সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া
ডাঙায় বাস করে না কি কুমিরের সাথে লড়াই করে জিতা যায় না। পোড়া লাশটা কি পেরে ওঠবে রাষ্ট্রের এই সিস্টেমের সাথে? না কি চাপা পরে যাবে ইস্যূ হয়ে?
বলছিলাম ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি'র কথা।
তাকে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলা সকাল ১০টার দিকে তার অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে অফিসে ডেকে নেন। পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে রাফি'র শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন রাফি'র মা। পরে রাফি'র পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন অধ্যক্ষ। সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের লোকজন রাফি'র গায়ে আগুন দিয়েছে। ৬ এপ্রিল সকাল অনুমান পৌনে ১০টায় ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার সাইক্লোন সেন্টার ভবনের ছাদে নুসরাত জাহানের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন রাফি। আহতাবস্থায় লোকজন তাকে চিকিৎসার জন্য সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সর্বশেষ উন্নত চিকিৎসার জন্য একই তারিখে অর্থাৎ ৬ এপ্রিল বিকাল ৩টায় ঢামেকের বার্ন ইউনিটের আইসিইউ ওয়ার্ডের রেড ইউনিটে এনে তাকে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নুসরাতকে মৃত ঘোষণা করেন।চিকিৎসকদের প্রাণপণ চেষ্টার পরও তাকে বাঁচানো যায়নি। টানা ১০৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে হার মানেন রাফি।
রাফি'র পোড়া লাশটি দেশবাসীর মত প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়েও নাড়া দিয়েছে। বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। রাফি'র পরিবারের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন। মামলার এজাহার ভুক্ত প্রায় আসামীই ধরা পড়েছেন। কিন্তু কপাল পোড়া, দেহ পোড়া মেয়েটি অঘোষিত যুদ্ধ যে নেমে পড়েছে তার কি হবে? রাষ্ট্রের পুলিশী সিস্টেমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাফি যে লড়াই শুরু করেছে সে লড়াইয়ে দেশবাসী আর প্রধানমন্ত্রী কি থাকবেন পোড়া লাশটার সাথে?
নুসরাত জাহান রাফির সুরতহাল প্রতিবেদনে লেখা হলো নুসরাতের বয়স ১৮ বছর। মাথার চুল কালো ও পোড়া, লম্বা অনুমান ১৮ ইঞ্চি। কপাল স্বাভাবিক। উভয় চোখ ও মুখ বন্ধ, নাক দিয়ে সাদা ময়লা বেরিয়ে এসেছে। মুখমণ্ডল গোলাকার, উভয় কান, থুঁতনি, গলা, ঘাড়সহ পোড়া ও ঝলসানো। উভয় হাতের আঙুল পর্যন্ত রাউন্ড গজ-ব্যান্ডেজ, যাতে পোড়া ঝলসানো। গলার নিচ থেকে বুক-পেট-পিঠ-যৌনাঙ্গ-মলদ্বারসহ উভয় পায়ের পাতা পর্যন্ত রাউন্ড গজ-ব্যান্ডেজ, যাতে পোড়া ঝলসানো। গায়ের রঙ ফর্সা, লম্বা অনুমান ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। পরনে রাউন্ডগজ ছাড়া কিছু নেই, সরকারি চাদর দিয়ে ঢাকা। নুসরাত জাহানের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন।
নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা সম্পর্কে প্রথমে পুলিশ অপরাধীদের ধরার পরিবর্তে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। ওসি ‘হত্যা’ না ‘আত্মহত্যা’ বলে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। জেলা প্রশাসন অধ্যক্ষের পক্ষে কাজ করেছে। এসপি পুলিশ সদরদপ্তরকে চিঠি দিয়ে নুসরাতের পরিবারের ওপর দায় চাপিয়েছে। সম্প্রতি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে পুলিশ বিভাগ থেকে।
প্রশ্ন হলো এই তদন্ত কতটা সঠিক হবে?
রাফি হত্যা মামলায় ওসি চালাকি করেছেন, এসপি ওসিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, আবার তারাই তদন্ত করছেন।
আমরা সবসময় দেখে আসছি যে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলে সেটি তদন্ত করানো হয় পুলিশকে দিয়েই। ফলে পুলিশের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ এসেছে এর সিংহভাগেরই কোনো বিচার হয়নি। কারণ যখন তদন্ত করা হয়েছে তখন তাদের লোকদের দিয়েই তদন্ত করা হয়েছে। সেখানে দোষ ঢাকার একটা প্রবণতা দেখা গেছে। ফেনীর পুলিশ সুপারের (এসপি) যে কার্যকলাপ সেটির মধ্য দিয়ে নুসরাত হত্যার ঘটনাটি অন্য খাতে প্রবাহিত করা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ, তিনি যেসব কথা বলছেন সেগুলো মোটামুটিভাবে অপ্রাসঙ্গিক। ফৌজদারি মামলায় দেরি বলে কিছু নেই। এসপি বলছেন- দেরি করে মামলা করা হয়েছে। বা নুসরাতের ভাই এজাহার বদল করেছে- এমন কথাও বলা হয়েছে। এটি তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। এজাহারে যা লিখা হয়েছিলো নুসরাতের ভাই তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কারণ এজাহারে মূল অপরাধী মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নাম ছিলো না। নুসরাতের ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে অধ্যক্ষের নাম যুক্ত করা হয়েছে। এ সমস্ত কার্যকলাপে স্পষ্টতই বোঝাই যাচ্ছে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পক্ষ নিচ্ছিলেন। এছাড়াও, অধ্যক্ষকে যখন গ্রেপ্তার করতে বাধ্য করা হয় তখন তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। নারী ও শিশু নির্যাতনের যে নালিশ সেটির সঙ্গে তো ৫৪ ধারার কোনো সম্পর্ক নেই।
৫৪ ধারার যে নয়টি শর্ত রয়েছে সেগুলো অধ্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাহলে সেই ওসির নিশ্চয় চিন্তা ছিলো যে ৫৪ ধারায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করার পর যখন তাকে আদালতে তোলা হবে এবং এই ধারার কোনো শর্ত তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না তখন তিনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। এসব চালাকি ওসি করেছিলেন। এরপর আবার ওসিকে রক্ষা করার জন্যে এসপি চেষ্টা করছেন। তারাই আবার তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটি নিরপেক্ষ প্রতিবেদন দিবে কি না তা শঙ্কার বিষয়। পুলিশের আরেকটি সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এতোদিন পর্যন্ত যে বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে সেখানে সেই অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে ওসির সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণ স্পষ্ট।
রাফিকে যৌন নিপীড়নের পর কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ইতিমধ্যে সেই ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সোনাগাজী মডেল থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে ‘নাটক’ ও পরে অগ্নিদগ্ধের ঘটনাকে ‘আত্মহত্যায়’ রূপ দিতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিলেন ওই ওসি। দুটি ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাসহ তার সহযোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন বলেও অভিযোগ ওঠেছে। সেই ওসির পর এবার জেলার পুলিশ সুপার এসপি এস এম জাহাঙ্গীর আলম মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের পরিবারকে দোষারোপ করলেন।
পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো চিঠিতে তিনি বলেন, ঘটনার দিন নুসরাত মাদ্রাসায় যান। এরপর তার বসার স্থানে ফাইলপত্র রেখে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদের ওপরে বাথরুমের কাছে যান। কিছুক্ষণ পর গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে আসেন। তখন কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও মাদ্রাসার কর্মচারীরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা মামলা করতে কালক্ষেপণ করে। পুলিশ নুসরাতের চাচাকে বাদী করে মামলা করতে গেলে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান আপত্তি জানান। তিনি দুবার এজাহার বদল করেন।
এ বিষয়ে রাফি'র পরিবার জানায়, ওসিকে রক্ষায় এমন চিঠি দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে প্রথম থেকেই পুলিশ ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি মামলার এজাহার নিয়েও পুলিশ কূটচাল চেলেছে। নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা জানান, ঘটনাটি এমনভাবে বলা হয়েছে যাতে মনে হচ্ছে, নুসরাত নিজের ইচ্ছাতেই ভবনের ওপরে যান। অথচ তাকে পরিকল্পনা করে ডেকে নেয়া হয়। এরপর হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কোনো কথাই উল্লেখ করা হয়নি। নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করার পর থেকে ওসি বলে আসছেন, শ্লীলতাহানির অভিযোগ সাজানো। এমনকি ৬ এপ্রিল তার বোনকে হত্যাচেষ্টার ঘণ্টা দেড়েক আগেও মাদ্রাসার ইংরেজির প্রভাষক আফছারউদ্দীন মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। হাসান বলেন, হত্যাচেষ্টার ৩০ ঘণ্টা পর ওসি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, এটা হত্যাচেষ্টা না আত্মহত্যার চেষ্টা, তা তদন্ত করে দেখতে হবে। সর্বশেষ ৮ এপ্রিল তিনি যে মামলা সাজিয়ে পাঠিয়েছেন, সেখানেও পুলিশ তথ্য গোপনের চেষ্টা করেছে। পরিবারের দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত মামলার এজাহার বদলানো হয়েছে। মূলত ওসিকে রক্ষায় এসপি চিঠি দিয়েছেন।
রাফি হত্যা মামলায় একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার। কেননা, যে পুলিশ জড়িত ছিলেন তিনি তো আর একা জড়িত ছিলেন না। সোনাগাজী মডেল থানা থেকে প্রত্যাহার করা ওসির পক্ষে এসপি'র বক্তব্যে প্রমাণিত হয় সেটি সিস্টেমের অন্তর্গত সমস্যা। এর সাথে জড়িতদের তালিকা ছোট নয়। ফলে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বের হয়ে আসতো বলে ধারণা করছি। তবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত নিয়ে একটি সমস্যা হচ্ছে- এই তদন্ত প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা হয় না। এর কারণে বিচার বিভাগীয় তদন্তের কার্যকারিতা তেমন পাওয়া যায় না। বিচার বিভাগীয় তদন্ত থেকে যে কিছুই হয়নি তা কিন্তু নয়। তবে প্রধান প্রধান ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত না হওয়ায় সেগুলোর সুফল পাওয়া যায়নি- সেটিও সত্যি। এমন পরিস্থিতিতে যদি বিচার বিভাগের অধীনে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা যেতো তাহলে সেটি একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারতো। কিন্তু, এই মুহূর্তে আমাদের সেরকম ব্যবস্থা নেই। সেরকম কোনো উদ্যোগও নেই।
নুসরাত হত্যা মামলার বিষয়ে আমাদের নজর রাখতে হবে। তদন্তটি কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও পুলিশি তদন্ত যদি সমান্তরালভাবে হয় তাহলে তাই হোক। তারপর দুটি তদন্ত প্রতিবেদনকে নিয়ে দেখতে হবে সেগুলোর মধ্যে মিল-অমিল কোথায় রয়েছে। তারপর বিচার বিভাগীয় ও পুলিশী তদন্তের ভিত্তিতে আদালত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
নুসরাত জাহান রাফি'র হত্যার ঘটনায় শুধু মাত্র সিরাজুদ্দৌলার লোকজনই অপরাধী নয়। অপরাধী তারাও যারা জনগণের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়োজিত হওয়ার পরেও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে টাকার লোভে অপরাধীদের সহযোগিতা করেছেন। যাদের অবহেলায় রাফি'র নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে। পোড়া লাশটা কি সিস্টেমের সাথে লড়াই করে জিততে পারবে? নাকি পোড়া লাশটার সাথে দেশবাসী আর প্রধানমন্ত্রী'র হার হবে কুমিরের সিস্টেমের কাছে সেটাই দেখার বিষয়।
লেখক-
গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী