তামিম রায়হান
২০১০ সালে কাতারে আসার পর কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে ওঠার কিছুদিন পর একদিন প্রথম দেখি ড. জসিমউদ্দীন নদভীকে। আর আজ ২০১৯ এর ৯ এপ্রিল ভোরবেলায় জানতে পেলাম, তিনি আর নেই এই পৃথিবীতে। মা ও স্ত্রীকে নিয়ে কাবার যিয়ারতে এসে তিনি চিরতরে চলে কাবার মালিকের ডাকে। অনেকদিন ধরে দেখা একজন আদর্শ মানুষের এমন চলে যাওয়ার আকস্মিক খবর ক্ষণিকের জন্য বাকরুদ্ধ করে দিল আমাকে।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে যে প্রতিষ্ঠানের তিনি সহকরী পরিচালক ছিলেন, সেই দারুল মাআরিফের বেশ কয়েকজন ছাত্র কাতারে পড়াশোনা করেন। সেই সুবাদে তাকে চেনা এবং জানা। এরপর গত প্রায় ৯ বছর ধরে প্রতি বছরই কাতারে তাঁর আসা-যাওয়া দেখেছি। অনেকদিন তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় খাওয়া দাওয়া করেছি, গল্প গুজবে কেটেছে বেশুমার সময়। আমার মতো ক্ষুদ্রদের সঙ্গে দেখা হলেও তিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশি।
আরবি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর প্রশংসনীয় পান্ডিত্য ছিল। ফেসবুকে তিনি আরবিতে বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ তিনি বনানীর অগ্নিকান্ডে শোকাহত হয়ে আরবিতে পোস্ট করেছিলেন। সমসাময়িক বিষয়গুলোতে তাঁর আরবি স্ট্যাটাসগুলো সংকলনের দাবি রাখে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হতাম- কারণ, এই বয়সেও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পড়াশোনায় তিনি কাতারে এসেও বিভিন্ন লাইব্রেরিতে দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকতেন বইয়ের পাতায়। দীর্ঘ সাধনার পর তিনি গত বছর ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
আমাদের পরিচিত এহসান ভাইয়ের বাসায় গতবছর সর্বশেষ এক নৈশভোজে তাঁর সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়া করেছিলাম। ধীরে ধীরে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, এ নিয়ে তাঁর কাছে ক্ষীণস্বরে আমার অভিযোগ জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, এর চেয়ে কত ভালো হতো যদি আপনারা ‘নদভী’রা মিলে একসঙ্গে বাংলাদেশে আরবি ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটাতেন। আমার মতো অভাজনের এসব কথা তিনি শুনে যেতেন, এক-দু কথায় উত্তর দিতেন কখনো কখনো, মুখে হাসি লেগে থাকতো তখনও। এরপর আমরা চলে যেতাম অন্য প্রসঙ্গে।
যতদিন তাকে দেখেছি, বেশিরভাগ সময় তিনি চুপ থাকতেন। প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিরা তো এমনই হয়ে থাকেন। কম বলেন, বেশি শোনেন। আমি তাকে এমনই দেখেছি গত প্রায় এক দশক ধরে।
ড. জসিমউদ্দীন নদভী একজন শিক্ষাবিদ এবং জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশ, ভারত ও আরব দুনিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি পড়াশোনা করেছেন। তাঁর অসংখ্য ছাত্র ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে এবং আরব মুলুকের নানা দেশে। আমার বন্ধু জামিলের ভর্তির প্রাক্কালে দারুল মাআরিফে তিনি যেসব সহযোগিতা করেছেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম তাঁর কাছে।
ব্যক্তিগত গুণ-গরিমার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশে আরবি ভাষা ও সাহিত্য চর্চার পথিকৃৎ মাওলানা সুলতান যওক নদভির জামাতা ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। রেখে গেছেন দু কন্যা এবং এক পুত্র আরো অনেক স্বজন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি ইসলামি দলের (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) প্রার্থী হয়ে (হাতপাখা প্রতীকে) তিনি সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কক্সবাজার-২ আসন থেকে।
কুরআনের ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই জ্ঞানী এবং গুণী মানুষটিকে পরম করুণাময় ভালোবাসেন বলেই হয়তো পবিত্র কাবার শহরে অতিথি থাকাকালে তাঁকে ডেকে নিলেন আপন ছায়াতলে। উর্ধ্বজগতে তিনি যেন দয়াময়ের অতিথি হিসেবে সমাদৃত এবং সম্মানিত হন, মহান শক্তিমান আল্লাহর কাছে আমাদের সবার এই মিনতি।
লেখক ও সাংবাদিক
আরও পড়ুন :
https://publicvoice24.com/2019/04/10/পবিত্র-কাবায়-জানাযা-ও-জান/