সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন কে গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলা হয়। পশ্চিমা বিশ্বের মত মুসলিম প্রধান দেশগুলোতেও এখন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসে। গণতান্ত্রিক মতবাদের সাথে ইসলামী আদর্শের পার্থক্য থাকলেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে, পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করতে ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে উপমহাদেশের ইসলামপন্থীদের মতানৈক্য নেই। বরং নির্বাচনে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রার্থী থাকলে তাকে ভোট দেওয়াকে পূণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়। তাদেরকে ভোট না দেওয়াকে আমানতের খেয়ানত করা হিসেবেও আক্ষা দেওয়া হয়েছে।
বিগত জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম ভোটের রাজনীতিকে জিহাদের সাথে তুলনা করে বক্তব্য দেন। তার এই বক্তব্যের পরে ফেসবুকে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আজকাল ফেসুবক একটা বিতর্কের জায়গা হয়ে দাড়িয়েছে। বিতর্কটা এখানে স্বাভাবিকে রূপ নিয়েছে। খুব মামুলি বিষয়েই চলে দীর্ঘ আলোচনা সমালোচনা। অনেক সময় বিষয়ের গভীরতা বুঝতে না পেরে অযথাই বিতর্কে জড়ান কেউ কেউ। চলতে থাকে পক্ষে বিপক্ষে একক বা গ্রুপভিত্তিক সমালোচনা। কোন কেনটি শেষ হয় ইস্যুর বদলে। আবার কোনটা শেষ হয় এক পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়লে। মুফতী ফয়জুল করিমের বক্তব্যটি সেসময় ফেসবুক ইউজারদের মধ্যে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে ফেসবুক জগতে চলতে থাকে ‘জিহাদ নির্বাচন’ বিতর্ক।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে’র নায়েবে আমির ও চরমোনাই জামিয়া রশিদিয়া আহসানাাবদ মাদরাসার শায়খুল হাদিস মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করিমের বক্তব্যকে ঘিরে নির্বাচন জিহাদ তর্কের সূত্রপাত। আর সেটা শেষ হলো মুফতী আমিনী রহ. এর ৩০ বছর আগের একটি পোস্টার পর্যন্ত। ফেসবুকে হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছে ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. এর ৩০ বছর পুরনো একটি নির্বাচনী পোস্টার।
পোস্টারটিতে লেখা আছে, "আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া -২ সরাইল এলাকা থেকে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন মনোনীত প্রার্থী আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মুফতী ফজলুল হক আমিনী কে বটগাছ মার্কায় ভোট দিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার জেহাদে শরীক হোন"। মুফতী আমিনী রহ. এর নির্বাচনী পোস্টার ভাইরাল হওয়ার পর আগের বিতর্ক থেমে যায়। পোস্টারটি যেন জ্বলন্ত অঙ্গারে এক পশলা পানি ঠেলে দিয়েছে। ফয়জুল করিমের বক্তব্যের বিরোধী পক্ষ দূর্বল হয়ে পড়ায় বিতর্ক সেখানেই থেমে যায়। কিন্তু নির্বাচন ও জিহাদ নিয়ে আমার মন অনুসন্ধানী হয়ে ওঠে। শুরু হলো বক্তব্য আর পোস্টার নিয়ে অনুসন্ধান।
মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করিমের চরমোনাইতে দেয়া বক্তব্যে ভোটের রাজনীতিকে জিহাদের সাথে তুলনা করা হয়। ইউটিউব ও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের বক্তব্যে তিনি প্রথমে বর্তমান সময়ে এদেশে সশস্ত্র বিপ্লব কেন সম্ভব নয় সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ব্যাখা দেন। এরপর তার বাবা চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সৈয়দ ফজলুল করিম রহ. এর উদ্ধৃতি দিয়ে তাকে বলতে দেখা যায়, "আমরা নির্বাচন করি না আমরা জিহাদ করি। এই জিহাদে যারা অংশ গ্রহণ করবে তারা মুজাহিদ। এতে যারা সময় দেবেন, অর্থ খরচ করবেন তাদের প্রতিটি কাজের বিনিময়ে সওয়াব লেখা হবে। তবে এই মুজাহিদ হলো তারাই যারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুমাত কায়েম করার জন্য সাধনা করবে, মুজাহাদা করবে"।
তার এই বক্তব্যের পর পুরাতন সেই পোস্টারের সূত্র খুঁজি। কারণ বক্তব্য আর পোস্টারে দূরত্ব ৩০ বছরের হলেও ভাষা ছিল অভিন্ন। তার প্রেক্ষিতেই খুঁজে পাই আলোচনায় উঠে আসা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব প্রথম তাওবার রাজনীতির ডাক দেয়া হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ১৯৮৬ সালের রাজনীতির ইশতেহার ও সে সময়ের নির্বাচনি পোস্টার। দেখা যায় যে, ৩২বছর আগেই জনসম্মুখে এনে দেখনো হয়েছে সুস্থ ও ইসলামি রাজনীতিকে বহু আগেই যুদ্ধের সমতূল্য বলা হয়েছে।
মুফতী ফয়জুল করিমের বক্তব্যে আলোচনায় আসা প্রচলিত নির্বাচনকে হাফেজ্জী হুজুর রহ.ও একই অর্থে নিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আমীরে শরীয়ত হযরত হাফিজ্জি হুজুর রহ. বেতার ও টিভি ভাষণে বলেন,
“বিগত ১৯৮১ সালে ইসলামী হুকুমত কায়েমের নির্বাচনী জিহাদের ডাক, তাই এমন এক গণ-জোয়ার সৃষ্টি করল, যার ফলে সরকারী-সকল বিরোধী দলই ইসলামের সামনে নতজানু হতে বাধ্য হলো। আর সে নির্বাচনে এটাই ছিল বিরাট সাফল্য। মানব জাতির এ ঐতিহ্যগত দায়িত্ব পালনের মানসে পরবর্তী সাংগঠনিক রূপ পেল, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
বর্তমানে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বস্তুত প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি যোগ্য নেতৃত্ব বাছায়ের নির্ভরযোগ্য পন্থা নয়। একথা জানা ও বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এ নির্বাচনে খেলাফত আন্দোলনের অংশ গ্রহণের কারণ দেশের সার্বিক সংকটময় পরিস্থিতি। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন সকল স্তরেই আজ এক দুর্বিসহ অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। এ পরিস্থিতির হাত থেকে সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তার উত্তরণের লক্ষ্যে সাময়িক বিকল্পরূপে আন্দোলন ও জিহাদের অংশ হিসাবেই খেলাফত আন্দোলন বর্তমানে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
সূত্র: হাফেজ্জী হুজুর রহ. রচনাসমগ্র, হাফেজ্জী হুজুর গবেষণা ফাউন্ডেশন, লালবাগ, ঢাকা।
(প্রকাশকাল: ২০১২। পৃ. ১২১)
৮০ দশকে হযরত হাফিজ্জী হুজুরের সাথে রাজনীতিতে ঐক্যমত পোষণ করে সকল হকপন্থী ওলামায়ে কেরাম নির্বাচনে এসেছিল। তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা নিয়ে কোন ভিন্ন মতের ইতিহাস খুঁজে পাইনি। সেই নির্বাচন কে জিহাদ হিসেবেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন সমস্ত ওলামায়ে কেরাম। মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ এর মত সকলেই সারাদেশে পোস্টারে বটগাছ মার্কায় ভোট দিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার জেহাদে শরীক হওয়ার আহ্বান করেছিল। সেই সময়ে জামাত ছাড়া এমন কোন দল বা আলেম খুঁজে পাইনি যিনি হাফিজ্জী হুজুরের ডাকে সারা দেননি, নির্বাচনী কার্যক্রমে স্বকীয় থাকেননি।
আল্লামা সামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর মতে রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদ পাওয়া হইতে অযোগ্য ও দুষ্ট লোককে না কামিয়াব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা জিহাদের সমতুল্য সওয়াবের কাজ।
যারা মুফতী ফয়জুল করিমের বক্তব্যকে নিয়ে হাস্যরস করেছেন। তার ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছেন যে, তিনি প্রকৃত জিহাদের বিধানের অপব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মনে রাখা দরকার ফয়জুল করিমের বক্তব্যের ৩২ বছর আগেই এদেশে তাওবার রাজনীতির জনক হযরত হাফিজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে সেসময়কার ওলামায়ে কেরাম নির্বাচনকে জিহাদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমি অনুসন্ধান করে যে তথ্য পেয়েছি হয়তো তিনি আগেই পেয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন। কারো বক্তব্য না বুঝলে তার ব্যাখ্যা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই বিতর্ক সৃষ্টি করা একটি রোগে পরিণিত হয়েছে। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই সমালোচনা ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন হাজারো মানুষ। কারো বক্তব্যের সম্পর্কে ভাল ভাবে না জেনে, না বুঝে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া জ্ঞানী মানুষের কাজ নয়। নির্বাচনী জিহাদে ঝাপিয়ে পড়ার কথা বলে কি তিনি ভুল করেননি। এই কথার উপর ৮০ দশকেই সমস্ত আহলে হক ওলামায়ে কেরাম একমত ছিলেন।
-লেখক-
গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী