকের হিসাবও হ্যাক করেনি। এ জন্য গ্রাহকদের চিন্তার কিছু নেই। আমরা নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেবো।
ঢাকায় নামার পরদিনই হানা
এ ঘটনায় পুলিশ ইতোমধ্যে ৬ বিদেশী নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। গ্রেপ্তার ছয়জনই ইউক্রেনের নাগরিক। তাঁরা গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তুর্কি এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে ইউক্রেন থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে বাংলাদেশে আসেন। ৬ জুন তাঁদের ভারতে যাওয়ার কথা ছিলো।
গ্রেপ্তার ছয়জনসহ আরো একজনের বিরুদ্ধে খিলগাঁও মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে ৫০টির মতো কার্ড পাওয়া গেছে, যার অধিকাংশতেই ‘ডিসকাউন্ট’ লেখা। তাঁদের কাছ থেকে মুখোশ, টুপি, সানগ্লাস, ছয়টি মুঠোফোন এবং একটি আইপ্যাড জব্দ করা হয়েছে। খবর প্রথম আলো।
গ্রেপ্তার ছয়জন হলেন দেনিস ভিতোমস্কি (২০), নাজারি ভজনোক (১৯), ভালেনতিন সোকোলোভস্কি (৩৭), সের্গেই উইক্রাইনেৎস (৩৩), শেভচুক আলেগ (৪৬) ও ভালোদিমির ত্রিশেনস্কি (৩৭)। এ ছাড়া ভিতালি ক্লিমচুক (৩১) নামের আরেকজন পলাতক। জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে জড়িত গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, জিজ্ঞাসাবাদেও তাঁরা কেউই তথ্য দিচ্ছেন না।
[caption id="" align="aligncenter" width="550"] গ্রেফতার হওয়া ৬ ইউক্রেনিয়ান[/caption]
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (পূর্ব) খিলগাঁও অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাছে যে কার্ডগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো এটিএম বুথে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাংকের কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে ওই বুথের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর তাঁরা নিজেদের মতো করে টাকা তুলে নিয়ে যান। এটি সম্পূর্ণ নতুন ও অভিনব পদ্ধতি। আগে কখনো এই পদ্ধতির ব্যবহার তাঁদের নজরে আসেনি।
শাহিদুর রহমান বলেন, এই বিদেশিদের সঙ্গে দেশীয় কোনো চক্রের সংযোগ রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন। কারণ, ঈদের আগে এমন একটি সময়কে তারা বেছে নিয়েছেন, যখন ব্যাংকগুলো এটিএম বুথে তাদের টাকা সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া পলাতক ব্যক্তির কাছে আরও কিছু ডিভাইস রয়েছে, যাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
/এসএস