
মুফতি হামেদ বিন ফরিদ আহমদ
হাফেজ, আলেম ও মুহাদ্দিস
সদকা অর্থ অল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে যে দান করা হয়। ফিতর অর্থ রোজা সমাপন। সদকাতুল ফিতর অর্থ হলো রোজা শেষে সদকা। রোজা শেষে ঈদুল ফিতরের দিনে সকালবেলায় শোকরিয়া ও আনন্দস্বরূপ যে নির্ধারিত সদকা আদায় করা হয় তাই সদকাতুল ফিতর। (১)
বিধান: সদকায়ে ফিতর আদায়ে দুনিয়াতে ওয়াজিব থেকে দায়মুক্তি ও আখেরাতে অঢেল সওয়াবের মালিক হওয়া যাবে। (২)
উদ্দেশ্য: রোজাদার ব্যক্তি নিজেকে খুব সংযত রাখা সত্ত্বেও রোজার মধ্যবর্তী সময়ে কিছু না কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়েই যায়। পানাহার এবং রোজা ভঙ্গকারী বিষয়াবলী থেকে তো বিরত থাকা অনেকটা সহজলভ্য।
কিন্তু অযথা কথাবার্তা ,অশালীন বাক্য প্রয়োগ কিংবা ইসরাফ ইত্যাদি হতে পুরোপুরিভাবে বিরত থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ ধরণের ত্রুটির ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে রোজা শেষ হওয়ার পর শরীয়তে সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রাসূল সা. এর বাণী: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. সদকায়ে ফিতর আদায়ে খুব তাগিদ দিয়েছেন। যা অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি হয়, তা দূরীকরণ নি:স্ব লোকের আহার যোগানের কাজ দেয়।
সুতরাং যে ব্যক্তি তা ঈদের পূর্বে আদায় করে, তাহলে তা মাকবুল জাকাত হবে। আর যদি ঈদের পর আদায় করে ,তাহলে তা সাধারণ সদকা হবে। (৩)
উক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার দুটি উদ্দশ্যে। একতো রোজার মধ্যবর্তী সময়ে হয়ে যাওয়া ভুলত্রুটির ক্ষতিপূরণ, দ্বিতীয়ত অসহায়-মিসকিনদের জন্য ঈদের রিজিকের বন্দোবস্ত। যাতে তারাও সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে।
আর এই জন্যেই প্রিয় নবী সা. বলেছেন:‘অসহায় নি:স্বদের পিছনে এ পরিমাণ ব্যয় কর যেন তারা এদিনে অন্যের কাছে চাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।
সদকাতুল ফিতরের ইতিহাস: রাসূল সা. রোজা ফরজ হওয়ার বছরেই জাকাত ফরজ হওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। যে বছর রোজা ফরজ হয়. সে বছরই রোজা শেষের দুদিন আগে রাসুল সা. খুতবাতে সাহাবায়ে কেরামকে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। (৪)
ফিতরার আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব: ফিতরা আদায় করা মহান আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ। বিত্তবান মুসলিম নাগরিকের উপর ফিতরা ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। গরিব-অসহায়দের হক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এই সদকাতুল ফিতরকে।
পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ মহান ঈদের আনন্দ প্রদান করেছেন। সমাজে বসবাসকারী ধনিক শ্রেণীর মানুষদের সাথে সাথে গরিবরাও যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এজন্য এই সদকাতুল ফিতরের আমলকে ওয়াজিব করা হয়েছে।
ফিতরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী ধনীদের অর্থ গরিবদের মধ্যে বন্টন হয় এবং এর দ্বারা গরিবদের জীবনযাপনে কিছুটা হলেও গতি ফিরে আসে। এজন্য ইসলামে সদকাতুল ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম।
কারণ, এ ফিতরা দানের মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে সমতা ফিরে আসে এবং সহযোগিতার মানসিকতার বিস্তার ঘটে। একে অন্যের সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক সাধিত হয়।
কারা দিবেন, কাদের দিবেন: প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিম ব্যক্তির উপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। ‘সামর্থ্যবান‘ শব্দের ব্যাখ্যা হল, প্রয়োজনিতিরিক্ত (ব্যবহৃত, ঋণ ইত্যাদি) যাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদের (৫২.৫ ভরি রূপা) মালিক হওয়া। তবে যাকাতের ন্যায় এক্ষেত্রে এক বত্সর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়।
অতএব কেউ যদি ঈদের আগের দিনও এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাকেও তা আদায় করতে হবে। সামর্থ্যবান না হলে সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে না।(৫) রাসূল সা. বলেছেন, সর্বোত্তম সদকা সেটাই,যেটা সামর্থ্যবান কেউ আদায় করে। (৬)
অতএব পুরুষ-নারী সবার উপরই এই সদকা ওয়াজিব। রোজা না রাখলে বা রাখতে না পারলেও তার উপর ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। (৭)
অসহায়, গরিব-মিসকিন যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য, তারাই ফিতরার হকদার। যার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৫২.৫ ভরি রূপা পরিমাণ সম্পদ নেই তাকেই এই সদকা দেওয়া যাবে। (৮)
পরিবারের কয়েকজনের সদকা মিলিয়ে একজন গরিবকে একসঙ্গে দেওয়া যেতে পারে। বা একজনের সদকা কয়েকজন গরিবকেও দেওয়া যেতে পারে। তবে অধিকতর উত্তম হল, একজন গরিবকে এই পরিমাণ ফিতরা দেওয়া , যা দিয়ে সে তার ছোটখাট প্রয়োজন পূরণ করতে পারে কিংবা দু-তিন বেলা খেতে পারে। (৯)
ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রীবা তার মূল্যের টাকাও আদায় করা যায় বা অন্য কোন বস্তু কিনেও দেওয়া যায়। (১০)
কার পক্ষ থেকে দিবেন: নিজের পক্ষ থেকে এবং নিজের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান বা অবিবাহিত মেয়ের পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব। সন্তানের নামে সম্পদ থাকলে সেখান থেকে আদায় করা যাবে। প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব নয়। কোনো এতিম শিশুর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকলে তার পক্ষ থেকেও আদায় করা ওয়াজিব। (১১)
কখন ওয়াজিব হয়: সদকাতুল ফিতর ঈদুল ফিতরের ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজিব হয়। কাজেই সেদিন ভোরের আগে কেউ যদি মারা যায়, তার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে না। আবার ভোর হওয়ার পর কেউ জন্ম নিলে তার পক্ষ থেকেও সদকা আদায় করা ওয়াজিব হবে না। (১২)
কখন আদায় করতে হয়: ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে জাকাতের ন্যায় সে সময়ের আগেও আদায় করা যায়।
আবার কোনো কারণে সময় মত আদায় করতে না পারলে পরেও আদায় করা যাবে। কেউ আদায় না করে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে তার উত্তরাধিকারি আদায় করে দিলেও হয়ে যাবে। (১৩)
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ: প্রথমে তিনটি হাদিস উল্লেখ করি।
- ইবনে উমর রাজি. বলেন,রাসূল সা. সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হলো,এক সা যব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার উপরই এটা আবশ্যক। (বুখারী-১৫১২)
- আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য দিয়ে। তা এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনীর বা এক কিসমিস দিয়ে হত। (বুখারী-১৫০৬)
- ইবনে আব্বাস রাজি. একবার রমজানের শেষ দিকে বসরায় খুতবা প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, তোমাদের রোজার সদকা আদায় কর। লোকেরা যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি। তখন ইবনে আব্বাস রাজি. বললেন, এখানে মদিনার কে আছে দাঁড়াও।তোমাদের ভাইদেরকে বল। তারাতো জানে না। বলো যে, রাসূল সা. এই সদকা আবশ্যক করেছেন। এক সা খেজুর বা যব অথবা আধা সা গম। প্রত্যেক স্বাধীন-দাস, পুরুষ-নারী, ছোট-বড় সবার উপর ওয়াজিব। ( আবু দাউদ-১৬২২)
উপরোক্ত হাদিস তিনটির ভাষ্যানুযায়ী নিম্নের শস্যগুলো দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। নাম ও পরিমাণ নিচে দেওয়া হল:
যব: এক সা, খেজুর: এক সা, কিসমিস: এক সা, পনীর: এক সা, গম: আধা সা ( যা ৩নং হাদিস থেকে বুঝা যায়)। এই পাঁচ প্রকার শস্যের কথা হাদিসে এসেছে। এই পাঁচ প্রকার শস্য সরাসরি দিলেও হবে, আবার এসবের মূল্য দিলেও হবে।তবে অন্য কোনো শস্য দিতে চাইলে এই পাঁচ প্রকারে কোনো এক প্রকারের মূল্য হিসাব করে দিতে হবে।
সা- এর বর্তমান পরিমাণ:
১ সা = ৩কেজি ৩০০ গ্রাম, আধা সা= ১কেজি ৬৫০ গ্রাম, কাজেই যব, খেজুর, কিসমিস বা পনীর হিসাব করে দিলে ৩কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর মূল্য দেয়া যাবে। আর গম হিসাবে দিলে ১কেজি ৬৫০গ্রাম বা এর মূল্য দেয়া যাবে।
ইনসাফপূর্ণ সদকাতুল ফিতর: সদকাতুল ফিতর গম,যব, খেজুর, কিসমিস আর পনীর নির্ধারণের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো, যাদের উপর এই ফিতরা ওয়াজিব হয়; তাদের আর্থিক অবস্থার ভিন্নতার কারণে।
কেউ আছে সাহিবে নেসাব, কিন্তু আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল না। সে গমের হিসাবে ফিতরা দিবে। আবার অনেকে আছে সাহিবে নেসাব হওয়ার পাশাপাশি মোটামুটি আর্থিকভাবে সচ্ছল; সে খেজুরের হিসাবে দিবে। এবং সাহিবে নেসাব এবং অডেল সম্পদের মালিকও; সে কিসমিসের হিসাবে ফিতরা আদায় করাই হলো উত্তম।
এছাড়া খেজুর বা চাল বিভিন্ন দামের রয়েছে। এর মধ্যে কোনটি দ্বারা ফিতরা আদায় করা হবে? আসলে উত্তম হলো সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা চাল আদায় করা।
তবে ধনীদের সর্বোচ্চ এবং সাধারণদের মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করা শ্রেয়। ইনসাফ হলো যারা যে চালের ভাত খান বা যারা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তারা সে সমমানের বা সমমূল্যের ফিতরা আদায় করবেন।
রাসূর সা. বলেছেনে, তাই উত্তম, দাতার কাছে যা সর্বোত্কৃষ্ট এবঙ যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি। (বুখারি, খ-৩, পৃ-১৮৮)। একজন মুসলমানের মুখে হাসি ফুটানো উত্তম সদকা।
ফলে সদকাতুল ফিতরের মাধ্যমে ফিতরের সওয়াবের পাশাপাশি গরিব-অসহায়দের ঈদ আনন্দে শরিক করে তাদের মুখে হাসি ফুটানোর সওয়াবও পাওয়া যাবে।আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদের সহায় হোন।
তথ্যপঞ্জী:
১. হেদায়া, খ-১
২. বাহরুর রায়েক, খ-২,পৃ-২৭১
৩. আবু দাউদ-১৬০৯
৪. বাহরুর রায়েক, খ-৩,পৃ-২৭০
৫. বাদায়িয়ুস-সানায়ে, খ-২, পৃ-৫৩৫
৬. বুখারী-১৩৬০
৭. আহকামে যিন্দেগী, পৃ-২৩২
৮. আদ্দুর মুখতার, খ-২, পৃ-৩৬৭
৯. আদ্দুর মুখতার, খ-২, পৃ-৩৬৭
১০. আদ্দুর মুখতার, খ-২, পৃ-৩৬৬
১১. আদ্দুর মুখতার, খ-২,পৃ-৩৬১-৬৩/ বাদায়িয়ুস সানায়ে,খ-২,পৃ-৩৩৫-৩৬
১২. বাদায়িয়ুস সানায়ে,খ-২,পৃ-৩৪৪
১৩. বাদায়িয়ুস সানায়ে,খ-২,পৃ-৩৪৪-৪৫
মুহাদ্দিস, ইমাম, মুসলিম ইনস্টিটিউট, কক্সবাজা।
/এসএস

